ভোটের বাজার বেশ তেজি। প্রথম পর্যায়ের ৬৫ আসনের প্রার্থীরা মাঠে নেমে পড়েছেন। যে আসনে যত প্রার্থীই থাকুন না কেন, মূল লড়াই তিন দলের মধ্যে। কংগ্রেস, ভারতীয় জনতা পার্টি ও এআইইউডিএফ। প্রথম দুই দল ক্ষমতার দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। আর এআইইউডিএফ রয়েছে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ বসিয়ে ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার বাসনায়। বাকি রইল বামপন্থী এবং নির্দলরা। নির্দলদের অধিকাংশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে কোনও ব্যাখ্যা মেলে না। আর বামপন্থীরা শুধুই নিজেদের শক্তি যাচাইয়ের পরীক্ষায় নেমেছেন। তবে এখনও নির্বাচনী শক্তি হয়ে উঠতে পারেনি।
বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং বিভিন্ন দলের পৃথক জোটগঠনে ধারণা করা হচ্ছে, এ বার অসমে ত্রিশঙ্কু বিধানসভার সম্ভাবনাই বেশি। সে ক্ষেত্রে প্রচলিত কথাটিই আরও একবার সত্য হবে, ‘রাজনীতিতে শত্রু বলে কিছু নেই, মিত্রও শত্রু হতে পারে, আবার শত্রুও মিত্র।’ অসমে এই যে মিত্র জোটগুলো হয়েছে, ভোটের পর ক্ষমতার লোভে নৌকা বদল করতে পারেন বলেই সাধারণ, অরাজনৈতিক চোখে মনে হয়।
অসমের রাজনৈতিক অবস্থা ও অবস্থান দেশের অন্য রাজ্যের থেকে আলাদা। এখানকার জনবিন্যাসও খুব জটিল। জাতি-উপজাতি, ধর্ম, ভাষা ইত্যাদি ভোটের অঙ্কে কাটাকুটির খেলা। তাই সঠিক সমীক্ষা বড় কঠিন।
বরাক উপত্যকায় তিনটি জেলা। কাছাড়, করিমগঞ্জ এবং হাইলাকান্দি। এর মধ্যে করিমগঞ্জ জেলায় এক সময় শতাধিক জমিদার বা মিরাসদার ছিলেন। রাজার যেমন প্রজা, তেমনি জমিদারির আওতায় থাকা বাসিন্দাদের রায়ত বলা হতো। এই সমস্ত জমিদারদের মধ্যে মাত্র কয়েকজন রাজনীতির আসরে নেমেছিলেন। যেমন—বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায়, কামিনীকুমার সেন, রণেন্দ্রমোহন দাস, গোলাম রব্বানি চৌধুরী। তাঁরা কেউই উত্তরসূরি রেখে যাননি। হয়তো জমিদারি রক্তের দরুন ‘রাজনৈতিক রায়ত’ করে রাখার কায়দাটায় খাপ খাওয়াতে পারেননি। তাই করিমগঞ্জ জেলায় রাজনৈতিক মিরাসদার বা রায়তি মেলবন্ধন সে ভাবে গড়ে ওঠেনি। করিমগঞ্জ জেলার রাতাবাড়ি আসন তফশিল জাতির জন্য সংরক্ষিত। উত্তর করিমগঞ্জে হিন্দু ভোটার বেশি। পাথারকান্দিতে বিষ্ণুপ্রিয়া-মণিপুরি সম্প্রদায়ের ভোটই নির্ণায়ক শক্তি। অন্য দিকে, বদরপুর ও দক্ষিণ করিমগঞ্জে মুসলমান আধিপত্য রয়েছে। ক’বছরের অভিজ্ঞতায় স্পষ্ট, এখানে ভোট যতটা দলীয়, তার চেয়েএ বেশি কাজ করে সাম্প্রদায়িক রসায়ন। তাই ভোট ভাগাভাগির ফাঁকে ‘অঘটন’ ঘটা আশ্চর্যের নয়।
হাইলাকান্দির সাবেক জমিদার-রায়সাহেবের বাড়ির হেমচন্দ্র চক্রবর্তী রাজনীতিতে ছিলেন। পরে কেউ আর ও-মুখো হননি। সেই সুযোগেই রাজনৈতিক মিরাসদারি অন্য এক পরিবারের হাতে চলে যায়। এখানে বিভিন্ন দলের শাখা রয়েছে, ভোটে প্রার্থীও দেয় সবাই। কিন্তু মিরাসদারের ক্ষমতার নিকট এঁরা নতজানু থাকেন বলেই সাধারণের অভিযোগ। ওই পরিবারের বর্তমান কর্তা, গৌতম রায় চাইলেই অঘটন ঘটাতে পারেন জেলায়। জেলার তিন আসনের দু’টিতে কংগ্রেসের জয় নিশ্চিত। হারলে হারবে যেটি, সেটিও তাহলে হবে তাঁর প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে।
কাছাড় জেলার সাতটি আসনেই লড়াই হবে। এমন কী উধারবন্দ, লক্ষ্মীপুরেও কংগ্রেস আগের মতো নিরাপদ নয়। বাকি পাঁচটিতে একেবারে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। কাটিগড়া আসনে গত বারের এআইইউডিএফ টিকিটে বিজয়ী বিধায়ক আতাউর রহমান মাঝারভুইয়া এ বার কংগ্রেস প্রার্থী। সেখানকার ময়দান কারও জন্যই কুসুমাস্তীর্ণ হয়। বড়খলায় কংগ্রেস প্রার্থী রুমি নাথকে ঘিরে নানা বিতর্ক রয়েছে। আবার এই দলেরই আরেক নেতা মিসবাহুল ইসলাম লস্কর নির্দল প্রার্থী হয়েছেন। বিজেপি প্রার্থী কিশোর নাথও প্রচারে খুব স্বচ্ছন্দ রয়েছেন, এমন বলা যায় না। দলের অন্তর্কলহ তাঁকে শুরু থেকেই যে চাপে রেখেছে।
ধলাই আসন তফশিল জাতির জন্য সংরক্ষিত। তাই ধর্মীয় মেরুকরণের প্রশ্ন নেই। প্রতিদ্বন্দ্বিতা মূলত দুই বড় দলে। বিজেপির পরিমল শুক্লবৈদ্য প্রতিবাদী কণ্ঠ হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। প্রাক্তন বিধায়কও। কংগ্রেস প্রার্থী গিরীন্দ্র মল্লিক এখনও মন্ত্রী। যদিও লো-প্রোফাইল। নিজের জন্য বিশেষ কিছু করে উঠতে পারেননি। আর এলাকার জন্যও করতে পারেননি বিশেষ কিছু। গেরুয়া দল উপত্যকায় তিনটি নিশ্চিত আসনের তালিকা দিতে গেলে, ধলাইকে এক-দুয়েই রাখে। কিন্তু বিজেপিকে আটকাতে যদি সংখ্যালঘুরা জোটবদ্ধ হয়, তাহলে অঙ্ক পাটিগণিতের নিয়মেই পাল্টে যেতে বাধ্য।
সোনাই বিধানসভা কেন্দ্র সংখ্যালঘু প্রধান। লড়াইটাও হচ্ছে সংখ্যালঘু প্রার্থীদের মধ্যেই। অসমে এবারই প্রথম হিন্দুত্ববাদীরা সোনাইয়ে সংখ্যালঘু আমিনুল হক লস্করকে প্রার্থী করেছে। হিন্দু ভোটাররা সাধারণত হিন্দুত্বের অনুকূলে ভোট দেবেন ধরে নেওয়া হয়। আর মুসলমান হিসেবে আমিনুল নিজের জনগোষ্ঠীর কিছু ভোট নিয়ে আসবেন, এটাই নিশ্চয় বিজেপি নেতৃত্বের প্রত্যাশা। তাই যদি হয়, তাহলে বর্তমান বিধায়ক এনামুল হক নিশ্চিত সঙ্কটের মুখে পড়বেন।
এই উপত্যকার সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ আসন নিঃসন্দেহে শিলচর। এখানে কিন্তু ‘রাজনৈতিক মিরাসদার’ রয়েছেন। বর্তমানে যদিও তিনি অসুস্থতার জন্য নির্বাচনী আসরে নেই। রয়েছেন তাঁর উত্তরসূরি। বাহুল্য হলেও বলা, এঁরা হলেন সন্তোষমোহন দেব ও তাঁর কন্যা সুস্মিতা। তাঁরা শুধু শিলচরের নন, গোটা কাছাড় জেলারই নেতা। সন্তোষবাবুর অঙ্গুলিহেলনে অনেক কিছু হতে দেখেছেন শিলচরবাসী। গত লোকসভা নির্বাচনে কাছাড়ের দখল নিয়েছেন সুস্মিতা। পুরসদস্য থেকে পুরনেত্রী, তারপর শিলচরের বিধায়ক। বর্তমানে সাংসদ। স্বল্প সময়ের মধ্যে পুরসদস্য থেকে সাংসদ হওয়ার নজির খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তিনি সাংসদ হওয়ায় বিধানসভার আসনটি ধরে রাখতে পারেনি কংগ্রেস। উপনির্বাচনে প্রচুর ভোটের ব্যবধানে জিতেছেন বিজেপির দিলীপকুমার পাল। তিনিই এ বার দলীয় প্রার্থী।
কিন্তু শিলচরটা নিজের অধীনে না রাখলে ক্ষমতার প্রদর্শন হয় না বলেই বৃদ্ধা মাকে নিয়ে এলেন সুস্মিতা দেব। তিনিও একদা বিধায়ক এবং পুরপ্রধান ছিলেন। বড় ঝুঁকি নিলেন তরুণী সাংসদ। জেলা কংগ্রেসের রাশ নিজের হাতে নিয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস অবশ্য এখন তুঙ্গে। অঙ্কের খেলায়ও তিনি মন্দ নন। তাই প্রথমেই তাঁর মনে হয়েছে, প্রায় দু’লক্ষ ভোট বদরুদ্দিন আজমল নিয়ে নেওয়াতেই ২০০৯ সালে তাঁর বাবার হার হয়েছিল। এ বার প্রথমেই চিন্তা করলেন, কী ভাবে সংখ্যালঘু ভোট নিজের পালে টানা যায়। সফলও হলেন। বদরউদ্দিনের দল শিলচর আসনে প্রার্থী দেয়নি। কেন দিলেন নায—সে নিয়ে নানা চর্চা, নানা কানাঘুষো শহরজুড়ে। তা সত্ত্বেও মনে হয়, অশীতিপর মাকে ভোটের ময়দানে নামিয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে নিলেন না তো সুস্মিতাদেবী!
(লেখক বরাকের বিশিষ্ট নাগরিক)