রেহানা খাতুনের কোলে ২৩ দিনের আশিয়ানা। পাশে ৯১ বছরের আসমা বিবি (ডান দিকে)। বৃহস্পতিবার শাহিনবাগে। ছবি: সোমা মুখোপাধ্যায়
২৩ দিনের ভবিষ্যতের মাথায় ৯১ বছরের বর্তমানের হাত!
বর্তমানই তো! বৃহস্পতিবার শেষ বিকেলের নরম আলোয় জ্বলজ্বল করছিল ৯১ বছরের আসমা বিবি, ৭৫-এর নুরুন্নেসা, ৮২-র বিলকিস বেগমের মুখ।
দিল্লির শাহিনবাগের ধর্না-অবস্থানে অশীতিপর এই বৃদ্ধারা এখন সামনের সারিতে। আন্দোলনের অভিভাবকই এখন এঁরা। কে কখন খেল, ঠান্ডায় পড়ে থেকে কোন বাচ্চার গা গরম হল, কার মা মাথা ঘুরে পড়ে গেল, কিছুই নজর এড়াচ্ছে না এঁদের। কখনও ধর্নামঞ্চে মাইক হাতে দাঁড়াচ্ছেন, কখনও অসুস্থকে নিয়ে টলোমলো পায়ে এগোচ্ছেন লাগোয়া মেডিক্যাল ক্যাম্পের দিকে, কখনও বা রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সহমর্মীদের হাতে তুলে দিচ্ছেন চায়ের কাপ।
ছানি পড়া ঘোলাটে চোখ, দন্তহীন ভাঙা গাল আর অজস্র বলিরেখা ভরা আসমা বিবির মুখে আজ এক বারও ক্লান্তির ছিটেফোঁটা নজরে এল না। বিকেলে তাঁর পাশে বসা ২৫ বছরের রেহানা খাতুনের (যে মায়ের ছবি আর কথা ইতিমধ্যেই ভাইরাল) কোলে অঘোরে ঘুমোচ্ছিল ২৩ দিনের আশিয়ানা। তার মাথায় হাত রেখে ‘আসমা দাদি’ বিড়বিড় করতে থাকেন, ‘‘ক্লান্ত হলে চলবে কী করে? এদের বাঁচাতে হবে তো।’’
আরও পড়ুন: সিএএ: ফের পাক তাস প্রধানমন্ত্রীর
সিএএ এবং এনআরসি-র বিরুদ্ধে শাহিনবাগের এই প্রতিবাদ বৃহস্পতিবার ২০ দিন পেরোল। ইতিমধ্যেই দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক স্তরে ঠাঁই পেয়েছে এই আন্দোলনের কথা। একে ভাঙার চেষ্টা হচ্ছে না, তা নয়। যেমন, আজ বিকেলেই শাহিনবাগ কোঅর্ডিনেশন কমিটি জানিয়ে দিয়েছে, তারা অবস্থান তুলে নিচ্ছে। তাদের বক্তব্য, এই আন্দোলন মানুষের মনে যে-শক্তি জুগিয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তা নিজেদের কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। সেটা হতে দেওয়া যায় না।
অবস্থানকারীদের বড় অংশ অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। মাইকে বার বার ঘোষণা হচ্ছে, ‘‘যাঁরা ভয় পাচ্ছেন, যাঁরা ভাবছেন পুলিশের লাঠি খেতে হবে, তাঁরা দয়া করে বাড়ি ফিরে যান। সততা আর সাহস ছাড়া এই আন্দোলনের আর কিছুমাত্র সম্বল নেই। তাই সাহস ফুরোলে আর দয়া করে এখানে বসে থাকবেন না।’’
আরও পড়ুন: সিএএ-বিরোধী হিংসা নিয়ে নোটিস মৃত বৃদ্ধকে
শুনতে শুনতে অধৈর্য হয়ে ওঠেন আসমা। ‘‘ভয় কে পাচ্ছে? আসুক পুলিশ। লাঠি নয়, গুলি চালাক। বুক পেতে দাঁড়াব। বিপদে পড়েও ধর্মের কারণে কেউ যদি নাগরিকের স্বীকৃতি না-পায়, তা হলে আমরা অন্তত গুলি খেয়ে শহিদের মর্যাদাটুকু আদায় করে নিই।’’ ৮২ বছরের বিলকিস বেগম আসমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন, ‘‘ধর্মের ভিত্তিতে ভাগাভাগি হতে দেবে না বলে এতগুলো মানুষ দাঁতে দাঁত চেপে লড়ছে। আমরাই এদের আগলে রাখব। নিজেদের জীবন নিয়ে ভাবছি না।’’
এই আন্দোলনের আগে জীবনে বাড়ির চৌহদ্দির বাইরেই খুব বেশি পা রাখেননি যাঁরা, এত ভারী ভারী শব্দ তাঁরা শিখলেন কোথায়? আসমা, বিলকিস, নুরুন্নেসারা আশিয়ানাকে দেখিয়ে বললেন, ‘‘একে জন্ম দেওয়ার সময়ে এর মা কি ভেবেছিল এই ঠান্ডায় ওকে নিয়ে খোলা রাস্তায় রাত কাটাবে? পরিস্থিতি মানুষকে তৈরি করে নেয়।’’
রাত যত বেড়েছে, চাপা উত্তেজনা তৈরি হয়েছে এলাকায়। ‘‘কিছু একটা ঘটবে’’, ফিসফিস করেছেন অনেকেই। কী ঘটবে? স্বেচ্ছাসেবক জয়নুর আবেদিন বললেন, "সরকারকে খুব অস্বস্তিতে ফেলেছে এই আন্দোলন। আমাদের আশঙ্কা, যে-কোনও সময়ে পুলিশ আসবে। শারীরিক শক্তি দিয়ে আমরা ওদের সঙ্গে পেরে উঠব না। আমরা সকলের হাতে হাতে জাতীয় পতাকা রাখছি। সন্তান কোলে মায়েরা সামনে বসে থাকছেন। দেখি কে আটকায়!’’
আটকানোর কথা শুনেই সামনে চলে এলেন আসমা। জয়নুরের হাত থেকে মাইক নিয়ে কাঁপা গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘‘আজাদি!’’ মুষ্টিবদ্ধ অন্য হাত শূন্যে উঠল তাঁর। মুহূর্তে কয়েকশো মানুষের সমস্বরে বলে ওঠা ‘আজাদি’ ভরিয়ে তুলল গোটা শাহিনবাগ।