তৃণমূল সাংসদদের জোর করে বাসে তুলছে দিল্লি পুলিশ। —নিজস্ব চিত্র।
কখনও দিল্লি পুলিশের সঙ্গে লুকোচুরি, কখনও গেরিলা যুদ্ধ! তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছকে দেওয়া কৌশলে আজ লুটিয়েন্স দিল্লিতে যেন এক টোটাল ফুটবল খেলল তৃণমূলবাহিনী।
গত কাল প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছনোর এক কিলোমিটার আগেই আটক হয়ে যেতে হয়েছিল মমতার সাংসদদের। আর তাই আজকের অভিযানের নিশানা যে সাউথ ব্লকে খোদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেই তাসটা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আস্তিনে গুটিয়ে রাখার নির্দেশ দিয়েছিলেন মমতা। উদ্দেশ্য একটাই, নরেন্দ্র মোদী প্রশাসন যেন ঘুণাক্ষরেও পরিকল্পনা আগাম জানতে না পারে। দিনের শেষে সৌগত রায়, ডেরেক ও’ব্রায়েনরা দাবি করছেন, সেই উদ্দেশ্য সফল।
তবে আজ এক এক করে তিনটি ‘বুম বেরিয়ার’ পেরিয়ে যে ভাবে ‘হারেরেরে’ করে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের প্রায় দোরগোড়ায় পৌঁছে গেলেন তৃণমূলীরা, তাতে এই ভিভিআইপি-এলাকার সুরক্ষা ব্যবস্থা নিয়েও একটি বড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হল। প্রধানমন্ত্রী অবশ্য সেই সময়ে ছিলেন পটনায়। রাতে ফিরে তিনি বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহের সঙ্গে কথা বলেন। কেন নিরাপত্তা এ ভাবে লঙ্ঘিত হল, তা নিয়ে ক্ষুব্ধ মোদী রিপোর্ট চেয়েছেন মন্ত্রকের কাছে।
তৃণমূল সূত্রের খবর, আজ সকালে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের চারপাশ নিঃশব্দে ‘রেকি’ করে এসেছিলেন দলের লোকসভা এবং রাজ্যসভার দুই সাংসদ। সাংসদের স্টিকারহীন অন্য গাড়িতে গিয়ে, চারদিকের নিরাপত্তা প্রস্তুতি, মহিলা পুলিশের সংখ্যা খতিয়ে দেখে ‘ফাঁকফোঁকর’ বুঝে এসেছিলেন। এর পর সকালে গোটা তৃণমূল বাহিনী হাজির হয় লোধি এস্টেটে দীনেশ ত্রিবেদীর বাড়িতে। জনা তিরিশ সাংসদকে সবুজ লনে গা এলিয়ে চা এবং প্রাতরাশ খেতে দেখে কিছুটা নিশ্চিন্ত হয় সামনে আগাগোড়া দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ ভ্যান। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকও ধরে নেয়, গত কাল যা হওয়ার হয়েছে। আজ আর কোনও হাঙ্গামা করবে না তৃণমূল। এই ভাবনাকে আরও গুলিয়ে দিতেই দ্বিতীয় কৌশল নেন ডেরেক, সৌগত, দীনেশরা। সংবাদমাধ্যম-সহ সংশ্লিষ্ট মহলে একটি প্রচার সূক্ষ্ম ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় যে, সিজিও কমপ্লেক্সে সিবিআই-এর সদর দফতরে ধর্না দিতে যেতে পারেন তৃণমূল সাংসদেরা। সেই ভাবেই প্রস্তুতি নেয় পুলিশ। কিন্তু যত ক্ষণ না দীনেশের বাড়ি থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসেন, বাইরে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পুলিশের গাড়ি। এ বার কৌশল নম্বর তিন। ঠিক হয়, দীনেশের বাড়ি থেকে সরাসরি যাওয়া হবে সংসদে তৃণমূলের দলীয় অফিসে। সংসদ ভবন পর্যন্ত তৃণমূল সাংসদদের পিছু ধাওয়া করার পরে স্বাভাবিক ভাবেই সরে যায় দিল্লি পুলিশ। সাংসদেরা নিশ্চিন্তে ঢুকে যান সংসদের নিজস্ব নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। কাপের পর কাপ চা-কফি খেয়ে তাঁরা কাটান আরও ঘণ্টা দেড়-দুই। তাঁদের মতিগতি বুঝতে না পেরে শিথিল হয়ে আসে পুলিশের নজরদারিও।
সংসদের গেট থেকে সাউথ ব্লকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে গাড়িতে পৌঁছতে সময় লাগে মিনিট তিনেক। বিকেল পৌনে তিনটে নাগাদ বেশ কয়েকটি গাড়িতে ভাগ হয়ে আচমকা হুড়মুড় করে সেখানে এসে পড়েন তৃণমূলীরা। সৌগত প্রথম গাড়িতে সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন মহিলা সাংসদদের। দোলা সেন, কাকলি ঘোষদস্তিদার, শতাব্দী রায়দের সামনে রেখে হতচকিত সিআরপি জওয়ানদের ফুটবলের কায়দায় ‘কাটিয়ে’ একের পর এক ‘বেরিয়ার’ টপকাতে থাকেন তিরিশ জন সাংসদ! মুখে স্লোগান— ‘মোদী হঠাও দেশ বাঁচাও’। আগে থেকে খবর না থাকায়, না ছিল এই ঝড় সামাল দেওয়ার মতো যথেষ্ট নিরাপত্তা বাহিনী, না ছিল মহিলা পুলিশ। দোলার কথায়, ‘‘তৃতীয় বাধাটি টপকানোর সময়ে এক জন সশস্ত্র পুলিশকর্মী আপত্তিকর ভাবে গায়ে হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করে। আমি দু’বার বারণ করার পরেও কাজ হচ্ছে না দেখে তার গালে প্রবল চড় কষাই!’’ এর মধ্যে শতাব্দী এবং কাকলি নিচু হয়ে পেরিয়ে যান তৃতীয় বাধা।
কার্যত রণক্ষেত্রে পরিণত হয় প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনের গেট। জরুরি ভিত্তিতে পৌঁছয় মহিলা পুলিশ-সহ আরও বাহিনী। আনা হয় বাস। ধাক্কা দিতে দিতে সাংসদদের তোলা হয় তাতে। গত কালই ধাক্কাধাক্কিতে আহত হয়েছিলেন সৌগত, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনুপম হাজরা-সহ কিছু সাংসদ। তাঁদের অভিযোগ, বাসে তোলার সময়ে আজও বলপ্রয়োগ করা হয়েছে। দুর্ব্যবহার করা হয়েছে মহিলা সাংসদদের সঙ্গে। অনুপমের হাতে ছিল ব্যান্ডেজ, প্রসূন খোঁড়াচ্ছিলেন। আটক করে সবাইকে নিয়ে যাওয়া হয় মন্দির মার্গ থানায়। সাংসদ তথা চিকিৎসক কাকলির বক্তব্য, ‘‘নিয়মিত ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট খাই তাই রক্ষা, না হলে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতাম না!’’ গত কাল থেকে অক্লান্ত চেঁচিয়ে গলা বসে গিয়েছে ইদ্রিশ আলি, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র খান-দের। সেই ভাঙা গলাতেই আরও দেড় ঘণ্টা থানা চত্বরে স্লোগান দেন তাঁরা। এর পর ছেড়ে দেওয়া হয় তাঁদের।
আপাতত তিন দিন যুদ্ধবিরতি। সোমবার থেকে তিন দিনের জন্য সমস্ত তৃণমূল সাংসদকে ফের হাজির থাকতে বলা হয়েছে দিল্লিতে। ডেরেকের কথায়, ‘‘আমরা মোদীর বিরুদ্ধে রাজধানীতে এই আন্দোলন লাগাতার চালিয়ে যাব।’’ আন্দোলনের রূপরেখা কী হবে
তা এখনই ফাঁস করতে চাইছেন না তাঁরা। রণক্লান্ত সাংসদেরা আপাতত ফিরছেন পশ্চিমবঙ্গে।