বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।
সিন্ধুলিপি পাঠোদ্ধারে এক নয়া দিগন্ত উন্মোচন করল বঙ্গকন্যা অধুনা বেঙ্গালুরু নিবাসী বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়ের প্রবন্ধ। চলতি বছরের ১৯ ডিসেম্বর ‘নেচার ডট কম’-এ প্রকাশিত ওই প্রবন্ধে তিনি জানান, শব্দচিহ্ন বা অর্থচিহ্ন সম্বলিত সিন্ধুলিপি কোনও ভাবেই বানান করে নতুন নতুন মানুষ বা দেবদেবীর নাম অথবা জায়গার নাম লিখতে পারত না। আসলে সিলমোহরগুলিতে প্রয়োজনীয় বাণিজ্যিক আর করসংক্রান্ত তথ্য লিখে রাখতে তৈরি এই সাঙ্কেতিক লিপিতে বিভিন্ন পণ্য, কারিগরি শিল্প এবং তৎসংক্রান্ত খাজনার নাম, খাজনা আদায়ের রেট, বিভিন্ন বাণিজ্যিক পারমিট বা ছাড়পত্রের নাম, প্রভৃতি বিভিন্ন শব্দচিহ্ন (লোগোগ্রাম) এবং অর্থচিহ্ন (সিম্যাটোগ্রাম) দিয়ে লেখা হত।
আজ থেকে প্রায় ৪৬০০ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা এই অদ্ভুত লিপির প্রচলন করেন যা মূলত বিভিন্ন ক্ষুদ্র সিলমোহর এবং ট্যাবলেটের উপরে উৎকীর্ণ অবস্থায় পাওয়া যায়। প্রায় ১০০ বছর ধরে অসংখ্য পণ্ডিত ও উৎসাহী মানুষ সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধারের চেষ্টা করে চলেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই বলেন যে সিন্ধুলিপির সিলমোহরগুলিতে বিভিন্ন রাজা, ব্যবসায়ী, বা দেবদেবীর নাম সংস্কৃত, তামিল ইত্যাদি প্রাচীন ভাষায় বানান করে লেখা। কিন্তু এঁদের কারও পাঠোদ্ধারই সর্বজনস্বীকৃত নয়।
—ফাইল চিত্র।
বহতার মতে সিন্ধু সভ্যতার সিলমোহরগুলি আসলে খাজনা আদায় সংক্রান্ত সিলমোহর। আর সিন্ধুলিপিওয়ালা ছোট ট্যাবলেটগুলো ছিল খাজনা আদায়ের এবং কিছু বিশেষ পণ্য সংক্রান্ত কারিগরিশিল্প ও ব্যবসা করার লাইসেন্স। সিন্ধু নগরীগুলিতে বিভিন্ন পণ্য মাপজোক করে, তাদের উপরে নির্ধারিত বিভিন্ন রকমের খাজনা আদায় করা হত। খাজনা আদায়ের পরে সেই পণ্যবাহী বস্তা, পাত্র, এবং বাক্সদের গায়ে সীলমোহরের ছাপ দেওয়া নরম মাটির ট্যাগ এঁটে দেওয়া হত, যাতে কোন পণ্যে কর আদায় হয়েছে, এবং কোন পণ্যে কর বকেয়া— তা বোঝা যায়। ২০১৯ সালে ‘নেচার ডট কম’-এ প্রকাশিত বহতার আর এক বহুসমাদৃত প্রবন্ধ ইতিমধ্যেই প্রমাণ করেছে, সিন্ধুলিপির চিহ্নগুলি আসলে এক একটি শব্দ বা অর্থ বোঝায়, কোনও বর্ণ বা অক্ষর বোঝায় না।
সিন্ধুলিপির ছোট ছোট ট্যাবলেট, যেগুলি বাণিজ্যিক বা খাজনা আদায়ের ছাড়পত্র হিসেবে ব্যবহৃত হত, তাদের সামনের দিকে ছাড়পত্র সংক্রান্ত পণ্য, বাণিজ্য, কারিগরিশিল্প এবং খাজনার নাম লেখা থাকত। আর পিছনে এক ধরনের পরিমাপ ও সংখ্যা সংক্রান্ত লিপিচিহ্ন থাকত, যেখানে মূলত দুই, তিন, এবং চারটি দাঁড়ি দিয়ে লেখা সংখ্যার ব্যবহার হত। বহতার মতে ট্যাবলেটেগুলির পিছন দিকের লিপিচিহ্নগুলি একই পণ্য বা শিল্প অথবা বাণিজ্যের জন্য ব্যবহৃত ছাড়পত্রের কয়েকটি বিশেষ লাইসেন্স স্ল্যাবের পরিমাণ বোঝাত। বর্তমানেও ভারতে একই ধরনের শিল্পের জন্য পৃথক লাইসেন্স স্ল্যাব ব্যবহার হয়। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও অনুরূপ বাণিজ্যিক সিলমোহরের উল্লেখ রয়েছে। সিলমোহরগুলিতে একশৃঙ্গ (ইউনিকর্ন), ষাঁড়, হাতি, বাঘ, ইত্যাদি প্রাণীর এবং কিছুক্ষেত্রে প্রাচীন কিছু দেবদেবীর ছবিও থাকত, যে গুলি সম্ভবত বিভিন্ন বাণিজ্য সংস্থা (ট্রেড গিল্ড) অথবা শাসকবর্গের পরিচায়ক চিহ্ন হিসেবে ব্যবহৃত হত।
বহতার এই প্রবন্ধ যে সব বিখ্যাত গবেষকের সিন্ধুলিপি সংক্রান্ত নানা বক্তব্যকে যুক্তি সহকারে খণ্ডন করেছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন আসকো পারপোলা, ব্রায়ান কে ওয়েলস। যাঁদের এই বিষয়ে বিখ্যাত বইও রয়েছে।
সিন্ধুলিপি বানান করে লেখা নয় এবং সিন্ধুলিপি চিহ্নগুলিকে সরাসরি সংস্কৃত, তামিল বা অন্য যে কোনও প্রাচীন ভাষার অক্ষর বা বর্ণসমূহের সঙ্গে সরাসরি জুড়ে পাঠোদ্ধার করা কখনওই সম্ভব নয় - বহতার এই প্রতিপাদ্য অন্তত ৯৫ শতাংশ পুরনো পাঠোদ্ধারের দাবির ভিত নাড়িয়ে দেয়। সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার শেষ পর্যন্ত করা যাবে কি না, এই প্রশ্নে বহতা বলেন, “বর্তমানে উপলব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে অনেক চিহ্নের প্রকৃত অর্থ বোঝা না গেলেও, কিছু কিছু চিহ্নের পাঠোদ্ধার অবশ্যই করতে পেরেছি”।