Janki Bai Allahabadi

Janki Bai Allahabadi: সৎমার পরকীয়া ধরে ফেলায় ৫৬ বার ছুরিকাঘাত, এই গায়িকার সঙ্গে জড়িয়ে গ্রামোফোনের ইতিহাস

তিনি কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী জানকী বাই ইলাহাবাদি। যিনি ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

Advertisement
নিজস্ব প্রতিবেদন
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০২১ ০৯:২২
Share:
০১ ২২

আজকের দেশের বিনোদন জগতে ‘৫৬’ শব্দটার কথা উঠলেই রসিকদের মাথায় আসবে বলিউডি সিনেমা ‘অব তক ছপ্পন’-এর কথা। কিন্তু বিশ শতকের প্রথমার্ধে এই সংখ্যাটার কথা উঠলেই এক মহিলার নাম বা কণ্ঠ ভেসে উঠত সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে। তিনি কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী জানকী বাই ইলাহাবাদি। যিনি ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামেও পরিচিত ছিলেন।

০২ ২২

কেন এমন একটা উদ্ভট সংখ্যার সঙ্গে জড়িয়ে গেল এক সঙ্গীতশিল্পীর নাম? প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে বসলে বেশ আশ্চর্য এক ইতিহাস উঠে আসে। এক নারীর জীবন সংগ্রাম আর সেই সঙ্গে ভারতে গ্রামোফোন কোম্পানির আদিপর্বের গল্প সেখানে একাকার।

Advertisement
০৩ ২২

জানকীর জন্ম ১৮৮০ সালে বারাণসীতে। বাবা শিববালকরাম এবং মা মানকী। জানকীর আরও দুই বোন ও এক ভাই ছিল। তাঁর বাবা শিববালকরামের ছিল দুধের ব্যবসা এবং মিষ্টির দোকান। এক রকম স্বচ্ছল অবস্থাতেই দিন কাটছিল তাঁদের। ছোটবেলা থেকেই জানকীর ছিল গানের নেশা।

০৪ ২২

শিববালক ছিলেন কুস্তিগির। এক দিন ভোরে গঙ্গার ধারে আখড়ায় অনুশীলন করতে গিয়ে দেখতে পান, এক মহিলা সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে গঙ্গায় ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা করছেন। তাঁকে বাঁচান শিববালক। শিশুটি অবশ্য মারা যায়। মহিলাকে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিনি।

০৫ ২২

গঙ্গা থেকে তুলে আনা মহিলার নাম ছিল লক্ষ্মী। তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে তাঁকে বিয়ে করেন তিন সন্তানের বাবা শিববালক। এর পর শুরু হয় প্রথমা পত্নী মানকীর উপরে নির্যাতন। বালিকা জানকী তাঁর বাবার এহেন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

০৬ ২২

অন্য দিকে, লক্ষ্মীর সঙ্গে এক পুলিশ কনস্টেবলের প্রেম শুরু হয়। শিববালক ও মানকী বাড়িতে না থাকলে সেই কনস্টেবল রঘুনন্দন আসত। এক দিন লক্ষ্মী ও সেই ব্যক্তিকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখে ফেলে বালিকা জানকী। জানকীর মুখ চিরতরে বন্ধ করার জন্য সুযোগ খুঁজতে থাকে রঘুনন্দন। কিছু দিন পরে তাঁকে একা পেয়ে একটা ছুরি দিয়ে উন্মত্তের মতো কোপাতে থাকে সে। জানকী জ্ঞান হারালে সে পালিয়ে যায়।

০৭ ২২

গুরুতর আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান জানকী। জনশ্রুতি, তাঁর শরীরে নাকি ৫৬টি আঘাতের দাগ ছিল। সেই থেকেই তিনি ‘ছপ্পন ছুরিওয়ালি’ নামে পরিচিত হতে শুরু করেন। এই ঘটনার পরে লক্ষ্মী বাড়ি থেকে গয়না ও টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। শিববালকও রহস্যময় ভাবে নিখোঁজ হয়ে যান। সন্তানদের নিয়ে মানকী পড়েন আতান্তরে।

০৮ ২২

মাথার উপর আকাশ ভেঙে পড়ে মানকীর। এমন সময়ে পার্বতী নামে এক মহিলার কথায় বারাণসীর পাট চুকিয়ে সন্তানদের নিয়ে ইলাহাবাদে চলে আসেন তিনি। পার্বতী আসলে তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। মানকীর ঠাঁই হয় শহরের নিষিদ্ধপল্লিতে।

০৯ ২২

এমন পরিবেশে মানকীর উপরে চরম দুর্যোগ নেমে এলেও জানকী কিন্তু তাঁর স্বপ্নপূরণের সুযোগ পান। ইলাহাবাদের সেই পাড়াতেই তিনি প্রবেশ করেন ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুনিয়ায়। শুরু হয় তাঁর সঙ্গীত শিক্ষা।

১০ ২২

বারাণসী থাকাকালীন জানকী কৈদল মহারাজ নামের এক সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছিলেন। ইলাহাবাদে তিনি শিক্ষক হিসেবে পান লখনউ ও গ্বালিয়রের বিখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ হস্‌সু খানকে। আর বাড়িতে চলতে থাকে ইংরেজি, ফারসি ও সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা।

১১ ২২

তালিম শেষ হলে বিভিন্ন আসরে গান গাইতে শুরু করেন জানকী। নজরে পড়েন সঙ্গীতজ্ঞ রামচন্দ্র দাসের। তাঁর তারিফই জানকীকে প্রতিষ্ঠা এনে দেয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ডাক পেতে শুরু করেন জানকী। সমকালীন রীতি অনুসারে নাকি গলায় গান গাইতেন না জানকী। সেটাই তাঁর সঙ্গীত জীবনের বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

১২ ২২

সমকালের আর এক কিংবদন্তি গায়িকা গওহর জানের সঙ্গে অকৃত্রিম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে জানকীর। সেই সময় যখন মার্গ সঙ্গীতের মহিলা শিল্পীরা পরস্পরের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকতেন, তখন এই দুই নারীর বন্ধুত্ব একটা বিশেষ উদাহরণ হয়ে ওঠে।

১৩ ২২

১৯১১ সালে সম্রাট পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে আয়োজিত দিল্লি দরবারে জানকী ও গওহর জান একত্রে পরিবেশন করেন একটি বিশেষ গান ‘ইয়ে জলসা তাজপোশি কা মুবারক হো’। সাম্মানিক হিসেবে জানকী এবং গওহর, দু’জনকেই দেওয়া হয় ১০০টি করে সোনার গিনি।

১৪ ২২

১৯০৭ সালে গ্রামোফোন কোম্পানি প্রথম রেকর্ড করে জানকী বাইয়ের গান। সেই সময় তাঁর ২২টি গান রেকর্ড করা হয়েছিল। বিপুল জনপ্রিয়তা পায় সেই সব রেকর্ড। পরের বছর আরও ২৪টি গান ধরে রাখা হয় ডিস্কে। সেই সময় এই রেকর্ডিংয়ের জন্য জানকী পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ৯০০ টাকা। ১৯১০-এ তাঁর আরও ২২টি গান রেকর্ড করে গ্রামোফোন কোম্পানি। এ বার তিনি সাম্মানিক হিসেবে পান ১৮০০ টাকা।

১৫ ২২

সেই সময়ে গ্রামোফোন কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বাজারে আসে ফরাসি রেকর্ড কোম্পানি ক্যাথে। সেখান থেকেও জানকীর বেশ কিছু রেকর্ড বার হয়। সেই সময়ে রেওয়াজ ছিল, শিল্পীদের সঙ্গে রেকর্ড কোম্পানিগুলির চুক্তিবদ্ধ হওয়ার। জানকী সেই বন্ধনে ধরা দেননি। ১৯১১ থেকে ১৯২৮-এর মধ্যে গ্রামোফোন কোম্পানি তাঁর অসংখ্য গান রেকর্ড করে।

১৬ ২২

১৯২৮ সালে প্রথম আধুনিক প্রযুক্তিতে জানকীর গান ধরে রাখা হয়। গানের শেষে সেকালের রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি বলতেন, “মাই নেম ইজ জানকী বাই ইলাহাবাদী।” শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রায় সব শাখাতেই ছিল তাঁর অনায়াস বিচরণ। ঠুমরি, দাদরা, চৈতি, হোরি, কাজরি, ভজন— সব রকমের গানেই তিনি অসামান্য দক্ষতার পরিচয় রাখতেন।

১৭ ২২

রাগ দরবারি কানাড়া, ভৈরবী, মল্লার, তিলক কামোদ, আশাবরী ইত্যাদিতে তাঁর গাওয়া ঠুমরিগুলি আজও সমঝদারের তারিফ আদায় করে নেয়। আজও ইউটিউবে ‘মর যায়েঙ্গে পর ইশ্‌ককা চর্চা না করেঙ্গে’, ‘সইয়াঁ নিকল গয়ে ম্যায় না লড়ি থি’, ‘রসিলি তোরি আঁখিয়া’ ইত্যাদির শ্রোতার সংখ্যা ক্রমবর্ধমান।

১৮ ২২

উর্দু ভাষায় জানকীর দক্ষতা ছিল অপরিসীম। এই ভাষায় তিনি কবিতা লিখতেন। ‘দিওয়ান-এ-জানকী’ নামে এক কাব্য সংকলনও প্রকাশিত হয় সেই সব কবিতা নিয়ে। সমকালীন কবি আকবর ইলাহাবাদীর স্নেহ তিনি পেয়েছিলেন। প্রসঙ্গত, আকবর ইলাহাবাদী চিরস্মরণীয় হয়ে রয়েছেন তাঁর গজল ‘হাঙ্গামা হ্যায় কিঁউ বরপা’-র জন্য।

১৯ ২২

দু’হাতে উপার্জন করেছেন জানকী বাই। এক সময়ে কোনও আসরে গান গাওয়ার জন্য দু’হাজার টাকা নিতেন। পরে তা দাঁড়ায় পাঁচ হাজারে। বিভিন্ন জায়গায় বাড়ি ও ভূ-সম্পত্তি কিনেছিলেন জানকী। থাকতেনও বিলাসবহুল কেতায়।

২০ ২২

তাঁর খ্যাতি যখন তুঙ্গে, তখনই ইলাহাবাদের এক আইনজীবী আব্দুল হকের সঙ্গে বিয়ে হয় তাঁর। কিন্তু বেশি দিন টেকেনি সেই সম্পর্ক। সারা জীবন দারিদ্র ও আর্তের সেবা করে গিয়েছেন জানকী। গড়ে তুলেছিলেন ‘জানকীবাই ট্রাস্ট’। সেখান থেকে গরিব ও মেধাবি শিক্ষার্থীদের অর্থ সাহায্য করা হত, গরিব মানুষকে খাদ্য ও বস্ত্র দান করা হত। বেশ কিছু মন্দির ও মসজিদেও দান করতেন জানকী। আজও সেই ট্রাস্ট কাজ করে চলেছে।

২১ ২২

জীবনের শেষ পর্ব নিঃসঙ্গে কেটেছে এই কিংবদন্তি শিল্পীর। শিষ্য মহেশচন্দ্র ব্যাস তাঁর দেখাশোনা করতেন। ১৯৩৪-এ তিনি মারা যান। মহেশচন্দ্রের উদ্যোগেই তাঁকে ইলাহাবাদের এক গোরস্থানে কবর দেওয়া হয়। ট্রাস্ট সেখানে পরে একটি সৌধ স্থাপন করে।

২২ ২২

২০১৮ সালে লেখিকা নীলম শরণ গৌর ‘রিকুইম ইন রাগা জানকী’ নামে এক গ্রন্থে এই শিল্পীর জীবনের খুঁটিনাটি বিবরণকে তুলে আনেন। এই বই জানকীর জীবন অবলম্বনে লেখা এক উপন্যাস। সেখানে জানকীর শিল্পী হয়ে ওঠার সঙ্গে মিশে রয়েছে ভারতে গ্রামোফোন কোম্পানির উত্থান আর সেকালের ইলাহাবাদ শহরের অনাবিল বর্ণনা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on:
আরও গ্যালারি
Advertisement