সরকারকে বিঁধেও সৌজন্য প্রাক্তনের

দুপুরে ঝাঁঝালো সমালোচনায় বিদ্ধ করলেন বছর পেরোনো নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। তার পর বিকেলে মোদীর বাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে এলেন মনমোহন সিংহ। এতে কি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা ঝাঁঝ হারালো না? মনমোহনকে ‘শিখণ্ডি’ প্রধানমন্ত্রী বলে সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সনিয়া ও রাহুল গাঁধীকে আক্রমণ করার যে কৌশল বিজেপি নিয়েছে, মনমোহন কি সেই ফাঁদেই পা দিলেন না?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৮ মে ২০১৫ ০৩:২১
Share:

প্রাক্তন ও বর্তমান। মনমোহন সিংহ এবং নরেন্দ্র মোদী। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে। ছবি: পিটিআই।

দুপুরে ঝাঁঝালো সমালোচনায় বিদ্ধ করলেন বছর পেরোনো নরেন্দ্র মোদীর সরকারকে। তার পর বিকেলে মোদীর বাড়িতে গিয়ে চা খেয়ে এলেন মনমোহন সিংহ।

Advertisement

এতে কি প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনা ঝাঁঝ হারালো না? মনমোহনকে ‘শিখণ্ডি’ প্রধানমন্ত্রী বলে সংবিধান বহির্ভূত ক্ষমতা প্রয়োগের জন্য সনিয়া ও রাহুল গাঁধীকে আক্রমণ করার যে কৌশল বিজেপি নিয়েছে, মনমোহন কি সেই ফাঁদেই পা দিলেন না?

কংগ্রেস অবশ্য এর কোনওটিই মানছে না। মনমোহন সিংহের দফতর থেকে রাতে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিদেশ ও অর্থনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীই আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মনমোহন সিংহ সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করে সৌজন্য দেখিয়েছেন মাত্র।’ কংগ্রেস নেতৃত্ব বলছেন, গণতন্ত্রে সৌজন্য চিরাচরিত প্রথা। সেই প্রথা মেনেই এক বছর আগে নির্বাচনী সাফল্যের জন্য মনমোহন সবার আগে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন মোদীকে। শপথ নেওয়ার আগে মোদীও মনমোহনের বাসভবনে এসে তাঁর সঙ্গে দেখা করে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া শুধু দু’বারের প্রধানমন্ত্রীই নন, অর্থনীতিবিদ হিসেবেও আন্তর্জাতিক খ্যাতি রয়েছে মনমোহন সিংহের। সুতরাং মোদীর আমন্ত্রণ রক্ষা করে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেই সরকারের কাজকর্ম নিয়ে তাঁর কঠোর সমালোচনা গুরুত্ব হারায় না।

Advertisement

সরকারের বর্ষপূর্তিতে গত কাল জাতির উদ্দেশে খোলা চিঠি লিখেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তাঁর দাবি ছিল, এক বছরেই দেশের অর্থনীতির হাল অনেকটা ফেরাতে পেরেছে তাঁর সরকার। কিন্তু ২৪ ঘণ্টা না কাটতে সরকারের প্রথম বর্ষপূর্তির সেই বেলুন আজ চুপসে দিতে চাইলেন প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁরই পূর্বসূরি!

মনমোহন আজ বলেন— সবই যে ভাল হচ্ছে তা নয়! বিনিয়োগ আসছে না। রফতানির হার নিম্নগামী। মন্দা থেকে অর্থনীতিকে বার করে আনার চেষ্টাও নড়বড়ে। এমনকী গ্রামের মানুষও সরকারের কাজে অসন্তুষ্ট।
এই রূঢ় বাস্তব থেকে মুখ ঘোরাতেই বার বার আগের সরকারের দুর্নীতির প্রসঙ্গ উছলে দিচ্ছে সরকার। তার আড়ালে যাবতীয় ব্যর্থতা ঢাকতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী।

প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়ে সচরাচর প্রকাশ্যে মুখ খুলতেন না মনমোহন। প্রধানমন্ত্রী পদে তাঁর মেয়াদ শেষের পর তা এখন আরও কমে গিয়েছে। কিন্তু কংগ্রেস সূত্র জানাচ্ছে, মনমোহনকে এখনও মোদী-বিরোধিতায় ব্যবহার করতে আগ্রহী সনিয়া-রাহুল। বিশেষ করে রাহুল চাইছিলেন, মোদী সরকারের বর্ষপূর্তিতে অর্থনীতির প্রশ্নে মুখ খুলুন মনমোহন। কারণ তাতে শুধু ঘরোয়া রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়া হবে না, আন্তর্জাতিক স্তরেও সেই বার্তা পৌঁছবে ও গুরুত্ব দিয়ে দেখা হবে।

শুধু মনমোহন কেন, রাজনীতির পর্যবেক্ষকরাও বলছেন— দুর্নীতিমুক্ত শাসন কায়েম করাকেই প্রথম বছরের প্রধান সাফল্য বলে তুলে ধরতে চাইছে সরকার। গত সাত দিনে মোদী-জেটলি-অমিত শাহরা বার বার সেই কথাটাই তুলে ধরে ইউপিএ সরকারের সঙ্গে তাঁদের ফারাক বোঝাতে চেয়েছেন। এমনই পরিস্থিতিতে গত কাল শাসক দলকেও আরও সুবিধা করে দেন ট্রাইয়ের প্রাক্তন কর্তা প্রদীপ বৈজল। স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারির জন্য কার্যত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে সরাসরি দায়ী করেন তিনি। আর তা হাতিয়ার করে আরও এক বার আগের সরকারের ওপরে দুর্নীতির কালি লেপতে নেমে পড়েন অমিত শাহরা।

এই পটভূমিকাতেই আজ মুখ খুলেছেন মনমোহন। কংগ্রেস আগেই দাবি করেছিল, বৈজলের অভিযোগের বিষয়টি সাজানো। আসলে বিজেপির হাতে তামাক খাচ্ছেন প্রাক্তন এই ট্রাই কর্তা। আর মনমোহন আজ বলেন, ‘‘বিনয়ের সঙ্গে জানাচ্ছি, প্রধানমন্ত্রীর দফতরকে আমার ব্যক্তিগত সমৃদ্ধির জন্য কখনও ব্যবহার করিনি। পরিবার বা বন্ধুদের জন্যও ব্যবহার করিনি। কিন্তু প্রকৃত সমস্যা থেকে মানুষের দৃষ্টি ঘোরাতে বিজেপি সেই দুর্নীতির ফাটা রেকর্ডই বাজিয়ে চলেছে।’’

“বিনিয়োগ নেই। কৃষি উৎপাদন কমছে। গ্রামের মানুষই যদি সরকারে অখুশি, সেটা ভাল বলা যায় কি!”

মনমোহন সিংহ

“এক বছর পরেও কংগ্রেস তাদের শোচনীয় হার হজম করতে পারছে না। এখনও তারা উন্নয়নের বিরোধী।”

নরেন্দ্র মোদী

তা হলে প্রকৃত সমস্যা কী?

মোদী সরকারকে বিঁধতে চেয়ে মনমোহন বলেন, ‘‘বিনিয়োগ বাড়ছে না। রফতানি কমছে। কৃষি উৎপাদন কমছে। দেশ জুড়ে গ্রামের মানুষ দুর্দশায় রয়েছেন। অথচ দেশের ৬৫ শতাংশ মানুষই গ্রামে বাস করেন। তাঁরাই যদি সরকারের কাজে অখুশি হন, তা হলে সেটা ভাল বলা যায় কি!’’ মনমোহনের মতে, বর্তমান সরকার দ্রুত বৃদ্ধির নামে কল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাটাও ভেঙে ফেলতে চাইছে। অথচ জলকল্যাণ ও আর্থিক বৃদ্ধি একই মুদ্রার দুই পিঠ! সন্দেহ নেই এ কথা বলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক প্রকল্পে বিপুল বরাদ্দ ছাঁটাইয়ের দিকেই আঙুল তুলছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী।

মোদী সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রচার নিয়েও তীব্র কটাক্ষ ছুঁড়ে দিয়েছেন মনমোহন। তিনি বলেন, ‘‘বর্তমান সরকারের এই প্রচার ইউপিএ জমানার কর্মসূচিরই কার্বন কপি। গত সরকারের আমলে যে উৎপাদন নীতি প্রণয়ন করা হয়েছিল, তাকেই নতুন জামা পরিয়ে ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ স্লোগানে দাঁড় করিয়েছে বর্তমান সরকার। একই ভাবে ইউপিএ-র অন্য প্রকল্পগুলির নাম বদলে কৃতিত্ব নিতে চাইছে তারা। কিন্তু নতুন কিছুই হয়নি নয়া জমানায়। তাই পরিসংখ্যানে কারসাজি করে সাফল্য তুলে ধরতে হচ্ছে বিজেপিকে।’’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ নষ্ট করা, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলির গুরুত্ব ও মর্যাদা হননের জন্যও কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন সরকারকে আজ কাঠগড়ায় তুলেছেন প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী। সেই সঙ্গে বলেন, ‘‘মোদী জমানায় দেশের বহুত্ববাদকেও সুপরিকল্পিত ভাবে শেষ করার চেষ্টা হচ্ছে।’’

এই সমালোচনাকে তাৎপর্যহীন করে দিতেই সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মোদীর সঙ্গে মনমোহনের সৌজন্য সাক্ষাৎকে বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করার কৌশল নিয়েছিল তাঁর দফতর। মোদীও ট্যুইটারে লেখেন, ‘‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে আমি খুবই সন্তুষ্ট।’’ মনমোহনকে সৎ বলে সনিয়া-রাহুলের বিরুদ্ধে তোপ দাগেন মোদী ও অমিত শাহ।

দুর্নীতি প্রশ্নে বিজেপি সভাপতি এ দিন বলেন, মনমোহনের সততা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু চাপের কাছে হয়তো মাথা নত করতে হয়েছে তাঁকে। সনিয়া-রাহুল যে ভাবে তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করতেন, তাতে তাঁর কিছুই করার ছিল না।

কংগ্রেস কাল মোদী সরকারের সমালোচনায় সরব হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী এ দিন তার জবাবে সংবাদ সংস্থাকে বলেন, এই সরকারে অন্তত অসাংবিধানিক কোনও ক্ষমতার কেন্দ্র নেই।

মনমোহনকে কংগ্রেসের থেকে আলাদা করার কৌশল প্রথম দিন থেকেই নিয়ে চলেছেন বিজেপি নেতৃত্ব। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনাকে গুরুত্বহীন করে তুলতে এ দিনও তাঁরা সেই পথই নেয়।

কিন্তু কংগ্রেস নেতৃত্ব এ দিন মনমোহনের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে চেয়েছেন— মোদী সরকারের এক বছরের রঙিন বেলুন ফুটো করে দিয়েছেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ তথা প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement