গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাসের ছবি কেউ ভোলেননি। অনেক পুরোহিতের উপস্থিতি থাকলেও সেখানে পৌরোহিত্য করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীই। কিছু দূরেই জায়গা পেয়েছিলেন আরএসএস-এর সঙ্ঘচালক মোহন ভাগবত। এ বার মন্দিরের ‘প্রাণপ্রতিষ্ঠা’ নিয়েও মোদী যে ভাবে আলোয়, তা দেখে খারাপ লাগতে পারে দীর্ঘ দিন ধরে রামমন্দির আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাওয়া গেরুয়া রাজনীতিকদের। ২২ জানুয়ারি মন্দিরের উদ্বোধন। তার আগে শুক্রবার থেকেই ‘ব্রত উদ্যাপন’-এর ঘোষণায় আলো টেনে নেওয়ার জন্য তৈরি প্রধানমন্ত্রী মোদী। উদ্বোধনের দিন তাঁর সঙ্গে ভাগবত এবং যোগী আদিত্যনাথেরও থাকার কথা। তবু যাবতীয় নজর থাকবে মোদীর দিকেই।
২০১৯ সালে মোদী জমানাতেই রামমন্দির বানানোর ছাড়পত্র মিলেছে সুপ্রিম কোর্টের থেকে। কিন্তু মন্দিরের দাবিতে দীর্ঘ আন্দোলনের ইতিহাসে মোদী কোথাও নেই। সবচেয়ে বেশি যাঁর নাম রয়েছে, তিনি লালকৃষ্ণ আডবাণী। উদ্বোধনে আমন্ত্রণ পেয়েছেন তিনি। গেরুয়া শিবির জানে আডবাণী না থাকলে আধখানা পথও এগোতে পারত না হিন্দুত্ববাদীর এই লড়াই। রামমন্দিরের উদ্বোধনের আগে আডবাণী অবশ্য লিখেছেন, মোদীই রাম রথের ‘যোগ্যতম সওয়ারি’। লিখেছেন, তিনি ‘মিস্’ করছেন অটলবিহারী বাজপেয়ীকে। ১৯৮০ সালে বিজেপি প্রতিষ্ঠার সময় থেকে তিনি বাজপেয়ীর সঙ্গী হয়ে দলকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ১৯৯০ সালে দলকে সেই পথ দেখিয়েছেন, যে পথ ধরে এই ২০২৪ সালেও ভোট লড়তে যাচ্ছে বিজেপি।
রামমন্দির উদ্বোধনের সময়ে ৯৬ বছরের আডবাণীর ভূমিকা অস্বীকার করা যাবে না। আলোচনাতেও তিনি আছেন। কিন্তু আলোর বাইরে রয়ে গেলেন সাত জন। তাঁদের কেউ কেউ প্রয়াত।
মুরলীমনোহর জোশী
আডবাণীর প্রথম ও দ্বিতীয় দফায় বিজেপির সভাপতি হওয়ার মাঝে সেই পদে এসেছিলেন মুরলীমনোহর জোশী। আডবাণীর মতো তিনিও রথে চেপেছিলেন। তবে সেই রথের নাম ছিল ‘একতা যাত্রা’। সেই সময়ে রথ পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন মোদী। গত শতকের আশি এবং নব্বইয়ের দশকে বিজেপির ‘প্রফেসর’ বলা হত জোশীকে। ইলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যলয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক জোশী রাজনীতিতে আসার পরে মূলত গোরক্ষা আন্দোলনের নেতা হিসাবেই পরিচিত ছিলেন। বিজেপি সভাপতি হওয়ার পরে ১৯৯২ সালের জানুয়ারিতে জম্মু-কাশ্মীরে জাতীয় পতাকা তুলতে গিয়ে শোরগোল ফেলেছিলেন জাতীয় রাজনীতিতে। সেই বছরেরই ৬ ডিসেম্বর অযোধ্যাকাণ্ড। তাঁর সভাপতিত্ব কালেই করসেবা আন্দোলন। বিতর্কিত সৌধ ভেঙে পড়ার পরে দলের নেত্রী উমা ভারতীর সঙ্গে জোশীর উল্লাসের ছবি ছড়িয়ে পড়েছিল। চক্রান্তের অভিযোগে তাঁকে সিবিআই তদন্তের মুখোমুখি হতে হয়। আডবাণীর মতো ৯০ বছরের জোশীও এখন বিজেপির মার্গদর্শক মণ্ডলের সদস্য। যে বারাণসী থেকে এখন মোদী সাংসদ, পদ্মের সেই উর্বর ভূমি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রীর ‘মুখ’কে ছেড়ে দিয়েছিলেন জোশীই।
উমা ভারতী
এখন রাজনীতিতে তাঁর নাম বিশেষ শোনা যায় না। কিন্তু গেরুয়াবসনধারী উমা ভারতী রামমন্দির আন্দোলনের বড় মুখ হয়ে উঠেছিলেন। অযোধ্যা আন্দোলনকে বড় আকার দিতে রাজ্যে রাজ্যে ঘুরেছিলেন সুবক্তা হিসাবে পরিচিত উমা। মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীও হয়েছেন। তবে সাড়ে আট মাসের জন্য। একাধিক বার বিজেপির সাংসদ হয়েছেন। বাজপেয়ী সরকারে এবং মোদীর প্রথম সরকারে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও থেকেছেন। কিন্তু ২০১৯ সালে বিজেপি তাঁকে টিকিট দেয়নি। একটা সময়ে বিজেপির সঙ্গে উমার সম্পর্কে এমন জায়গায় গিয়েছিল যে, তিনি ২০০৬ সালে ‘ভারতীয় জনশক্তি পার্টি’ নামে নতুন দল গড়েন। যদিও সাফল্য না পেয়ে বিজেপিতে ফেরেন ২০১১ সালে।
সাধ্বী ঋতম্ভরা
বিজেপি নয়, সাধ্বী ঋতম্ভরা গেরুয়া শিবিরে পরিচিত হয়ে ওঠেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মুখ হিসাবে। ধর্মীয় প্রবচনের জন্য খ্যাতি ছিল। তার সঙ্গে রাজনীতি মেশানোর চমক দেখাতেন। সেই চমক বিজেপি কাজে লাগায় রামজন্মভূমি আন্দোলনে। পরবর্তী কালে বিজেপির নির্বাচনী প্রচারেও ঋতাম্ভরাকে দেখা গিয়েছে। হিন্দিভাষী রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনের বড় আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন ‘কথক’ ঋতাম্ভরা। ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরে অযোধ্যায় ছিলেন ঋতাম্ভরা। সৌধ ধ্বংসের দিন তিনেক পরে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। পরে জামিন পান।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অশোক সিঙ্ঘল
২০১৫ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হয়েছেন অশোক সিঙ্ঘল। তবে রামজন্মভূমি আন্দোলনের প্রধানদের মধ্যে তাঁর নামোচ্চারিত হয় আডবাণীর সঙ্গেই। তাঁকে ‘হিন্দুত্বের পুরোধা’ বলে গেরুয়া শিবির। আরএসএস প্রচারক হিসাবেই তিনি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নেতা হন ১৯৮১ সালে। ১৯৮৪ সালে সঙ্ঘ পরিবারের উদ্যোগে দিল্লিতে ‘ধর্ম সংসদ’ বসে। সেখানেই অযোধ্যা আন্দোলনকে বড় চেহারা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দায়িত্ব পান অশোক। তাঁর নেতৃত্বেই অযোধ্যায় জমায়েত হয় ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। সৌধ ধ্বংসের পরে অ্যাম্বুল্যান্সে চেপে পালিয়ে যান ঘটনাস্থল থেকে। তবে কট্টর হিন্দুত্ববাদী সিঙ্ঘলের সঙ্গে বিরোধিতা শুরু হয় বাজপেয়ী সরকারের। জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে সিঙ্ঘলের দাবি মেনে অযোধ্যা নিয়ে সরব হননি বাজপেয়ী। প্রতিবাদে অনশনেও বসেছিলেন সিঙ্ঘল।
প্রবীণ টোগাড়িয়া
রামজন্মভূমি আন্দোলন বা ১৯৯২ সালের ঘটনার সময়ে আলোচনায় ছিলেন না প্রবীণ টোগাড়িয়া। তখন তিনি ব্যস্ত গুজরাতের রাজনীতি নিয়ে। গেরুয়া শিবিরে মোদীর সমসাময়িক টোগাড়িয়া ১৯৮৩ সালে বিশ্ব হিন্দু পরিষদে যোগ দেন। পরের বছর বিজেপিতে যোগ দেন মোদী। টোগাড়িয়ার নাম জাতীয় রাজনীতিতে উচ্চারিত হতে শুরু করে ২০০২ সালে। গোধরাকাণ্ডের পর গুজরাত দাঙ্গায় তাঁর ‘প্রত্যক্ষ মদত’ ছিল বলে অভিযোগ ওঠে। এর পরে পরেই সিঙ্ঘল শারীরিক কারণে অবসর নিতে চাইলে পরিষদের দায়িত্ব পান টোগাড়িয়া। ২০১১ সালে তাঁকে পরিষদের আন্তর্জাতিক সভাপতি ঘোষণা করা হয়। রামমন্দিরের দাবিতে সুপ্রিম কোর্টে লড়াইয়েও বড় ভূমিকা ছিল তাঁর। ২০১৩ সালে অযোধ্যায় করসেবকদের নিয়ে ‘চৌরশি কোশি পরিক্রমা’ করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। তবে পরিষদের সঙ্গে মতান্তরে ২০১৮ সালে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। শোনা যায়, বিভিন্ন বিষয়ে হিন্দুত্ব নিয়ে তাঁর ‘কট্টর’ মন্তব্য ভাল চোখে দেখতেন না ‘সব কা সাথ’ স্লোগান তোলা মোদীর।
বিনয় কাটিয়ার
যে অযোধ্যায় রামমন্দির, সেই লোকসভা আসন থেকেই তিন বার সাংসদ হয়েছেন বিনয় কাটিয়ার। ১৯৯২ সালে অযোধ্যাকাণ্ডের সময়েও তিনিই ছিলেন সেখানকার সাংসদ। আরএসএস প্রচারক হিসাবে গেরুয়া শিবিরে কাজ শুরু করার পরে পরিবারের সংগঠন হিন্দু জাগরণ মঞ্চের দায়িত্বে ছিলেন কাটিয়ার। পরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অধীনে নতুন সংগঠন ‘বজরং দল’ তৈরি করেন। এই সংগঠনের জন্মই হয়েছিল মূলত রামজন্মভূমি আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ৬ ডিসেম্বর প্রথম সারিতে যে সব করসেবক ছিলেন, তাঁরা মূলত বজরং দলেরই সদস্য। গোটা দেশ থেকে তাঁদের অযোধ্যায় সংগঠিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা ছিল কাটিয়ারের। এখন অবশ্য মূল স্রোতের রাজনীতি থেকে অনেকটাই দূরে তিনি।
কল্যাণ সিংহ
রামমন্দির নির্মাণ আন্দোলনের আড়ালের সেনাপতি ছিলেন কল্যাণ সিংহ। তিনিই তখন উত্তরপ্রদেশে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী। তবে বিতর্কিত সৌধের সঙ্গে বছর দেড়েকের কল্যাণ সরকারও ভেঙে পড়ে। জারি হয় রাষ্ট্রপতি শাসন। তার পরেও ১৯৯৭ সালে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন কল্যাণ। বিতর্কিত সৌধ রক্ষা করতে না পারার দায় তাঁর উপরেই দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ফলে দেশের সর্বোচ্চ আদালত কল্যাণের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করে। বিজেপিতে পরবর্তী সময় সুখের হয়নি কল্যাণের। মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ১৯৯৯ সালে বিজেপি ছেড়ে ‘রাষ্ট্রীয় ক্রান্তি পার্টি’ গঠন করেন। সাফল্য পাননি। ২০০৪ সালে ফিরে আসেন বিজেপিতে। ২০০৯ সালে আবার দল ছেড়ে মুলায়ম সিংহ যাদবের ঘনিষ্ঠ হন। নির্দল হয়ে লোকসভায় যান। কিন্তু ২০১০ সালে আবার নতুন দল ‘জনক্রান্তি পার্টি’ গঠন। সেই দল ২০১৩ সালে বিজেপিতে মিশে যায়। কল্যাণও ফের ফেরেন বিজেপিতে। তবে আর ভোটে লড়েননি। তাঁর আসন এটাওয়া থেকে কল্যাণ-পুত্র রাজবীর সিংহকে সাংসদ করে বিজেপি। ২০২১ সালে প্রয়াত হন কল্যাণ। তার আগে অবশ্য রাজস্থান ও হিমাচল প্রদেশের রাজ্যপাল হয়েছিলেন তিনি।