২০১৯ সালের আসন্ন লোকসভা নির্বাচনের আগে আগামী ১লা ফেব্রুয়ারি শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট পেশ করবেন অরুণ জেটলি। ভোটের আগের বাজেট, তাই অন্তত দেখাতে হবে যে সরকার কত জনদরদী। তা ছাড়াও আর্থিক গতিপ্রকৃতি যে দিকে যাচ্ছে, তাতে দেশের মানুষ ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন যে— ‘আচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতি, অমিত শাহের ভাষায় আদতে একটি নির্বাচনী ‘জুমলা’ ছাড়া কিছু নয়।
যেমন ধরা যাক আর্থিক বৃদ্ধির হারের কথা। দেশের কেন্দ্রীয় পরিসংখ্যান দফতরের আগাম অনুমান বলছে যে আর্থিক বৃদ্ধির হার (গ্রস ভ্যালু অ্যাডেড বা জিভিএ-র নিরিখে) ২০১৭-১৮ আর্থিক বর্ষে কমে হবে ৬.১%, যা ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৬.৬% এবং ২০১৫-১৬ সালে ছিল ৭.৯%।
এর মধ্যে যদি কৃষি ক্ষেত্রের দিকে তাকাই তা হলে সমস্যা আরও মারাত্মক। কারণ, কৃষিতে ২০১৭-১৮ সালে বৃদ্ধির হার মাত্র ২.১%, যা ২০১৬-১৭ সালে ছিল ৪.৯%। মনে রাখতে হবে যে এখনও দেশের প্রায় ৫০% মানুষ কৃষি ক্ষেত্রের উপরে নির্ভরশীল। সেই ক্ষেত্রে আর্থিক বৃদ্ধির হার কমা মানে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের মানুষের আয়ে টান পড়া। এই কৃষি সমস্যার রাজনৈতিক প্রতিফলন ঘটেছে মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান-সহ বিভিন্ন রাজ্যে ব্যাপক কৃষক অসন্তোষ ও আন্দোলনে। এই আন্দোলন সরকারের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দ্বিতীয় যে সমস্যার জায়গাটি তৈরি হয়েছে তা হল কর্মসংস্থান। প্রধানমন্ত্রী কয়েক দিন আগে অবধিও বলতেন ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’র কথা, এখন বলছেন যে পাকোড়া বিক্রি করে যারা সংসার চালাচ্ছে তারাও কর্মরত। দিদির তেলেভাজা শিল্পের তত্ত্বে মোদী অনুপ্রাণিত হয়েছেন বলে নিন্দুকেরা বলছে। কিন্তু তথ্য কী বলছে? কেন্দ্রীয় শ্রম দফতরের রিপোর্ট বলছে যে— ২০১৩-১৪ সালে ভারতে মোট কর্মরত মানুষের সংখ্যা ছিল ৪৮ কোটি। কিন্তু ২০১৫-১৬ সালে তা কমে হয়েছে ৪৬.৭ কোটি। অর্থাৎ এক কোটির বেশি মানুষ এই কয়েক বছরে কাজ হারিয়েছেন। আচ্ছে দিন বোধহয় একেই বলে। কিন্তু ভারতীয় স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ও আর এক অধ্যাপক প্রভিডেন্ট ফান্ডের তথ্য ঘেঁটে বলছেন যে, বছরে নাকি ৫৫ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে, তাও শুধুমাত্র সংগঠিত ক্ষেত্রে। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই তথ্য জাহির করছেন।
আরও পড়ুন: শেয়ার বাজার: কিছু প্রশ্ন, প্রত্যাশা, কিছু পরামর্শ
পরিসংখ্যান নিয়ে বিবিধ প্রকারের জাগলিং করে সত্যের অপলাপ কী ভাবে করতে হয় তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ এই তথ্যটি। স্টেট ব্যাঙ্কের মুখ্য অর্থনীতিবিদ দেখেছেন যে গত দুই বছরে প্রভিডেন্ট ফান্ডের নির্দিষ্ট সংস্থায় (EPFO) নতুন নাম লিখিয়েছেন কত জন। তার ভিত্তিতে তিনি কর্মসংস্থান মাপছেন। আসলে, যে কোনও সংস্থাতে ২০ জনের বেশি কর্মী নিয়োগ করলেই তাকে EPFO-তে নথিভুক্ত করতে হবে। এই নথিভুক্তিকরণ বেড়েছে। ধরুন আপনার সংস্থায় আগে ১৯ জন কাজ করতেন, এই বছর ১টি কর্মসংস্থান তৈরি হওয়ার ফলে ২০ জন হয়েছে। আপনার সংস্থাকে ফলত EPFO-তে নথিভুক্ত করতে হবে। আপনি বলবেন মাত্র একটি নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু স্টেট ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদ বলবেন— না, সংখ্যাটি ২০! এই আজগুবি গল্প তাঁরা মানুষকে খাওয়াতে চাইছেন। সত্য হল এই যে— নোট বাতিলের পরে EPFO-তে নথিভুক্তিকরণ বেড়েছে, যার ফলে সরকারি অর্থনীতিবিদদের মনে হচ্ছে যে কর্মসংস্থান বেড়েছে! কিন্তু আসলে কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রেও সাধারণ মানুষের হাতে রয়েছে পেনসিল!
ক্রমান্বয়ে হ্রাসমান বিনিয়োগের হার বিজেপি সরকারের তৃতীয় সমস্যা। ২০১৩-১৪ সালে ভারতের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের (জিডিপি-র) অনুপাতে বিনিয়োগের হার ছিল ৩১.৩%, যা ২০১৭-১৮তে কমে ২৯% হবে বলে অনুমান। ভারতের অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে যেই বেসরকারি সংস্থা সর্বাধিক তথ্য সংগ্রহ করে, সেই সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি জানাচ্ছে যে— নতুন বিনিয়োগ ঘোষণা গত ১৩ বছরে সর্বনিম্ন। এই পরিস্থিতির প্রধান কারণ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় অনাদায়ী ঋণের সমস্যা। বর্তমানে, প্রায় ৮ লক্ষ কোটি টাকা অনাদায়ী ঋণ রয়েছে, যার অধিকাংশ আছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে। অনাদায়ী ঋণের এই বোঝা নিয়ে ব্যাঙ্কগুলির পক্ষে নতুন ঋণ দেওয়া মুশকিল হয়ে গেছে, যার ফলে বিনিয়োগে ভাটার টান। অন্য দিকে, নোট বাতিলের ভ্রান্ত নীতি ও তড়িঘড়ি জিএসটি লাগু করার ফলে বাজারে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ তৈরি হয়েছে, যেখানে বিনিয়োগকারীরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না।
তদুপরি, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ছে। মোদী যখন ক্ষমতায় এসেছিলেন তখন অপরিশোধিত তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলারের বেশি ছিল, যা কয়েক মাসের মধ্যে অর্ধেক হয়ে যায়। এর ফলে সরকারের দুটি লাভ হয়। প্রথমত, যেহেতু ভারত তেল আমদানি করে, তেলের দাম কম থাকায় বাণিজ্য ঘাটতিতে খুব বেশি চাপ পড়েনি। কিন্তু আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি বাড়ছে, যা আর্থিক বৃদ্ধির হারকেও কমাতে পারে। দ্বিতীয়ত, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমলেও, সাধারণ গ্রাহকেরা সেই কমতে থাকা দামের কোনো সুবিধা পাননি, কারণ সরকার উৎপাদন শুল্ক বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় করেছে। তেলের দাম কমলেও প্রায় একই দামে পেট্রোল পাম্পে মানুষকে তেল কিনতে হয়েছে। কিন্তু ইতিমধ্যেই বাজারে তেলের দাম বেশ কিছুটা বেড়েছে। কলকাতায় বিগত ৬ মাসে দাম বেড়েছে ৬ টাকারও বেশি। এই পরিস্থিতিতে তেলের উপরে উৎপাদন শুল্কের হার না কমিয়ে, সাধারণ মানুষের পকেট কেটে, সরকারের ভাঁড়ারে টাকা তোলা রাজনৈতিকভাবে সম্ভব নয়। তা ছাড়া তেলের দাম বাড়লে সার্বিকভাবে মূদ্রাস্ফীতিও বাড়বে। তাই সরকারি পরিসরে ইতিমধ্যেই তেলের উপর উৎপাদন শুল্ক কমানোর কথা চলছে। উৎপাদন শুল্ক কমালে, সরকারের রাজস্ব আদায় কমবে, যা সরকারের বাজেটে সমস্যা তৈরি করবে।
এখানেই এই বছরের বাজেটের প্রধান সমস্যা সরকারকে মোকাবিলা করতে হবে। এক দিকে, নিম্নগামী আর্থিক বৃদ্ধির হার, কৃষি সংকট, হ্রাসমান বিনিয়োগ ইত্যাদির থেকে বেরোতে হলে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। কিন্তু লাগামহীন খরচ করলে সরকারের আর্থিক ঘাটতি বেড়ে যাবে। তদুপরি তেলের উৎপাদন শুল্ক কমালে রাজস্ব আদায় কমবে। তথ্য বলছে যে ২০১৭ সালে অর্থমন্ত্রী আর্থিক ঘাটতির যে লক্ষ্য মাত্রা নির্ধারণ করেছিলেন যা অতিক্রমিত হয়েছে নভেম্বর মাসেই। অতএব, সরকারকে যদি আর্থিক ঘাটতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হয়, তবে খরচ কমানো ছাড়া কোনও উপায় নেই। কিন্তু খরচ কমালে সাধারণ মানুষের উপরে আর্থিক বোঝা বাড়বে, যা রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনের আগে বিজেপির চিন্তা বাড়াবে।
আর্থিক ঘাটতির এই দুরবস্থা হওয়ার প্রধান কারণ হলো রাজস্ব আদায় আশানুরূপ হয়নি। যেই জিএসটি লাগু করে সরকার মনে করেছিল যে ভারতের আর্থিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হল, সেই পণ্য ও পরিষেবা কর থেকে রাজস্ব আদায় লাগাতার কমছে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে ৯২,২৮৩ কোটি টাকা কর সংগ্রহ হয়েছিল যা নভেম্বর মাসে কমে হয়েছে ৮০,৮০৮ কোটি টাকা। অন্য দিকে, কর ব্যতিরেকে যে রাজস্ব আদায় হয়, তা মুখ থুবড়ে পড়েছে। এক দিকে, রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডিভিডেন্ড বাবদ আয় কমেছে ৩০,০০০ কোটি টাকা। অন্য দিকে, স্পেক্ট্রাম বিক্রি করে যত টাকা আয় হবে বলে সরকার ভেবেছিল, তা হয়নি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ডিভিডেন্ড কমার জন্য সরাসরি দায়ী নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত। নোট বাতিলের ফলে মানুষ যে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যাঙ্কে জমা রেখেছিলেন, তাতে ব্যাঙ্কগুলিকে সুদ গুনতে হয়েছে, যা তাদের দিয়েছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। তদুপরি, নতুন নোট ছাপাতে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বহু টাকা খরচ হয়েছে। এই দুইয়ে মিলে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের খরচ বাড়িয়েছে, তাই তাদের মুনাফা কমেছে, যার থেকে সরকারকে প্রদেয় ডিভিডেন্ডের পরিমাণও কমেছে।
প্রশ্ন হল, সুদিন আনবে বলে নরেন্দ্র মোদী সরকার ভারতের অর্থব্যবস্থার যে করুণ দশা করেছে, তার থেকে বেরোনোর উপায় কী? স্নাতক স্তরের ছাত্র-ছাত্রীরাও বলে দেবেন যে হ্রাসমান বিনিয়োগ ও বৃদ্ধির হার, কৃষি সংকট, কর্মহীনতা থেকে বেরিয়ে অর্থব্যবস্থাকে আবার চাঙ্গা করতে হলে সরকারি খরচ (বিশেষ করে বিনিয়োগ) বাড়ানো ব্যতিরেকে আর কোনও উপায় নেই। এর জন্য যদি সরকারের আর্থিক ঘাটতি বাড়াতে হয় তাতেও কোনো ক্ষতি নেই, বরং বৃদ্ধির হার ও কর্মসংস্থান বাড়ার মাধ্যমে লাভই হবে। স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ জন মেয়ানার্ড কেইন্সের এটিই প্রধান শিক্ষা। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বহু বছর ধরেই যে আর্থিক নীতি নিয়ে চলেছে তাতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ানোর কোনও জায়গা নেই। কারণ আর্থিক ঘাটতি বাড়লে বেসরকারি পুঁজি, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক পুঁজি, রুষ্ট হয়, মুডিজের রেটিং কমে, শেয়ার বাজারে ফাটকাবাজি কমে শেয়ারের দর পড়ে যায়, ইত্যাদি। তাই এই বাজেটেও সরকার আর্থিক ঘাটতির হার বাড়াবে না।
সাধারণ মানুষের জন্য মোদী প্রতিশ্রুত সুদিন আসেনি, এবং অর্থব্যবস্থার যা গতিপ্রকৃতি ভবিষ্যতেও আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। কিন্তু দেশের ধনী ও পুঁজিপতিদের জন্য সুদিন এসে গেছে। অক্সফ্যামের মত আন্তর্জাতিক সংস্থা জানাচ্ছে যে ২০১৭ সালে দেশে মোট যত সম্পদ সৃষ্ট হয়েছিল তার ৭৩% কুক্ষিগত করেছে ভারতের ১% সর্বাধিক ধনী ব্যক্তিরা। এক দিকে, দেশের কৃষকরা ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা করবে, আর এক দিকে, ধনীরা সমস্ত সম্পদ কুক্ষিগত করবে, এই ব্যবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। সরকার মানুষকে যদি সত্যি সুদিন দেখাতে চান, তবে, তাদের উচিত এই উচ্চ ধনী ব্যক্তিদের উপরে বাড়তি কর চাপিয়ে রাজস্ব সংগ্রহ করে তা সাধারণ মানুষের কল্যাণে খরচ করা। যেহেতু কর সংগ্রহের মাধ্যমে সরকারি খরচ বাড়ানো হবে, এতে আর্থিক ঘাটতি বাড়ার কোনও সম্ভাবনাও থাকবে না। কিন্তু, আদানি-আম্বানি-বাজাজ-গোয়েঙ্কাদের সম্পত্তির উপরে কর চাপিয়ে তা দিয়ে মানুষের কল্যাণ করা বিজেপি’র পক্ষে সম্ভব নয়। যেই সরকার ক্ষুধার সূচকে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের ভয়াবহ পরিস্থিতিকে পাত্তা না দিয়ে, বিশ্বব্যাঙ্কের ব্যবসা করার সুবিধার নিরিখে ভারতের স্থান উন্নত হওয়ায় গর্ব প্রকাশ করে, তারা ব্যবসায়ী ও পুঁজিপতিদের উপরে কর বসাবে না। অতএব, সুদিনের প্রতিশ্রুতি, নির্বাচনী ময়দানে গালভরা বক্তৃতাতেই সীমাবদ্ধ থাকবে। সাধারণ মানুষকে জীবন-জীবিকার সন্ধানে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে, বাজেট আসবে, বাজেট যাবে।
গ্রাফিক্স: শৌভিক দেবনাথ