Coronavirus

মধ্যরাতে আসরে ডোভাল, পুলিশ-গোয়েন্দা যৌথ অভিযানে খালি করা হল নিজামউদ্দিন

মরকজ চত্বরে যত জন ছিলেন, সকলকে বার করে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দিল পুলিশ।

Advertisement

বিশেষ প্রতিবেদন

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ এপ্রিল ২০২০ ১৬:২৪
Share:

অজিত ডোভালের সঙ্গে মরকজ নিজামউদ্দিনের মওলানার সাক্ষাৎ। ছবি: পিটিআই

বড়সড় অভিযান চালানো হল দিল্লির মরকজ নিজামউদ্দিনে। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভালের নেতৃত্বে দিল্লি পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিল করে দিল বড় এলাকা। মঙ্গলবার মধ্যরাত থেকে বুধবার সকালের মধ্যে পুরোপুরি খালি করে দিল মরকজ চত্বর। সেখানে যত জন ছিলেন, সকলকে বার করে নিয়ে গিয়ে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দিল পুলিশ। মরকজ চত্বরে বেশ কিছু কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলেও দিল্লি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে।

Advertisement

মঙ্গলবার মধ্যরাতেই মরকজ নিজামউদ্দিনে গিয়েছিলেন অজিত ডোভাল। বড়সড় বাহিনী এবং গোয়েন্দা কর্তাদের নিয়ে ডোভাল কেন মাঝরাতে মরকজে হাজির হলেন, তা নিয়ে জোর জল্পনা ছড়াতে শুরু করেছিল। নিজামউদ্দিন রেলওয়ে স্টেশন থেকে ডিফেন্স কলোনি পর্যন্ত একটা বড় এলাকাকে প্রথমে সিল করে দেওয়া হয় ডোভালের নির্দেশে। এর ফলে লাটিয়েন’স দিল্লি থেকে বিচ্ছিন হয়ে পড়ে দক্ষিণ দিল্লির লাজপত নগর বা চিত্তরঞ্জন পার্কের মতো এলাকা। স্থানীয়দের অনেকেই প্রথমে ভেবেছিলেন, গোটা এলাকায় জীবাণুনাশক ছড়ানো হবে। ডোভাল যে পুরো মরকজ চত্বর খালি করে দেওয়ার অভিযানে নেমেছেন, তা কেউ আঁচ করতে পারেননি।

বুধবার সকাল থেকে অভিযানের রূপরেখা স্পষ্ট হতে শুরু করে। এলাকা সিল হয়ে থাকায় সে ভাবে কেউ রাস্তায় বেরনোর সুযোগ পাননি। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে চোখ রেখে দিল্লিবাসী বুঝতে পারেন, জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার নেতৃত্বে কী ধরনের অভিযান চালানো হয়েছে।

Advertisement

আরও পড়ুন: বেলঘরিয়ার করোনা আক্রান্তের মৃত্যু, অত্যন্ত সঙ্কটে নয়াবাদের বাসিন্দা

গোটা এলাকায় জীবাণুনাশক ছড়ানো হচ্ছে। ছবি: পিটিআই।

মরকজ নিজামউদ্দিনের যাঁরা শীর্ষ মৌলানা, মঙ্গলবার রাতে তাঁদের সঙ্গেই সর্বাগ্রে যোগাযোগ করেন অজিত ডোভাল। মরকজ নিজামউদ্দিনে জমায়েতের জেরে যে ঘটনা ঘটে গিয়েছে এবং যত জন ইতিমধ্যেই সেখান থেকে সংক্রামিত হয়েছেন, তার প্রেক্ষিতে আর কোনও ঝুঁকি নেওয়া যাবে না বলে মৌলানাদের জানান ডোভাল। যাঁরা তখনও মরকজে রয়েছেন, তাঁদের অবিলম্বে বার করে নিয়ে গিয়ে আইসোলেশনে পাঠাতে হবে, প্রত্যেককে পরীক্ষা করাতে হবে এবং প্রয়োজনে চিকিৎসা শুরু করাতে হবে— জানান ডোভাল। মরকজ নিজামউদ্দিন খালি করে দেওয়ার পরে স্বাস্থ্য দফতর গোটা চত্বরকে জীবাণুমুক্ত করবে বলেও মৌলানাদের জানান ডোভাল।

জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার কথা মৌলানারা মেনে নেন বলেই খবর। প্রশাসনিক অভিযানে তাঁরা সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেন। তার পরেই দিল্লি পুলিশ মরকজ নিজামউদ্দিন খালি করতে শুরু করে দেয়।

অজিত ডোভাল আসরে নামার আগেও কিন্তু পুলিশ-প্রশাসন এই কাজটাই করতে চেয়েছিল। কিন্তু তবলিগি জামাতের নেতৃত্ব সহযোগিতা করতে রাজি হননি। সংগঠনের প্রধান মৌলানা সাদ জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, তিনি মরকজ খালি করতে দেবেন না। তার পরেই ডোভালকে ময়দানে নামান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। রাত ২টো নাগাদ মরকজ নিজামউদ্দিনে যান ডোভাল। মৌলানা সাদের সঙ্গে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা নিজে কথা বলেন এবং মরকজ খালি করার প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে সক্ষম হন। তার পরেই দিল্লি পুলিশ মরকজ খালি করার কাজ শুরু করে দেয়।

মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও যাঁরা মরকজে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের বার করে নিয়ে গিয়ে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তাঁদের শারীরিক পরীক্ষা শুরু হয়। যাঁরা ইতিমধ্যেই অসুস্থ, তাঁদের প্রাথমিক চিকিৎসাও শুরু হয়ে গিয়েছে। করোনা পরীক্ষার রিপোর্ট যদি পজিটিভ আসে, তা হলে তৎক্ষণাৎ তার চিকিৎসা শুরু করার প্রস্তুতিও রাখা হচ্ছে।

আরও পড়ুন: আমেরিকায় আড়াই লক্ষের মৃত্যুর আশঙ্কা, ফ্রান্সে এক দিনে মৃত ৪৯৯: করোনা আপডেট

মরকজ নিজামউদ্দিন চত্বরে পুলিশ বেশ কিছু কাঠামো এ দিন ভেঙে দিয়েছে বলেও খবর পাওয়া গিয়েছে। তবলিগি জামাতের যে ধর্মীয় সমাবেশের জন্য মরকজে প্রায় সাড়ে তিন হাজার লোকের জমায়েত হয়েছিল, সেই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১২ থেকে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। যাঁরা সমাবেশে যোগ দিতে গিয়েছিলেন, তাঁদের নানা প্রয়োজন মেটানোর জন্য কিছু অস্থায়ী কাঠামো গড়তে হয়েছিল মরকজ নিজামউদ্দিন চত্বরে। অনেকগুলো দিন ধরে একসঙ্গে কয়েক হাজার লোকজন জমায়েত করে থাকায় বেশ কিছু আবর্জনাও জমেছিল সেখানে। সেই সব আবর্জনা সরাতে এবং মরকজ চত্বরকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করার কাজ মসৃণ করতেই পুলিশ ওই সব কাঠামো ভেঙে দিয়ছে বলে খবর।

মরকজ নিজামউদ্দিন এলাকায় চিকিৎসা শুরু করার প্রস্তুতি। ছবি: পিটিআই।

পুলিশি অভিযান শেষ হতেই স্বাস্থ্য দফতরের কর্মীরা মরকজে ঢোকেন। জল দিয়ে ধুয়ে ফেলা হয় মসজিদ, দরগাহ-সহ গোটা মরকজ চত্বর। পুরোটাতেই জীবাণুনাশক ছেটানো হয়। ছড়িয়ে দেওয়া হয় ব্লিচিং পাউডার। আপাতত মরকজ চত্বরে কাউকে থাকতে দেওয়া হবে না— জানিয়েছে প্রশাসন। সেখানকার মসজিদে আপাতত নমাজের জমায়েতও হবে না বলে প্রশাসন জানিয়েছে। শুক্রবারের নমাজও নয়।

কিন্তু ১২ থেকে ১৫ মার্চ মরকজ নিজামউদ্দিনে অত বড় জমায়েত কী ভাবে করল তবলিগি জামাত, তা নিয়েও কিন্তু প্রশ্ন উঠছে। তবলিগ নেতৃত্বের ভূমিকা প্রশ্নের মুখে তো বটেই, গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগও উঠেছে।

মার্চের প্রথম সপ্তাহেই জমায়েত না করার বিষয়ে সতর্ক করতে শুরু করেছিল কেন্দ্রীয় সরকার। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হোলি খেলবেন না বলে জানিয়েছিলেন। দেশবাসীকেও হোলিতে জমায়েত না করার বার্তাই দিয়েছিলেন। প্রায় সব বড় বড় মন্দিরের দরজা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। পরীক্ষা স্থগিত করা হচ্ছিল, স্কুল-কলেজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছিল। লকডাউন তখনও ঘোষিত হয়নি। কিন্তু জমায়েত যে এড়াতেই হবে, সে বার্তা গোটা দেশেই তখন ছড়িয়ে গিয়েছে। তার পরেও তবলিগি জামাত অত বড় জমায়েত কেন করল? কেন পিছিয়ে দেওয়া হল না কর্মসূচি? প্রশ্ন উঠেছে বিভিন্ন মহলে।

আর জমায়েতের বিরুদ্ধে যখন গোটা দেশে সতর্কবার্তা জারি করা হচ্ছে, তখন রাজধানীর বুকে অত বড় জমায়েত অত দিন ধরে যে চলবে বা চলছে, তা কেন প্রশাসন জানতে পারল না, সে প্রশ্নও উঠছে। দেশের ১৮টা রাজ্য থেকে লোকজন হাজির হচ্ছিলেন নিজামউদ্দিনে। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশ থেকেও লোকজন দিল্লিতে ঢুকছিলেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সদর দফতর নর্থ ব্লকের নাকের ডগায় তাঁরা সবাই জড়ো হচ্ছিলেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কোনও নজরই কি ছিল না সে দিকে? এই প্রশ্নও উঠছে। ফলে বড়সড় গোয়েন্দা ব্যর্থতার অভিযোগও সামনে আসছে।

মঙ্গলবার রাত পর্যন্তও যাঁরা মরকজে থেকে গিয়েছিলেন, তাঁদের বার করে নিয়ে গিয়ে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। তাঁদের শারীরিক পরীক্ষা শুরু হয়। ছবি: পিটিআই।

তবে বিলম্বে হলেও বোধোদয় হয়েছে প্রশাসনের। ডোভালের নেতৃত্বে হওয়া অভিযানে এ দিন মরকজ থেকে যাঁদের বার করা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে ২১৬ জন বিদেশি নাগরিক রয়েছে বলে খবর। কিন্তু দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এই মুহূর্তে আরও প্রায় ৮০০ জন মরকজফেরত বিদেশি নাগরিক ছড়িয়ে পড়েছেন বলে গোয়েন্দা সূত্রে জানা যাচ্ছে। তাঁদের অবিলম্বে খুঁজে বার করে আইসোলেশনে পাঠানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে ওই বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে আরও কঠোর পদক্ষেপ করা হবে বলে খবর। বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া থেকে যাঁরা মরকজে গিয়েছিলেন, তাঁরা ভিসার আবেদনে নিজেদের পরিচয় দিয়েছিলেন পর্যটক হিসেবে। ধর্মপ্রচারের কাজে এলে ভিসার আবেদনে ‘ধর্মপ্রচারক’ পরিচয়ই দিতে হবে, নিয়ম তেমনই। তথ্য গোপন করে ভারতে ঢোকার ভিসা নেওয়ার অপরাধে ওই বিদেশি নাগরিকদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করা হতে পারে বলে জানা যাচ্ছে। তাঁরা কালো তালিকাভুক্ত হতে পারেন। সে ক্ষেত্রে পরবর্তী কালে আর কখনও ভারতে ঢোকার ভিসা পাবেন না।

(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement