২৬ নভেম্বর, ২০০৮। আজ থেকে ঠিক দশ বছর আগে সন্ত্রাসের বিষাক্ত ছোবলে রক্তাক্ত হয়েছিল ভারত। চার দিন ধরে মুম্বই শহর জুড়ে দশ জঙ্গির সেই হামলা বদলে দিয়েছিল নিরাপত্তার সামগ্রিক ধারণাই। সন্ত্রাসের বলি হয়েছিলেন মোট ১৬৪ জন নিরপরাধ মানুষ। আহত হয়েছিলেন ৩০৮ জন।
পাকিস্তান থেকে আরব সাগর পেরিয়ে মুম্বইতে হাজির হয়েছিল দশ জঙ্গি। কেউ কিছু বোঝার আগেই তারা ছড়িয়ে পড়েছিল মুম্বইয়ের লিওপোল্ড কাফে, নরিম্যান হাইস, তাজ হোটেল, ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনাস, ট্রাইডেন্ট হোটেল, কামা হাসপাতাল-সহ শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়। তার পরই শুরু হয়েছিল নির্বিচারে গুলিবর্ষণ।
তদন্তে জানা যায়, পাকিস্তান থেকে এই হামলার ষড়যন্ত্র করেছিল জঙ্গি সংগঠনলস্কর-ই তইবা। বাকি জঙ্গিরা নিহত হলেও ভারতীয় নিরাপত্তারক্ষীদের অসীম সাহসিকতায় ধরে ফেলা সম্ভব হয় আজমল কাসভকে। তার কাছ থেকেই জানা যায় হামলার খুঁটিনাটি। প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে পাকিস্তান জানায় কাসভের বাড়ি ও দেশেই।
২৬ নভেম্বর শুরু হয়েছিল হামলা। ২৮ নভেম্বর সকালেই সন্ত্রাসের কবল থেকে মুম্বইকে মুক্ত ঘোষণা করেন নিরাপত্তারক্ষীরা। শুধু তাজ হোটেলে তখনও নিধনযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছিল জঙ্গিরা। তাজ হোটেলকে জঙ্গিমুক্ত করতে ২৯ নভেম্বর ‘অপারেশন ব্ল্যাক টর্নেডো’ অভিযান চালান ভারতীয় এনএসজি কম্যান্ডোরা। মারা যায় বাকি জঙ্গিরা। শেষ হয় মুম্বই হামলা।
তদন্তে জানা যায়, পাক অধিকৃত কাশ্মীরের মুজফফরাবাদের পাহাড়ি এলাকায় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল জঙ্গিদের।হামলাকারী দশ জনকেই আত্মঘাতী জঙ্গি হিসেবে তৈরি করেছিল লস্কর-ই-তইবা। আর এই প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল পাক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর নেতৃত্বেই।
রাত সাড়ে ন’টার সময় ছত্রপতি শিবাজী বাস টার্মিনাসে হামলা চালায় দুই জঙ্গি। একে৪৭ হাতে তারা নির্বিচারে গুলি চালায় সাধারণ মানুষের ওপর। মারা যায় মোট ৫৮ জন নিরপরাধ মানুষ। রাস্তায় নেমেও পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলি চালায় জঙ্গিরা। মারা যান আট জন পুলিশ কর্মী।
বাস টার্মিনাস থেকে কামা হাসপাতাল। কাসভের নেতৃত্বে তাণ্ডব চালায় জঙ্গিরা। মারা যান মুম্বই পুলিশ প্রধান হেমন্ত কারকারে-সহ আরও কয়েকজন পুলিশ কর্মী। কনস্টেবল অরুণ যাদবের বুদ্ধিমত্তা আর পুলিশ অফিসার তুকারাম ওম্বলের অসীম সাহসিকতায় কাসভকে ধরে ফেলা সম্ভব হয়। তুকারাম মারা গেলেও প্রাণে বেঁচে যান অরুণ যাদব।
জনপ্রিয় লিওপোল্ড কাফেতেও হামলা চালায় জঙ্গিরা। মারা যান দশ জন নিরপরাধ মানুষ। হামলা চালানো হয় তাজ হোটেল এবং ট্রাইডেন্ট হোটেলে। শুধু তাজমহল হোটেলেই ছ’টি বিস্ফোরণ ঘটায় জঙ্গিরা। প্রথম দিন,রাতের অন্ধকারে সিঁড়ি দিয়ে কোনও রকমে ২০০ জন পণবন্দিকে উদ্ধার করেন দমকলকর্মীরা। কিন্তু ভেতরে জারি ছিল হত্যালীলা।
নরিম্যান হাউসে ইহুদিদের একটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের দখলও নিয়েছিল জঙ্গিরা। জঙ্গিদের খতম করতে হেলিকপ্টার থেকে নরিম্যান হাউসের ছাদে নামেন এনএসজি কম্যান্ডোরা। দুই জঙ্গিকে মারা গেলও প্রাণ হারান এক জন ভারতীয় কম্যান্ডো। জঙ্গিদের গুলিতে মারা যান ছ’জন নিরপরাধ সাধারণ মানুষ।
২৬/১১-এর এই হামলা শুধু ভারত নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই নিরাপত্তা ব্যবস্থার কাঠামো বদলে দিয়েছিল। তার পর থেকেই সন্ত্রাস দমন যে কোনও শহরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছে। মুম্বই হামলার পর পৃথিবীর অধিকাংশ দেশই লস্কর ই তইবাকে বেআইনি ঘোষণা করে। যদিও এই সংগঠনের প্রাণপুরুষ বহাল তবিয়তেই আছে পাকিস্তানের আশ্রয়ে।