— ছবি সংগৃহীত
গোমাংস নিষিদ্ধ হবে। অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে বন্ধ হবে আমিষ। এত কালের নিষেধাজ্ঞা তুলে গোটা দ্বীপপুঞ্জে মদ বিক্রি শুরু হবে পর্যটনের যুক্তিতে। দু’টির বেশি সন্তান থাকলে পঞ্চায়েত ভোটে লড়ার পথ বন্ধ হবে। অপরাধের হার নগণ্য, তবু গুন্ডাদমন আইন চালু হবে।
এমনই একগুচ্ছ খসড়া আইন এনে তুমুল চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছেন লক্ষদ্বীপের প্রশাসক প্রফুল্ল খোড়া পটেল। বিরোধীদের অভিযোগ, স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে এই তুঘলকি আইন চালু করে তিনি লক্ষদ্বীপের নিজস্ব সংস্কৃতিকে নষ্ট করার পথে হাঁটছেন। কেন্দ্রশাসিত এই দ্বীপপুঞ্জের অধিকাংশ বাসিন্দাই মুসলিম। প্রস্তাবিত আইনগুলি আদতে মুসলিম-বিরোধী বলেও অভিযোগ তুলছেন কেউ কেউ। পটেলের নীতির বিরুদ্ধে এক সুরে সরব কেরলের মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন ও তিরুঅনন্তপুরমের কংগ্রেস সাংসদ শশী তারুর। বিজয়নের অভিযোগ, নয়া প্রশাসকের আমলে কেরলের সঙ্গে লক্ষদ্বীপের সম্পর্ক নষ্টের চেষ্টা হচ্ছে। ওই দ্বীপপুঞ্জ থেকে পণ্যবাহী নৌকাগুলিকে এখন কেরলের বেপুর বন্দরের বদলে (বিজেপি-শাসিত) কর্নাটকের ম্যাঙ্গালুরুতে পাঠানো হচ্ছে।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গাঁধীর টুইট, ‘‘মহাসমুদ্রে ভারতের রত্ন লক্ষদ্বীপ। অশিক্ষিত ধর্মান্ধেরা তাকে ধ্বংস করছে। আমি লক্ষদ্বীপের মানুষের পাশে আছি।’’ ঐতিহ্য রক্ষার লড়াইয়ে লক্ষদ্বীপের পাশে থাকার বার্তা দিয়ে গত কালই টুইট করেছিলেন কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়ঙ্কা গাঁধী বঢরা। পটেলের অপসারণ চেয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছেন এআইসিসি-র সাধারণ সম্পাদক কে সি বেণুগোপাল। একই দাবিতে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়েছেন লক্ষদ্বীপের এনসিপি সাংসদ মহম্মদ ফয়জল, কেরলের সিপিএম সাংসদ এলামারম করিম, কংগ্রেস সাংসদ টি এন প্রতাপন, মুসলিম লিগের ই টি মহম্মদ বশির। সরব কেরলের সেলেব্রিটিদের একাংশও। ইন্টারনেটে ঘুরছে ‘সেভ লক্ষদ্বীপ’ হ্যাশট্যাগ।
গত ডিসেম্বরে লক্ষদ্বীপের প্রশাসকের পদে বসেন গুজরাতের বিজেপি নেতা প্রফুল্ল খোড়া পটেল। নরেন্দ্র মোদীর মুখ্যমন্ত্রিত্বের জমানায় তাঁর এবং অমিত শাহের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সতীর্থ ছিলেন তিনি। গুজরাতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীও ছিলেন। এ বার লক্ষদ্বীপে তাঁর কর্মকাণ্ডের প্রেক্ষিতে শশী তারুর বলেছেন, ‘‘বিজেপি প্রথমে নির্বাচনে নিজেদের জেতা জায়গাগুলোকে ধ্বংস করে। তার পরে যেখানে তাদের কোনও অস্তিত্ব নেই, সেগুলোকে নিয়ে পড়ে। তাদের নীতিই হল— ‘বাগে যদি না-আসে, তা হলে ভাঙো’।’’
পটেল প্রথমে ছিলেন দাদরা ও নগর হাভেলি এবং দমন ও দিউয়ের দায়িত্বে। লক্ষদ্বীপের ভার নিয়েই তিনি একের পর এক খসড়া আইন এনেছেন। যেমন, লক্ষদ্বীপ প্রাণী সংরক্ষণ আইন, সমাজবিরোধী কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন, লক্ষদ্বীপ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইন, পঞ্চায়েত সংশোধনী আইন। প্রাণী সংরক্ষণ আইনে গোহত্যা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। গোমাংস রাখলে বা সরবরাহ করতে গিয়ে ধরা পড়লে সাত থেকে দশ বছর জেল হতে পারে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, বিনা বিচারে গ্রেফতারির পথ খুলছে প্রশাসন। তাই অপরাধের হার নগণ্য হওয়া সত্ত্বেও আনা হচ্ছে গুন্ডাদমন আইন। উপকূল রক্ষা আইন দেখিয়ে ভাঙা হচ্ছে মৎস্যজীবীদের কুঁড়েঘর। স্থানীয় সাংসদ মহম্মদ ফয়জলের কথায়, ‘‘লক্ষদ্বীপ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আইনের আসল লক্ষ্যই হল, দেদার জমি অধিগ্রহণ। এখানকার রাস্তাগুলোকে নাকি জাতীয় সড়কের মতো করা হবে। লক্ষদ্বীপে কি বড় বড় হাইওয়ের আদৌ প্রয়োজন আছে?’’ অভিযোগ উঠেছে, নয়া প্রশাসকের জমানায় দ্রুত করোনা ছড়াচ্ছে লক্ষদ্বীপে। আগে এখানে এলে কোয়রান্টিন বাধ্যতামূলক ছিল। এখন শুধু কোভিড নেগেটিভ রিপোর্ট লাগছে।
পটেলের দাবি, জনতার মতামত চাওয়া হয়েছে বলেই খসড়া আইনগুলি আনা হয়েছে। তার বিরোধিতা সাধারণ মানুষ করছেন না। করছেন তাঁরা, যাঁদের স্বার্থে আঘাত লাগছে। তাঁর কথায়, ‘‘লক্ষদ্বীপে গত ৭০ বছরে কোনও উন্নয়ন হয়নি। মলদ্বীপ বিশ্ব পর্যটনের অন্যতম আকর্ষণ। আমরা লক্ষদ্বীপকেও সে ভাবে গড়ে তুলতে চাইছি। আর অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধে আইন আনা হলে অসুবিধেটা কোথায়?’’ গোমাংসে নিষেধাজ্ঞা কেন? পটেলের বক্তব্য, ‘‘যাঁরা বিরোধিতা করছেন, তাঁরাই জানান, কেন করছেন।’’ লক্ষদ্বীপের ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কেরল হাই কোর্টে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে। সেই মামলার শুনানিতে কাভারাত্তি দ্বীপ থেকে দু’জন সহকারী সরকারি আইনজীবীর বদলিতে স্থগিতাদেশ দিয়ে প্রশাসনের জবাব চেয়েছে কোর্ট। বিচারপতিরা বলেছেন, ‘‘লক্ষদ্বীপে কী ঘটছে, আমরা জানি।’’