পুরুলিয়ায় গ্রামের বাড়িতে নিহত জওয়ান বিশ্বরূপ মাহাতোর মা ভাগ্য মাহাতো। ছবি: সুজিত মাহাতো
খবরটা প্রথমে পুরোপুরি বিশ্বাস হয়নি অনেকের। তখনও ভাবছিলেন, মাওবাদী হামলা নয়তো? কারণ রাজ্যটা ছত্তীসগঢ়, জেলা নারায়ণপুর। মাওবাদীদের মোকাবিলা করতেই তো সেখানে রয়েছে আধাসেনার ছাউনি!
একটু পরেই জানা গেল, মাওবাদী হানা আদৌ নয়। নারায়ণপুরের কাদেনার গ্রামে ভারত-তিব্বত সীমান্ত পুলিশ (আইটিবিপি)-এর ছাউনিতে পাঁচ জওয়ানকে গুলি করে মেরেছেন তাঁদেরই এক বাঙালি সহকর্মী। মাসাদুল রহমান (৩২) নামে হামলাকারী জওয়ানও গুলিতে মারা গিয়েছেন। আরও পরে জানা যায়, নিজের ওই সার্ভিস রাইফেলের গুলিতেই আত্মঘাতী হয়েছেন নদিয়ার নাকাশিপাড়ার বাসিন্দা মাসাদুল। তাঁর গুলিতে নিহতদের মধ্যে রয়েছেন দুই বাঙালি কনস্টেবল। এক জন পুরুলিয়ার আড়শার বিশ্বরূপ মাহাতো (২৫)। অন্য জন, পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর সুরজিৎ সরকার (২৭)।
নিহত অন্য জওয়ানদের মধ্যে আছেন হেড কনস্টেবল মহেন্দ্র সিংহ, হেড কনস্টেবল দলজিৎ সিংহ, কনস্টেবল বিজীশ। এস বি উল্লাস এবং সীতারাম দুন নামে দুই কনস্টেবল গুলিতে আহত হয়েছেন। হেলিকপ্টারে প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরে রায়পুরে এনে চিকিৎসা চলছে তাঁদের। মহেন্দ্রর বাড়ি হিমাচলের বিলাসপুরে, দলজিতের পঞ্জাবের লুধিয়ানায়, বিজীশ কেরলের বাসিন্দা।
আরও পড়ুন: কেন খুন? উত্তর হাতড়াচ্ছে ২ জওয়ানের বাড়ি
ঘাতক: মাসাদুল রহমান
আইটিবিপি-র ৪৫ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ওই ছাউনিতে ঘটনাটি ঘটে বুধবার সকাল সাড়ে ৮টায়, জানাচ্ছেন বস্তার রেঞ্জের আইজি সুন্দররাজ পি। কিন্তু ঘটনার কারণ কী, সেই স্পষ্ট উত্তর নেই। ছত্তীসগঢ় পুলিশ সূত্রের খবর, মাসাদুলের সঙ্গে অন্য কয়েক জন জওয়ানের বচসা বেধেছিল। তর্কাতর্কি থেকেই গুলি চলে। সুন্দররাজ অবশ্য বলেছেন, ‘‘অজানা কোনও বিরোধের জেরে নিজের আগ্নেয়াস্ত্র থেকে গুলি চালান কনস্টেবল মাসাদুল। চার জন ঘটনাস্থলেই মারা যান। এক জন মারা যান পরে।’’ মাসাদুলকে অন্য জওয়ানেরা গুলি করেছিলেন কি না, গোড়ায় তা নিয়ে একটা অস্পষ্টতা ছিল। পরে দিল্লিতে আইটিবিপি-র মুখপাত্র বিবেককুমার পাণ্ডে বলেন, নিজের বন্দুকের গুলিতেই মারা গিয়েছেন মাসাদুল। চিকিৎসাধীন দুই জওয়ানের কাছ থেকে এ বিষয়ে পরে কিছু জানা যাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
মন্ত্রিসভায় ছাড়পত্র পেলেও সংসদে কবে পেশ হবে নাগরিকত্ব বিল তা নিয়ে নাটক জারি
দুপুরের মধ্যেই বজ্রাঘাতের মতো খবরটা পৌঁছতে শুরু করে নিহত জওয়ানদের পরিবারের কাছে। পুরুলিয়ার আড়শার বিশ্বরূপ ছিলেন কৃষক পরিবারের ছেলে। পরিবারে বাবা-মা, তিন ভাই, এক বৌদি ও ভাইঝি। বছর দেড়েক আগে ছত্তীসগঢ়ের এই ছাউনিতে পোস্টিং পেয়েছিলেন বিশ্বরূপ। তবে সেখানে কোনও সমস্যা ছিল বলে তাঁর দাদা আশিস মাহাতোর জানা নেই।
নিহত সুরজিতের বাড়ি পূর্ব বর্ধমানের পূর্বস্থলীর শ্রীরামপুরে। বাড়িতে বাবা-মা আছেন। বোনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। পলিটেকনিক পড়তে পড়তেই আইটিবিপি-তে চাকরি পান সুরজিৎ। তিনিও গত দেড় বছর ধরে ছিলেন নায়ায়ণপুরে।
দুপুরে খবরটা পাওয়ার পর থেকে নদিয়ার নাকাশিপাড়ার বিলকুমারী গ্রাম জুড়ে একটাই প্রশ্ন— কী এমন হয়েছিল? ওই গ্রামেই সচ্ছল পরিবার মাসাদুলদের। কাঁদতে কাঁদতে মাসাদুলের মা হানিফা বেগম বলছিলেন, ‘‘খবর শুনে ছেলের মোবাইলে ফোন করি। কেউ ফোন ধরে বলে, ছেলে ডিউটিতে গিয়েছে।’’
মাসাদুলেরা চার ভাই, তিন বোন। বড়দা মনিরুল সৌদি আরবে সিভিক পুলিশে কাজ করতেন। মাস তিন-চারেক আগে বাড়ি এসেছেন। মেজদা মিজান ব্যবসায়ী। তিন বোনেরই বিয়ে হয়ে গিয়েছে। মাসাদুল সেজো ছেলে। বাবা মারফত আলি শেখ ছিলেন রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল। ছোট থেকেই খেলাধুলোয় দক্ষ মাসাদুল ২০০৮ সালে আইটিবিপি-তে চাকরি পান। তাঁর ছোট ভাই মাজারুল সিআরপি জওয়ান। নদিয়ার এই এলাকা থেকে সেনা-আধাসেনায় যোগ দেওয়ার চল আছে। বিলকুমারীর জনা পনেরো-কুড়ি ছেলে বিভিন্ন বাহিনীতে আছেন।
টানা এক বছর পরে, আগামী মাসে বাড়ি আসার কথা ছিল মাসাদুলের। তখন তাঁর বিয়েরও কথা ছিল। মাসাদুলের মা বলেন, ‘‘দশ দিন আগে ছেলের সঙ্গে শেষ কথা হয়েছিল। সব সময়েই বলত, ‘ছুটি কম। অনেকে এক-দু’বছর ছুটি পায়নি। বাড়িও যেতে পারেনি। চিন্তা কোরো না। ঠিক চলে আসব’।’’ মাসাদুলের বাবা বলেন, ‘‘ছেলে এ রকম কাজ করতে পারে না। এই ঘটনার তদন্ত হোক।’’ বন্ধুরাও বলছেন, মাসাদুল ঠান্ডা মাথার ছেলে। কোনও দিন কারও সঙ্গে ঝুটঝামেলা হয়নি তাঁর। বাল্যবন্ধু রামিজ শেখের কথায়, ‘‘ও এমন করতে পারে বলে বিশ্বাস হয় না।’’ তা হলে কেন ঘটল এমন? উত্তর খুঁজে চলেছেন সবাই।
মনোচিকিৎসক সুজিত সরখেলের মতে, অত্যধিক চাপের কাজে অনেক সময়ে কারও-কারও পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা চলে যায়। তখন তাঁর মনে এমন একটা আচমকা বিস্ফোরণ হয় যা তাঁর স্বভাবজাত নয়। সেই অবস্থায় তিনি যা খুশি করে ফেলতে পারেন। পুলিশ বা সেনাবাহিনীর লোকেদের ক্ষেত্রে এই রকম অবস্থায় হাতের কাছে আগ্নেয়াস্ত্র থাকাটা আরও মারাত্মক হয়ে ওঠে।
আজই লোকসভায় সরকার জানিয়েছে, গত ৯ বছরে সশস্ত্র বাহিনীতে ১১১৩টি আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করা হচ্ছে। মনোবিদ নীলাঞ্জনা সান্যালের মতে, জনবিরল, বিপদসঙ্কুল এলাকায় দিনের পর দিন মনোরঞ্জনের উপকরণ ছাড়া, ছুটি ছাড়া, পরিজনদের থেকে দূরে কাটাতে কাটাতে কেউ মুহূর্তের জন্য চূড়ান্ত ধৈর্যহীন হয়ে পড়তে পারেন। তখন নিজের উপরেও নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কী করে ফেলবেন, তিনি নিজেও এক সেকেন্ড আগে বুঝতে পারেন না।
হয়তো এমনই কিছু হয়েছিল মাসাদুলের, হয়তো...।
(সহ প্রতিবেদন: কেদারনাথ ভট্টাচার্য)