সেনাবাহিনীর শীর্ষ স্তরে দুর্নীতি নিয়ে তদন্ত, রাজনীতির চাপানউতোর ও কর্পোরেট যুদ্ধ। তিনটেকেই মিলিয়ে দিল অগুস্তা-দুর্নীতির তদন্ত! ভিভিআইপিদের জন্য হেলিকপ্টার কেনা নিয়ে এই দুর্নীতির তদন্তে প্রাক্তন বায়ুসেনা-প্রধান এস পি ত্যাগী গ্রেফতার হতেই সিবিআইয়ের নজরে ফের উঠে এসেছে মনমোহন সিংহের জমানা। শুধু তা-ই নয়, অপসারিত টাটা কর্তা সাইরাস মিস্ত্রি অগুস্তা দুর্নীতির অভিযোগের সঙ্গে জড়িয়ে দিলেন টাটা সন্সের ডিরেক্টর বিজয় সিংহের নামও!
সিবিআই সূত্রের দাবি, অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড সংস্থার কাছ থেকে হেলিকপ্টার কেনার সিদ্ধান্তের সঙ্গে জড়িত ছিল প্রধানমন্ত্রীর দফতরও। ফলে তখন যাঁরা ওই দফতরে ছিলেন, সেই অফিসারদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা জরুরি। কংগ্রেসের আশঙ্কা, নোট বাতিলের জেরে মানুষের যে ভোগান্তি চলছে, তা থেকে নজর ঘোরাতে ইউপিএ জমানার অফিসারদের শুধু নয়, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী খোদ মনমোহন সিংহকেও জড়ানোর চেষ্টা হতে পারে। তাই অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ড কপ্টার কেনার বরাত দেওয়া নিয়ে দুর্নীতির তদন্তে মনমোহন জমানার আমলাদের জিজ্ঞাসাবাদের খবর ছড়িয়ে পড়তেই মোদীর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ এনে আজ সরব হয় কংগ্রেস।
এরই মধ্যে আর এক বোমা ফাটান টাটা সন্সের বরখাস্ত চেয়ারম্যান সাইরাস মিস্ত্রি। তিনি অভিযোগ করেন, অগুস্তা-দুর্নীতিতে জড়িত ছিলেন টাটা সন্সের ডিরেক্টর বিজয় সিংহ। মনমোহনের জমানায় প্রতিরক্ষা সচিব ছিলেন বিজয়। সন্দেহ নেই, সাইরাসের এই মন্তব্য টাটা সন্স নিয়ে রতন টাটা বনাম সাইরাস মিস্ত্রিদের কর্পোরেট যুদ্ধ আজ নয়া মাত্রা নিল। বিজয়ের দাবি, ‘‘সাইরাসের এই অভিযোগ কুৎসা ছাড়া কিছুই নয়। আমার অবসরের পরে মন্ত্রিসভা অগুস্তা কপ্টারের বরাতের বিষয়টি চূড়ান্ত করেছিল।’’
কংগ্রেসের অভিযোগ, মানুষের নজর ঘোরাতে সিবিআইকে ব্যবহার করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দলের মুখপাত্র টম ভড়াক্কনের কথায়, ‘‘নোট বাতিলের ফলে মানুষের ভোগান্তি চরমে। রাহুল গাঁধী তো বলেছেন, এই নোট বাতিলই দেশের সব থেকে বড় দুর্নীতি। সেখান থেকে নজর সরাতেই যে মনমোহনকে কপ্টার-দুর্নীতিতে জড়ানোর চেষ্টা হবে, সেটা আমাদের জানাই ছিল। সেই কারণেই মোদী তাঁর বশংবদ অফিসারকে সিবিআইয়ের শীর্ষপদে অস্থায়ী দায়িত্ব দিয়ে বসিয়েছেন।’’
সিবিআই সূত্রের যুক্তি, প্রথমে সিয়াচেন হিমবাহের কথা ভেবে ৬ হাজার মিটার উচ্চতায় উড়তে পারে এমন কপ্টার কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু পরে তা সাড়ে ৪,৫০০ মিটার করা হয়। অভিযোগ, অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডকে বরাত পাইয়ে দিতেই এই বদল করা হয়েছিল। এবং এর জন্য প্রায় ৩৬২ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছিল সংস্থাটি। এর মধ্যে ভারতে আসে ১৩৮ কোটি টাকা। তা থেকে ৭৬ কোটি টাকা ত্যাগী ও তাঁর ভাইরা পেয়েছেন বলে অভিযোগ। গ্রেফতারের পর ত্যাগী আদালতে দাবি করেছেন, মাপকাঠি বদলের সিদ্ধান্ত তিনি একা নেননি। কেন্দ্রীয় সরকারের একাধিক দফতর মিলে এই সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রীর দফতরও তার অংশীদার ছিল।
কিন্তু সেটা কোন প্রধানমন্ত্রীর দফতর?
কংগ্রেস নেতা অভিষেক মনু সিঙ্ঘভির বক্তব্য, ‘‘ত্যাগী বিশেষ কোনও প্রধানমন্ত্রীর নাম করেননি। তিনি বলেছেন, এটা ছিল সরকারের সামগ্রিক সিদ্ধান্ত।’’ কংগ্রেস নেতারা এ-ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন, কপ্টারের মাপকাঠি বদলের সিদ্ধান্ত হয় অটলবিহারী বাজপেয়ীর জমানায়। তৎকালীন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা তথা বাজপেয়ীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি, প্রয়াত ব্রজেশ মিশ্র ওই সিদ্ধান্ত নেন। পরে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, প্রতিরক্ষা মন্ত্রক এবং এসপিজি সেই সিদ্ধান্ত কার্যকর করে।
অগুস্তা তদন্তে নেমে সিবিআই দু’বছর আগেই মনমোহন জমানার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা এম কে নারায়ণনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। তবে অভিযুক্ত হিসেবে নয়। সাক্ষী হিসেবে। সে সময় তিনি পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন। একই ভাবে মনমোহন জমানার এসপিজি প্রধান ভারতবীর ওয়াঞ্চুকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সিবিআইয়ের একটি সূত্র বলছে, জিজ্ঞাসাবাদের সময় নারায়ণন জানিয়েছেন, হেলিকপ্টারের উচ্চতার মাপকাঠি কমিয়ে আনার সিদ্ধান্ত হয় বাজপেয়ীর জমানায়। ২০০৩
সালে। কোন যুক্তিতে ব্রজেশ মিশ্র উচ্চতা কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তা-ও ব্যাখ্যা করেন নারায়ণন। তা হল, মাত্র একটি সংস্থাই ৬ হাজার মিটার উচ্চতায় ওড়ার
মতো হেলিকপ্টার সরবরাহ করতে পারবে বলে জানিয়েছিল। স্বচ্ছতা রাখতে ও অন্যদের সুযোগ করে দিতেই উচ্চতার শর্ত শিথিল করে ৪,৫০০ মিটার করা হয়।
তবে এমন অভিযোগও উঠেছে যে, রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রী বা অন্য ভিভিআইপিদের ৬ হাজার মিটার উচ্চতায় যাওয়ার প্রয়োজনই পড়ে না বলেও যুক্তি দেওয়া হয়েছিল সে সময়। সে কারণেও মাপকাঠি কমিয়ে ৪,৫০০ মিটার করা হয়েছিল। তাতেও প্রশ্ন থাকে, সিয়াচেনের উচ্চতা ৫,৪০০ মিটার। প্রতিরক্ষামন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে সেখানে যেতে হলে অগুস্তা-ওয়েস্টল্যান্ডের হেলিকপ্টার কাজেই আসত না। তবে কেন শিথিল করা হল মাপকাঠি?
মনমোহন-ঘনিষ্ঠ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী কে টি এস তুলসী অবশ্য এই চাপানউতোরকে আমল দিতে রাজি নন। তাঁর কথায়, ‘‘কখন কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা রেকর্ডেই রয়েছে। এখন কোনও অভিযুক্ত যদি কারও নাম করে এবং তা যদি রেকর্ডের উল্টো কথা হয়, সেটা অর্থহীন। কিন্তু এর পিছনে যদি সরকারের খেলা থেকে থাকে, তা হলে সরকারের জন্য আমার করুণা হয়।’’