বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের করা বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশ হল আজ। প্রায় সব সমীক্ষাতেই ইঙ্গিত, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছে বিজেপি। ছবি:পিটিআই।
কাটাছেঁড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল আগে থেকেই। সব পক্ষই নিজের নিজের খাতায় জমাখরচের হিসেবটা লিখে রাখছিলেন পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে। শুধু বুঝতে দিচ্ছিলেন না। ভরপুর আত্মবিশ্বাস দেখাচ্ছিলেন মিডিয়ার সামনে। নির্বাচনী প্রচার শুরু হওয়ার আগে অমিত শাহ যে সুর বেঁধে দিয়েছিলেন, সেই সুরেই বার বার গেয়ে নানা স্তরের বিজেপি নেতা বলছিলেন, ‘‘আমরা ১৫০ পেরিয়ে যাব।’’ কংগ্রেসও একই পথে হেঁটেছে গোটা ভোট মরসুমে। সরকার হচ্ছেই, ১০০ ছাড়িয়ে যাবে কংগ্রেস— বলছিলেন প্রদেশ নেতৃত্ব।
মুখে যা-ই বলুন, বহিরঙ্গে যতখানি আত্মবিশ্বাসই দেখান, ভিতরে ভিতরে যে সকলেই ঘাবড়ে ছিলেন, তা কিন্তু স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছিল সামান্য ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় গেলেই।
বৃহস্পতিবার গুজরাতে দ্বিতীয় তথা চূড়ান্ত দফার ভোটগ্রহণ মিটতেই বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের করা বুথ ফেরত সমীক্ষার ফল প্রকাশ করা হল। প্রায় সব সমীক্ষাতেই ইঙ্গিত, নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরছে বিজেপি। কংগ্রেসকে এ বারও ক্ষমতার অলিন্দ থেকে অনেক দূরেই থেমে যেতে হচ্ছে। তবে বুথ ফেরত সমীক্ষার এই ফলাফলেও সংশয় কাটছে না গুজরাতের রাজনৈতিক শিবিরের। সমীক্ষা নিয়ে সরাসরি কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরতই থাকছেন বিজেপি এবং কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতা।
এবিপি নিউজের সমীক্ষা বলছে, ১১৭টি আসন পেতে চলেছে বিজেপি। অর্থাৎ, আগের বারের চেয়ে ২টি আসন বাড়তে পারে গুজরাতের শাসকদের। কংগ্রেসের আসনও বাড়বে বলে এবিপি নিউজের সমীক্ষার ইঙ্গিত। ৬১ থেকে বেড়ে এ বার ৬৪ হতে পারে বিরোধী দল। অন্যান্য দল প্রায় মুছে যেতে পারে, একটি মাত্র আসন যেতে পারে তাদের ঝুলিতে।
আরও পড়ুন:
গুজরাত, হিমাচলে বিজেপি-কেই এগিয়ে রাখছে বুথ ফেরত সমীক্ষা
ভোটের এই গুজরাতে আর যাই থাক, ‘গুজরাত মডেল’ নেই
আরও বেশ কয়েকটি সমীক্ষা ইঙ্গিত দিচ্ছে, বিজেপির আসনসংখ্যা ১১০-এর আশেপাশে থাকতে পারে। কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা থেকে অনেক দূরেই থেমে যাবে। কিন্তু গতবারের চেয়ে বেশ কিছু আসন বাড়িয়ে ৭০-এর আশেপাশে থাকবে।
বুথ ফেরত সমীক্ষার এই ফলাফলের দিকে তাকিয়ে ছিল গোটা ভারত। একই রকম ঔৎসুক্য নিয়ে কিন্তু তাকিয়ে ছিলেন বিজেপি এবং কংগ্রেস নেতারাও। কারণ তাঁদের কাছেও একেবারেই স্পষ্ট ছিল না, কী হতে পারে ফলাফল। জাতপাতের সমীকরণ, পুরনো সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং ভেঙে যাওয়া, নতুন সামাজিক সমীকরণ তৈরির চেষ্টা, কট্টর হিন্দুত্ব বনাম নরম হিন্দুত্ব, উন্নয়ন হওয়া বা না হওয়া নিয়ে বিতর্ক, মোদীকে ব্যক্তিগত স্তরে অপমান করা হয়েছে বলে অভিযোগ তোলা, মোদীর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের পাল্টা অভিযোগ উঠে আসা, নোটবন্দি, জিএসটি— সব মিলিয়ে এ বার অনেকগুলো ইস্যুকে মাথায় রেখে ভোট দিল গুজরাত। অত্যন্ত জটিল এবং বেনজির এক আবর্তের মতো ঘুরপাক খেল ভোটের হাওয়া। ফলাফলের আঁচ আগে থেকে পাওয়া তাই অত্যন্ত কঠিন গুজরাতে এ বার। দুই প্রধান রাজনৈতিক দলের দফতরে একটু কান পাতলেই তাই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী হতে পারছে না কোনও পক্ষই। সংশয় সব শিবিরেই রয়েছে।
দিন কয়েক আগের কথা। কলকাতা থেকে আসা কয়েক জন সাংবাদিকের সঙ্গে আলাপচারিতায় গুজরাত বিজেপির মিডিয়া সেলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা হর্ষদ পটেল। বিজেপি মিডিয়া সেন্টারের সে সান্ধ্য কথোপকথনে ভোটের ফলাফলের প্রশ্ন অবধারিত ভাবে উঠে এল। আসনসংখ্যা সম্পর্কে কোনও মন্তব্যে যেতে চাইলেন না হর্ষদভাই। অমিত শাহ যে ‘১৫০ প্লাস’-এর বুলি শিখিয়ে দিয়েছেন প্রত্যেককে, তাও উচ্চারণ করানো গেল না হর্ষদ পটেলকে দিয়ে। ‘‘সরকার হলেই তো হল। আসন ঠিক ক’টা হল, তাতে কী যায় আসে? আমাদের সরকার হচ্ছে, এটুকুই বলতে পারি। এর বাইরে কিছু বলব না।’’ বললেন হর্ষদ পটেল।
শাসক দলের আর এক নেতা ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় জানালেন, বেশ কয়েক জন ভিভিআইপি-র হেরে যাওয়ার আশঙ্কা যে রয়েছে, তা তাঁরা জানেন। উপমুখ্যমন্ত্রী নীতীন পটেল কি এ বার মেহসাণা থেকে জিততে পারবেন? বিজেপি নেতা অকপটে জানালেন, সম্ভবত জিততে পারবেন না।
কংগ্রেসের অবস্থা কেমন? সে-ও তথৈবচ। আসনসংখ্যা নিয়ে কোনও মন্তব্যই করতে চাইছেন না কংগ্রেস নেতারা। মিডিয়ার প্রশ্নের জবাবে শুধু বলছেন, ‘‘সরকার আমাদের হচ্ছেই।’’ কিন্তু আলাপচারিতা একটু ব্যক্তিগত স্তরে পৌঁছলে কণ্ঠস্বর কিছুটা নামিয়ে মিডিয়া কর্মীদেরই প্রশ্ন করছেন কংগ্রেসের কেউ কেউ— কী বুঝছেন বলুন তো? সরকার কি আমাদের হবে?
রাজ্য সরকারের সচিবালয়েও ঠিক এই রকম সংশয়ের ছাপই রয়েছে বলে খবর। সপ্তাহখানেক আগে বনসৃজন সংক্রান্ত একটি উচ্চপর্যায়ের বৈঠক হয় সচিবালয়ে। ভোট মরসুম বলে কথা। বৈঠক শেষে প্রশাসনিক কর্তারাও ভোটের ফলাফল সংক্রান্ত আলোচনায় মেতে উঠেছিলেন। তাঁদেরই এক জন জানালেন, প্রশাসনের অন্দরেও বেশ সংশয় রয়েছে। কয়েক জন অফিসার বিজেপির প্রত্যাবর্তন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন বলে খবর। বাকিরা দাবি করেছেন, আসনসংখ্যায় ফারাক বেশি থাকবে না, কিন্তু সরকার বেঁচে যাবে।
অমদাবাদে এক বুথে ভোট দিচ্ছেন হিন্দু সন্তরা। বৃহস্পতিবার। রয়টার্স।
প্রশাসনিক কর্তারা যে সংশয়ে রয়েছেন, সে দাবি হার্দিক পটেলও করলেন। একটি হিন্দি নিউজ চ্যানেলের সঙ্গে কথা বলার সময় বুধবার তিনি বললেন, ‘‘খবর পাচ্ছি, অফিসাররাও ভয়ে রয়েছেন। এই সরকার যে ফিরছে না, তা অনেকেই বুঝে গিয়েছেন। আমার কাছে খবর এসেছে, কিছু ফাইল নাকি সরিয়ে ফেলা হচ্ছে।’’
বুথ ফেরত সমীক্ষা প্রকাশিত হওয়ার পরে সংশয় কিছুটা কাটবে বলে আশা করা গিয়েছিল। কিন্তু আশাই সার। কংগ্রেস মুখপাত্র মিডিয়ার ফোন এড়িয়ে যেতে শুরু করেছেন। আর বিজেপি-র তরফে স্পষ্ট জানানো হচ্ছে, সমীক্ষা নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হবে না। মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপাণী বৃহস্পতিবার সাংবাদিক বৈঠক করলেন অমদাবাদে। বললেন, ‘‘জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করছি। তাঁরা আমাদেরই ভোট দিয়েছেন। বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়েই আমরা সরকার গড়ব।’’ কিন্তু ‘বিপুল গরিষ্ঠতা’ মানে ঠিক কী? ১০০ পার করা? নাকি আগের চেয়ে বেশি আসন? নাকি ‘১৫০ প্লাস’? এ প্রশ্নের কোনও উত্তর নেই মুখ্যমন্ত্রীর কাছে।
গুজরাত নির্বাচন নিয়ে সব খবর পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
আপাতদৃষ্টিতে লড়াই এ বার জোরদারই হল গুজরাতের ময়দানে। দু’পক্ষই প্রবল বিক্রমে পরস্পরকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ল। ভোটগ্রহণ শেষ। শুধু গণনার অপেক্ষা। কিন্তু এখনও কোনও পক্ষই যেন তেমন টগবগে নয় আত্মবিশ্বাসে।