যুধিষ্ঠিরকে বক জিজ্ঞাসা করেছিলেন, সুখী কে? ধর্মপুত্র উত্তর দিয়েছিলেন, সুখী সে, যে অঋণী, অপ্রবাসী, দিনান্তে শাকান্নভোজী।
কোনও এক সুপ্রাচীন সময়ের মূল্যবোধে জারিত এ জীবনদর্শন একবিংশ শতকে কতটা প্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে তর্ক থাকতেই পারে। কিন্তু সুখের খোঁজে প্রবাসে পাড়ি দেওয়া ১০ হাজার ভারতীয় সৌদি আরবে যে রকম আচমকা কর্মহীন হলেন এবং যে ভাবে তাঁদের দিনান্তে শাকান্ন ভোজনটুকুও বন্ধ হয়ে গেল, তা যে যথেষ্ট উদ্বেগের, সে নিয়ে সংশয় নেই।
মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার প্রবচনটা বহু ব্যবহৃত। কথায় কথায় ব্যবহার করে থাকি অনেকেই। কিন্তু মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার অনুভূতি আসলে কী রকম, তা বোধ হয় সবচেয়ে ভাল করে বুঝতে পারছেন সৌদি আরবে আচমকা কর্মহীন হয়ে পড়া ভারতীয় শ্রমিকরা। বাংলা থেকে এবং অন্য অনেক রাজ্য থেকে ফি বছর বহু মানুষ সৌদি আরবে যান কাজের খোঁজে। মধ্য এশিয়ার অন্যান্য দেশেও যান। বেশ অনেক বছর ধরেই চলে আসছে এ পরম্পরা। সুলভ মূল্যে মেলে ভারতীয় শ্রম। তাই এক কালে মানবসম্পদের আকালে ভোগা মরুদেশগুলিতে ভারতীয় শ্রমিকের চাহিদা ছিল প্রবল। আর দেশে কর্মসংস্থানের অভাব থাকায় আরব দেশে কাজ পাওয়ার চাহিদা ভারতীয় শ্রমিকদের মধ্যেও ছিল ভালই। কিন্তু আচমকা বদলে যাচ্ছে আরব দেশগুলির সরকারি নীতি। ফলে সৌদি আরবে মাত্র তিন দিনে কর্মচ্যূত অন্তত ১০ হাজার ভারতীয়।
নিজেদের দেশে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার কর্মসংস্থানের তাগিদে ভারতীয় শ্রমিকদের উপর খাঁড়া নামিয়ে আনার নীতি আরব দেশে আগেও অনুসৃত হয়েছিল। বিধিনিষেধ আবার শিথিল করাও হয়েছিল। কিন্তু খাঁড়াটা আবার নেমে এল। এ বার যেন আরও ধারালো খাঁড়াটা। আঘাতটা যেন আরও আচমকা, আরও বিদ্যুৎ বেগে।
মাত্র তিন দিনে ১০ হাজার মানুষকে কর্মহীন করে দেওয়া খুব ছোটখাট বিষয় নয়। শুধু কর্মচ্যূত করাই নয়, ন্যূনতম সুযোগ-সুবিধা, শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার, ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে এই ভারতীয় শ্রমিকদের। ফলে দিন কয়েক কার্যত অনাহারে কেটেছে তাঁদের।
ভারত সরকারের তৎপরতা অবশ্য এ ক্ষেত্রে প্রশংসনীয়। সঙ্কটের ক্ষণে অত্যন্ত তৎপরতা দেখিয়েছেন বিদেশ মন্ত্রী। আরব দেশের ভারতীয় দূতাবাস থেকে অনাহার ক্লিষ্ট হাজার হাজার ভারতীয়ের অন্নসংস্থান করা শুরু হয়েছে। প্রয়োজন হলে প্রবাসে কর্মচ্যূত ভারতীয় নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ব্যবস্থাও করা হবে বলে জানানো হয়েছে।
কিন্তু এটা পরিস্থিতির একটা দিক। পরিস্থিতির অন্য দিকটায় রয়েছে কর্মসংস্থানহীনতা, অনিশ্চয়তা। এত মানুষ এক সঙ্গে কাজ হারিয়েছেন। শুকনো খটখটে উঠোন থেকে আচমকা যেন ডুব-জলে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সৌদি প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। সুরাহার পথ খোঁজা হচ্ছে। পথ মিলবে কি না, সংশয় প্রবল। এক সঙ্গে দেশে ফিরে আসতে হতে পারে সবাইকে। সে ক্ষেত্রে সংসারগুলো চলবে কীসে? প্রবাসে খেটে যে টাকা দেশে পাঠাতেন এঁরা, তাতেই ক্রমে ক্রমে সাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখছিল অনেকগুলো সংসার। এ বার কী হবে? কত স্বপ্ন ছিল, কত পরিকল্পনা ছিল জীবন নিয়ে। সবই ভেস্তে যেতে পারে। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো এ বিপর্যয়ে সব হিসেব গুলিয়ে যেতে পারে।
প্রবাস থেকে মানুষগুলো ফিরেও যদি আসেন, দিনান্তে শাকান্নের সংস্থান আমরা করে দিতে পারব তো? প্রবাসে বিপর্যয়-ক্লিষ্ট নাগরিক দেশে ফিরে যাতে অঋণী থাকেন, সেটুকু নিশ্চিত করতে পারব তো? পারতেই হবে ভারতকে।