বাঁধভাঙা স্রোতেই বিপর্যয়

লাইন ভেঙে ঝুলে ছিটকে পড়ল দুই ট্রেন, মৃত ২৭

সংসদে এমনিতেই নাজেহাল শাসক শিবির। তারই মধ্যে জোড়া রেল দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু নতুন অস্বস্তি ডেকে আনল নরেন্দ্র মোদী সরকারের। গত রাতে মধ্যপ্রদেশের হারদা টাউনের কাছে একটি ছোট সেতু ভেঙে আপ ও ডাউন লাইনের দু’টি ট্রেন প্রায় একই সঙ্গে লাইনচ্যুত হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে রেলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৬ অগস্ট ২০১৫ ০৩:২৫
Share:

লাইনচ্যুত সেই ট্রেন। ছবি: পিটিআই।

সংসদে এমনিতেই নাজেহাল শাসক শিবির। তারই মধ্যে জোড়া রেল দুর্ঘটনায় অন্তত ২৭ জনের মৃত্যু নতুন অস্বস্তি ডেকে আনল নরেন্দ্র মোদী সরকারের। গত রাতে মধ্যপ্রদেশের হারদা টাউনের কাছে একটি ছোট সেতু ভেঙে আপ ও ডাউন লাইনের দু’টি ট্রেন প্রায় একই সঙ্গে লাইনচ্যুত হওয়ায় প্রশ্ন উঠেছে রেলের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে। উপরন্তু, লাইনের নিরাপত্তার প্রশ্নে বিভিন্ন রাজ্য সরকারের সঙ্গে রেল মন্ত্রকের সমন্বয় রাখার বিষয়টি যথাযথ ভাবে হচ্ছে কি না, সে প্রশ্নও তুলেছেন বিরোধীদের কেউ কেউ।

Advertisement

রেল মন্ত্রকের বক্তব্য, প্রবল জলের তোড়ে সেতু ভেঙে লাইন উপড়ে গিয়ে দু’দিক থেকে আসা দু’টি ট্রেনের দুর্ঘটনাগ্রস্ত হওয়ার মতো ঘটনা স্মরণকালে ঘটেনি। একমাত্র জ্ঞানেশ্বরী কাণ্ডের সঙ্গে এর কিছুটা মিল রয়েছে। নাশকতার কারণে পাশের লাইনে উল্টে যাওয়া জ্ঞানেশ্বরীকে ধাক্কা মেরেছিল একটি মালগাড়ি। গত রাতে ভোপাল থেকে ১৬০ কিলোমিটার দূরে হারদা টাউনের কাছে মেচক নদীর উপরে ওই কালভার্ট গোছের ছোট সেতুটির উপরে প্রথমে দুর্ঘটনার শিকার হয় মুম্বই থেকে বারাণসীগামী কামায়নী এক্সপ্রেস। বেলাইন হয়ে যায় এগারোটি কামরা। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই উল্টো দিক থেকে এসে পড়ে পটনা থেকে মুম্বইগামী জনতা এক্সপ্রেস। মুহূর্তে লাইনচ্যুত হয় তার ইঞ্জিন ও তিনটি কামরা। নদী তখন ফুঁসছে।

প্রথমে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিংহ চৌহান জানিয়েছিলেন, মৃতের সংখ্যা ২৫। পরে আরও দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তবে স্থানীয় মানুষ ও উদ্ধারকারী দল রাতেই প্রায় ৩০০ যাত্রীকে উদ্ধার করেছিলেন। কেউ ভেসে গিয়েছেন কি না, খুঁজে দেখা হচ্ছে।

Advertisement

কী ভাবে ঘটল দুর্ঘটনা?

রেল মন্ত্রক দায়ী করেছে হড়পা বানকে। রেল বোর্ডের চেয়ারম্যান এ কে মিত্তল জানান, ওই কালভার্টের কাছাকাছি একটি বাঁধ ছিল। কয়েক দিন ধরে প্রবল বৃষ্টিপাতের ফলে গত রাতে বাঁধটি ভেঙে যায়। তীব্র জলস্রোত বইতে শুরু করে ওই কালভার্ট ও সংলগ্ন এলাকার লাইনের উপর দিয়ে। রেল কর্তাদের সন্দেহ, স্রোতের তীব্রতায় রেললাইনের তলার মাটি ও পাথর ধুয়ে যায়। স্রেফ স্লিপার-সহ লাইনের কঙ্কাল ঝুলছিল নদীর উপরে। তা-ও জলের ধাক্কায় আপ লাইনটি সম্ভবত দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কোনও মতে টিকে ছিল ডাউন লাইন। সেই কারণেই ওই ঝুলন্ত লাইনের উপর দিয়ে কামায়নী এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন ও প্রথম দশটি কামরা কোনও মতে বেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তার পর আর লাইনটি ট্রেনের বিপুল ভার নিতে পারেনি। ডাউন লাইন ভেঙে পড়তেই বেলাইন হয়ে যায় কামায়নীর বাকি ১১টি কামরা। আর আপ লাইন তো আগেই দু’টুকরো হয়ে ছিল। ফলে জনতা এক্সপ্রেসের ইঞ্জিন সেই অংশ পার হতেই হুড়মুড়িয়ে বেলাইন হয়ে পড়ে। প্রাথমিক ভাবে মন্ত্রক দুর্ঘটনার এই ব্যাখ্যা দিলেও, সরকারি ভাবে এর কারণ খোঁজার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে কমিশনার অব রেলওয়ে সেফটিকে। দু’সপ্তাহের মধ্যে তদন্ত-রিপোর্ট জমা দিতে বলা হয়েছে।

রেল বোর্ডের চেয়ারম্যানের দাবি, দুর্ঘটনার ঠিক দশ মিনিট আগেও আপ ও ডাউন লাইন দিয়েই নির্বিঘ্নে ট্রেন গিয়েছে। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন উঠেছে একাধিক। প্রথমত, ওই লাইন ও সেতুর যথাযথ নজরদারি ও রক্ষণাবেক্ষণ হতো কি না। রেলের দাবি, কালভার্ট মোটেই জীর্ণ ছিল না। লাইনও ঠিক ছিল। কিন্তু এ ভাবে যে জলস্রোত আসতে পারে, সে বিষয়ে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না।

এখানেই দ্বিতীয় প্রশ্ন— কেন ছিল না? বিশেষ করে রেললাইনের অদূরে যখন একটি বাঁধ রয়েছে, তখন সেটি ভাঙলে যে এ ভাবে হড়পা বান আসতে পারে, সে বিষয়ে কি কোনও হোমওয়ার্ক ছিল না রেলের? রেললাইনের উপর দিয়ে যাওয়া বিদ্যুতের হাইটেনশন তারের হাল-হকিকত সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকা বা মাওবাদী প্রভাবিত রাজ্যের পুলিশের কাছ থেকে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করাটা রেলেরই দায়িত্ব। একই ভাবে হারদা-র ওই বাঁধটির নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছিল কি না, বাঁধের জলস্তর ফি-দিন কোন উচ্চতায় থাকছিল, সে ব্যাপারে মধ্যপ্রদেশ সরকারের সঙ্গে রেলের নিয়মিত তথ্য বিনিময় হতো কি? প্রশ্ন কিন্তু উঠেছে।

তৃতীয়ত, গোটা দেশের ৬৪ হাজার কিলোমিটার রেললাইনের উপরে এই ধরনের বহু ছোট সেতু বা কালভার্ট রয়েছে। প্রবল বৃষ্টিপাত হলে সেই জায়গাগুলিতেও এমন ঘটনা যে ঘটবে না, তার নিশ্চয়তা কী? তবে রেল মন্ত্রক সূত্রের খবর, এই ধরনের বিপজ্জনক সেতু সম্পর্কে কোনও তথ্য রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

প্রশ্ন এ-ও উঠেছে, কামায়নী এক্সপ্রেসের চালক যখন বুঝতে পারলেন তাঁর ট্রেন দুর্ঘটনার শিকার, তখন তিনি কেন তৎক্ষণাৎ সেই তথ্য নিকটবর্তী স্টেশনে জানালেন না? সে ক্ষেত্রে জনতা এক্সপ্রেসের দুর্ঘটনা রোখা সম্ভব হতো। মন্ত্রকের বক্তব্য, সাধারণত ট্রেন দুর্ঘটনায় পড়লে চালক ও গার্ড তা নিকটবর্তী স্টেশন মাস্টারকে জানিয়ে দেন। কিন্তু দুর্ঘটনার পরে ধাতস্ত হয়ে সেই খবর পাঠাতেও কিছুটা সময় লাগে। রেলমন্ত্রীর কথায়, ‘‘কামায়নী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়ার ঠিক সঙ্গে সঙ্গেই অন্য ট্রেনটি পাশের লাইনে চলে আসে। ফলে সেটিও দুর্ঘটনার শিকার হয়।’’ মন্ত্রকের দাবি, অন্য ট্রেনটিকে সতর্ক করার সময়টুকু পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তা হলে হয়তো দ্বিতীয় দুর্ঘটনাটি রোখা সম্ভব হতো।

এর আগে উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলের রঙ্গিয়া ডিভিশনে এক বার এই রকমের হড়পা বানে রেল লাইন ভেঙে দুর্ঘটনা ঘটেছিল। ২০০৭ সালের ২০ অগস্ট রৌরকেলার কাছে কাজলি নালার হড়পা বানে লাইনচ্যুত হয়েছিল একটি মালগাড়ির ইঞ্জিন ও ৮টি ওয়াগন। আচমকা এতটাই জল এসেছিল যে, ওয়াগনের মাথায় উঠে প্রাণে বেঁচেছিলেন চালক ও গার্ড।

ছবি: রয়টার্স।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement