ফাইল চিত্র।
আফগানিস্তানে তালিবানের আমিরশাহি কায়েম হলে কাশ্মীরের পরিস্থিতি যে উত্তপ্ত হবে, সেই আশঙ্কা প্রথম থেকেই করে আসছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তালিবানের মুখপাত্ররা যতই কাশ্মীর নিয়ে নিরপেক্ষ থাকার আশ্বাস দিন, দিল্লি তাতে বিশেষ আস্থা রাখতে পারছে না। বরং মঙ্গলবার কাশ্মীরকে ‘ইসলামের শত্রু’-দের কবল থেকে মুক্ত করার ডাক দিয়ে আল কায়দার বার্তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আশঙ্কাকেই পোক্ত করল। কাশ্মীরের মানুষ মনে করছেন, ওসামা বিন লাদেনের জঙ্গি সংগঠনের এই নির্ঘোষ কাশ্মীরকে আরও তপ্ত করে তুলবে। নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞদেরও আশঙ্কা— নিরাপত্তা যতই আঁটোসাঁটো করা হোক, জঙ্গি-সন্ত্রাস বাড়বে উপত্যকায়।
আল কায়দা তাদের বার্তায় আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনাদের চলে যাওয়াকে ‘জয়’ বলে ঘোষণা করে তালিবানকে জেহাদি অভিনন্দন জানিয়েছে। প্রার্থনা করেছে, ‘সোমালিয়া, ইয়েমেন, কাশ্মীরের মতো ইসলামি ভূখণ্ডকে ইসলামের শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করো’। যদিও এই প্রার্থনা করা হয়েছে আল্লা-র কাছে, কিন্তু অনেকের মনে করছেন, আদতে তালিবানকেই তাদের জেহাদি দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে আল কায়দা। তবে শীর্ষ তালিবান নেতা আনাস হক্কানি বুধবারও বলেছেন, “কাশ্মীর তো তালিবানের এক্তিয়ারের বাইরে। কাশ্মীর নিয়ে আমাদের কোনও কথা বলার নেই।”
বস্তুত, আফগানিস্তানে ২০ বছর আগের তালিবান শাহি কাশ্মীরি জঙ্গি সংগঠনগুলিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া ও পরিচালনার কাজে যথেষ্ট তৎপর ছিল। এ বিষয়ে তাদের সহযোগী ছিল পাকিস্তানি গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই। ভারতের নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কী ভাবে তালিবানের প্রশ্রয়ে ও প্রশিক্ষণে গড়ে ওঠে পাকিস্তানের মদতে পুষ্ট প্রধান দু’টি কাশ্মীরি জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তইবা এবং জইশ-ই-মহম্মদ। কাশ্মীরে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলির সমন্বয়কারী ‘মাল্টি এজেন্সিজ সেন্টার’ (ম্যাক)-এর এক কর্তার কথায়, “১৯৮৮ সালে আফগানিস্তানের কুনার প্রদেশে পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই লস্কর-ই-তইবার সংগঠন গড়ে তোলে। কাজেই তালিবানের সঙ্গে এই জঙ্গি গোষ্ঠীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। আবার জইশের প্রধান নেতা মৌলানা মাসুদ আজহার সম্প্রতি তালিবান শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করে কাশ্মীরের সন্ত্রাসে সহযোগিতার আর্জি জানিয়েছেন বলে খবর মিলেছে। তালিবানের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা আব্দুল গনি বরাদরের সঙ্গেও দেখা করেছেন মাসুদ।” নিরাপত্তা বাহিনী আফগানিস্তানের পরিস্থিতির উপরে কড়া নজর রাখার পাশাপাশি জম্মু ও কাশ্মীরে সন্ত্রাসের ঘাঁটিগুলির বিরুদ্ধে অভিযানকে জোরদার করেছে বলে জানিয়েছেন ম্যাক-এর এই কর্তা। জানিয়েছেন উপত্যকায় বিদেশি, বিশেষ করে আফগানদের গতিবিধির উপরে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। গোয়েন্দা জাল ছড়ানো হয়েছে সীমান্ত এলাকায়, যাতে তালিবান বা কোনও পাকিস্তানি জঙ্গি অনুপ্রবেশ করা মাত্র খবর পাওয়া যায়। মূলত দু’টি আশঙ্কা করছেন নিরাপত্তা বাহিনীর কর্তাব্যক্তিরা। প্রথমত, কাবুলে তালিবান শাহি কায়েম হওয়ায় কাশ্মীরে বিদেশি জঙ্গিদের অনুপ্রবেশ বাড়বে। দ্বিতীয়ত, আরও আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের চালান আসবে জঙ্গিদের কাছে। ২০১৫ থেকে একের এক নতুন নতুন অস্ত্রশস্ত্রে বলীয়ান হয়েছে কাশ্মীরি জঙ্গিরা। আধুনিক রাইফেল, নাইট ভিশন চশমা এবং বুলেটরোধী জ্যাকেটকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে এমন অস্ত্র ও শস্ত্র উদ্ধার হয়েছে জঙ্গিদের কাছ থেকে। সম্প্রতি ড্রোন ব্যবহার করে অস্ত্র সরবরাহের ঘটনা বেড়েছে। সামরিক ঘাঁটির মধ্যে বিস্ফোরণ ঘটানোর কাজেও ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে। সেনা বাহিনীর এক কর্তা জানাচ্ছেন, কাশ্মীরি জঙ্গিরা এখন অ্যাসল্ট কালাশনিকভ সিরিজের রাইফেলের বদলে আমেরিকায় তৈরি এম৪ কার্বাইন ব্যবহার করছে। ১৩ অগস্ট কুলগামে অভিযানের পরে নিহত পাক জঙ্গির কাছ থেকে মিলেছে চিনে তৈরি রকেট প্রপেলেড গ্রেনেড (আরপিজি) লঞ্চার ও তা থেকে ছোড়ার উপযোগী গ্রেনেড। ওই সেনা অফিসারের কথায়, “এক দশক আগেও ভাবা যেত না জঙ্গিদের হাতে আরপিজি লঞ্চার পাওয়া যাবে। এই অস্ত্র তাদের হাতে যাওয়ার অর্থ— সাঁজোয়া নয়, এমন কোনও গাড়ি আর নিরাপদ নয়।”
কাশ্মীরের বিশিষ্টরা আবার মনে করছেন, দু’বছর আগে উপত্যকা থেকে ৩৭০ অনুচ্ছেদ তুলে নেওয়া ও তার পর কেন্দ্রশাসিত কাশ্মীরে সাধারণ মানুষের অধিকার লঙ্ঘনের একটার পর একটা ঘটনায় এমনিতেই এখানকার মানুষ ক্ষুব্ধ। নিজেদের অবিচারের শিকার বলে মনে করেন কাশ্মীরিরা। কলেজে সাংবাদিকতার শিক্ষক শামিম জাভেদ বলেন, “গত দু’বছরে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদের অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার হারিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে। সাংবাদিকদের হেনস্থা ও নির্যাতনের মুখে পড়তে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কাশ্মীরি যুবকেরা তালিবানের সাফল্যকে নিজেদের সাফল্য বলে মনে করতেই পারেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুর আহমেদ বাবা আবার আশাবাদী। তাঁর কথায়, “আফগানিস্তানে তালিবান ক্ষমতায় আসার পরে কাশ্মীর নিয়ে চাপ বাড়বে সব পক্ষের উপরেই। এই পরিস্থিতিতে ফের আলোচনার টেবিলে ফিরতে পারে ভারত ও পাকিস্তান।” তবে ভূস্বর্গে তালিবান সন্ত্রাসের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন না বাবা। (তথ্য সহায়তা: সাবির ইবন ইউসুফ)