চান্না স্টুয়ার্টি’ মাছ। —নিজস্ব চিত্র
নীল হলুদে মেশানো মাছ, ময়ূরকণ্ঠী পাখনা। নাম ‘চান্না স্টুয়ার্টি’। মাছ পাগল অভিজিৎ নাথ মুম্বইয়ের ব্রিডার সঞ্জয়ের কাছ থেকে সেই মাছের সন্ধান পেয়েছিল। জানতে পেরেছিল কার্বি আংলংয়ের পাহাড়-জঙ্গলের মধ্যে কান্থি লাংসো জলপ্রপাতের নীচে ওই মাছ পাওয়া যায়। মাছের সন্ধানেই বাড়ির নিষেধ উপেক্ষা করে ৮ জুন সকালে কালো স্করপিও নিয়ে বন্ধু নীলোৎপলের সঙ্গে রওনা হয়ে যায় অভিজিৎ। পরের ঘটনা সকলের জানা। কিন্তু ঘটনাস্থল থেকে প্রথম ফোনটা পেয়েছিলেন অভিজিতের প্রেমিকা। যাঁর সঙ্গে এ বছর সেপ্টেম্বরে অভিজিতের ৩১ বছরের জন্মদিনের আগেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। সে দিন ফোনের কথোপকথন আর তারপরের ঘটনার জেরে এখনও জড়বৎ দিন কাটাচ্ছেন ওই তরুণী। বোনের হয়ে বিচার চেয়ে এবার সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ্যে মুখ খুললেন দিদিআইরিন গগৈ।
আইরিন জানান, ৮ জুন রাত ৮টা নাগাদ অফিস থেকে বেরনোর তোড়জোড় করছিলেন। তখনই আতঙ্কিত গলায় বোন ফোনে বলে, “অভিজিৎকে ফোন করেছিলাম। ওদিক থেকে অন্য কেউ ফোন ধরল। আমি বললাম, যার ফোন তাকে দিন। ওদিকের গলা জানাল, সে আর নেই।” এর পর বোন জানাতে চায় সে কোথায় আছে? ওপারের ব্যক্তি ভাঙা অসমিয়ায় জানায়, ও মরে গেছে। আমরা মেরে ফেলেছি। রাস্তায় পড়ে আছে। বোন কাতর ভাবে বলে, দয়া করে ওকে মারবেন না, কেন এমন করছেন আপনারা? ওপারের লোক জানতে চায়, তুই কে? বোন জানায় সে অভিজিতের প্রেমিকা। ওপারের লোক হালকা সুরে বলে, আর তো তোর মানুষটাকে পাবি না রে। ওকে তো মেরে ফেলেছি। বেচারা আর গুয়াহাটি ফিরতে পারবে না। কাল খবরের কাগজে নিজের লোকটার ছবি দেখে নিস।
ওই ফোনের পরে পাগলের মতো অবস্থা হয় সকলের। অভিজিতের বাবা তখন মরিগাঁও থেকে আসছিলেন। তাঁকে ফোন করেন আইরিন। সকলে মিলে দিসপুর থানায় যান। বোন বারবার বলছিল, এখনই কার্বি আংলং না গেলে ওরা অভিজিৎকে মেরে ফেলবে। আইরিন কার্বি আংলংয়ে কাজ করা বন্ধুদের ফোন করে ঘটনার আঁচ পান। পরে পুলিশ সব জানতে পারে। প্রেমিকাকে বলা হয়ে দুর্ঘটনায় পড়েছে অভিজিতের গাড়ি। পরের দিন সন্ধ্যায় অভিজিতদের আসার খবর পেয়ে বোন সাজগোজ করে রওনা হয়। বলতে থাকে, ‘‘আমায় না-সাজা অবস্থায় দেখলে ও রেগে যাবে।’’ অভিজিতের পাড়ায় ঢোকার সময় এত মানুষ, পুলিশ দেখে অবাক হয়ে যায়। তারপরেই সেই মুহূর্ত, যখন হবু স্বামীরথেঁতলানো, ক্ষতবিক্ষত মাথাটা দেখতে পায় সে।
আইরিনের বক্তব্য, একাংশ মানুষ দাবি করছেন, গ্রামের সরল লোকেরা ভুল বুঝে অভিজিতদের মেরে ফেলেছে। কিন্তু যারা হাসতে হাসতে এক তরুণীকে তার প্রেমিককে মেরে ফেলার গল্প বলে, পরিহাস করে জানায়, পরের দিনের সংবাদপত্রে মৃত বরের মুখটা দেখে নিস, তারা কি আদৌ সরল? যে ভাবে জলপ্রপাতে ঝগড়ার পরে আলফাজসতিমুং গাড়িতে বাচ্চা ধরে নিয়ে যাচ্ছে বলে ফোন করে অভিজিৎদের গাড়ি থামিয়েছে, সেটাও সরল গ্রামবাসীদের আচমকা রাগের বহিঃপ্রকাশ হতে পারে না।
অসম সাহিত্য সভার প্রাক্তন সভাপতি কার্বি সাহিত্যিক রংবং তেরংয়ের মতে, কান্থি লাংসো জলপ্রপাতের নাম অভি-নীল জলপ্রপাত রাখা হোক। কিন্তু পানিজুড়ি গ্রামে তাঁদের মূর্তি গড়লে বিদ্বেষের স্মৃতি দগদগে হয়ে থাকবে বলে তিনি মনে করেন।
অভিজিৎ ও নীলোৎপলের হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে ফেসবুকে যে কমিউনিটি তৈরি হয়েছে, তার সদস্যসংখ্যাপ্রায় এক লক্ষ ৭০ হাজার ছুঁয়েছে। চলছে স্বাক্ষরসংগ্রহ। বিভিন্ন জেলায় স্বতস্ফূর্তভাবে প্রতিবাদ ও প্রার্থনাসভাও চলছে।