নিজের তৈরি মূর্তির সঙ্গে শিল্পী। —নিজস্ব চিত্র।
মূর্তি গড়ার নেশায় ষোলো বছর বয়সে ঘর ছেড়েছিলেন রঞ্জিত মণ্ডল। তারপর কেটে গিয়েছে প্রায় ৩০ বছর। ৪৬ বছর বয়সি রঞ্জিত আজও ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে মূর্তি গড়ে চলেছেন। অযোধ্যায় রাম কথা কুঞ্জে।
আগামী দিনে অযোধ্যায় ‘রাম পরিক্রমা পথ’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিয়েছেন মন্দির কর্তৃপক্ষ। সেই পথের বিশেষ একটি অংশে থাকছে বঙ্গসন্তান রঞ্জিতের হাতে গড়া মূর্তি।
আদি বাড়ি নবদ্বীপে হলেও রঞ্জিতের বড় হয়ে ওঠা অসমের কাছাড়ে। সেখানেই মাটির সঙ্গে ভালবাসা শুরু। প্রথমে শখে, তারপর নেশায় পরিণত হয় মূর্তি গড়া। গুয়াহাটিতে মাত্র ষোলো বছর বয়সে তার গড়া বেদব্যাসের মূর্তি দেখে রঞ্জিতকে তাঁর সঙ্গে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা অশোক সিঙ্ঘল। রজতের কথায়, ‘‘ওই প্রস্তাব শোনার পর আর দ্বিতীয় বার ভাবিনি। বাড়ির অনুমতি নিয়ে চলে আসি দিল্লি। সেই শুরু। তারপর থেকে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, সঙ্ঘ পরিবারের নানা অনুষ্ঠান সম্মেলনে মূর্তি তৈরির জন্য ডাক পেতে থাকেন তরুণ রঞ্জিত। মাঝে কিছু দিন চিত্রকূটেও ছিলেন। পরে ফিরে আসেন দিল্লি।
অযোধ্যায় রাম মন্দির নির্মাণের পথ খুলে যেতেই বৃন্দাবনের ধাঁচে পরিক্রমা পথ গড়ে তোলার পরিকল্পনা নেওয়া হয়। ঠিক হয়, পথের একটি বিশেষ অংশে রামায়ণের কাহিনি বর্ণিত থাকবে মূর্তির মাধ্যমে। সেই মূর্তি তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় রঞ্জিতকে।
দশরথের পুত্রেষ্টি যজ্ঞ থেকে রামের অভিষেক—রামায়ণের এই একাধিক পর্ব মূর্তির মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলার দায়িত্ব এখন একক ভাবে রঞ্জিতের কাঁধে। মূলত সিমেন্ট-বালি দিয়ে মূর্তি তৈরি হচ্ছে। মূল কাঠামো সাত বাই সাড়ে তিন ফুটের। এক-একটি মূর্তির সর্বাধিক দৈর্ঘ্য চার ফুটের কাছাকাছি। প্রায় হাজারখানেক মূর্তি তৈরি করতে হচ্ছে। এখনও পর্যন্ত ৬৫ শতাংশ মূর্তি তৈরির কাজ শেষ। হনুমানের লঙ্কায় পৌঁছনো পর্যন্ত কাজ সেরে ফেলা হয়েছে। এরপর শুরু হবে রাম-রাবণের যুদ্ধ। যুদ্ধের ওই ভঙ্গিমা, রণক্ষেত্র সাজিয়ে তোলা বেশ চ্যালেঞ্জিং বলেই জানাচ্ছেন রঞ্জিত।
রাম কথাকুঞ্জের উল্টো দিকে দু’কামরার ঘরে বাস রঞ্জিতের। একটি কামরা মূর্তি নির্মাণের স্টুডিয়ো হিসেবে ব্যবহার করেন তিনি। অন্যটিতে থাকা-খাওয়া। মূর্তি গড়ার ফাঁকে সময় পেলেই রঞ্জিত বসে পড়েন খাতা-পেন নিয়ে। ১৯৯৭ সালে ঘর ছাড়ার পর পড়াশোনা বন্ধ হয়ে যায়। দিল্লিতে থিতু হওয়ার পরে ফের পড়াশুনো শুরু করেন। একটাই আক্ষেপ, মাঝের প্রায় দশ-বারো বছর নষ্ট হয়ে গিয়েছে তাঁর। কেন যে সেই সময়ে পড়াশুনা বন্ধ করে দিয়েছিলেন তা ভেবে এখন হাত কামড়ান বর্তমানে গবেষক রঞ্জিত।
মহাত্মা গান্ধী গ্রামোদয় চিত্রকূট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অযোধ্যা ও চিত্রকূট এলাকার মন্দির ও
মূর্তির তুলনামূলক অধ্যয়ন তাঁর গবেষণার বিষয়। মূলত অশোক সিঙ্ঘল ও মন্দির কমিটির নেতা চম্পত রাইদের অনুপ্রেরণায় নতুন করে পড়াশোনা শুরু তাঁর। গবেষণার বাকি কাজ আগামী দু’-তিন বছরের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন তিনি।
ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একাধিক দেশে মূর্তি গিয়েছে রঞ্জিতের। সরকারি চাকরির প্রস্তাব এসেছিল, কিন্তু রামমন্দিরের কাজে মগ্ন রঞ্জিত ফিরিয়ে দিয়েছেন সরকারি চাকরি। রঞ্জিতের কথায়, ‘‘এখন আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য হল রাম পরিক্রমা করিডরের বাকি কাজ যত দ্রুত সম্ভব শেষ করা। এ যে গুরুদায়িত্ব!’’ পরবর্তী ধাপে রঞ্জিতের লক্ষ্য, ভবিষ্যতে মূর্তি তৈরির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা। মূলত বিশেষ ভাবে সক্ষম ব্যক্তিদের হাতের কাজের মাধ্যমে সাবলম্বী হওয়ার পথ দেখানোর স্বপ্ন নিয়ে এগোচ্ছেন অযোধ্যাবাসী বঙ্গতনয়।