অতিমারি হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। সময়ও পাল্টে যাবে নিজের মতো করে। কিন্তু ভাল থাকার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। নিজের ভাল থাকার দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে।
Health

Mental Health: কর্মক্লান্তি থেকে মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি! ভাল থাকার উপায় জানাচ্ছেন মনোবিদ সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়

অতিমারি হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। সময়ও পাল্টে যাবে নিজের মতো করে। কিন্তু ভাল থাকার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। নিজের ভাল থাকার দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। আলোচনায় সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়।

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০২২ ১৩:২৬
Share:

আলোচনায় মনোবিদ সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়

একটা মহামারি, লাখ লাখ মৃত্যু, বিশ্বজুড়ে লকডাউন, — বিগত দুই বছরে বদলে গিয়েছে গোটা বিশ্ব। রোজকার গতে বাঁধা অফিস থেকে সোজা বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে রুটিনমাফিক দিনযাপন কিংবা স্কুল-কলেজ বন্ধ হয়ে বাড়িতেই পড়াশুনা, গোটা দুনিয়া যেন হঠাৎ করেই বাসা বেঁধে নিয়েছে অনলাইনে। হঠাৎ করে প্রাত্যাহিক জীবনে এমন বদলকে মেনে নিতে না পারলেও লকডাউনে একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল ছোট-বড় সবাই। এর ফলে মানসিক চাপ ও অবসাদের পরিসর তৈরি হয়েছে ব্যপকভাবে। এই পরিস্থিতিতে ঠিক কী ধরনের সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়েছে মানুষকে? কী ধরনের প্রভাবই বা পড়েছে শিশুদের উপর? এর সুরাহা কোথায়? এই সমস্ত কিছু নিয়ে আলোচনায় মনোবিদ সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়।

আলোচনার শুরুতে তিনি প্রথমেই উল্লেখ করলেন জীবনযাপনের উপর এই পরিবর্তনের প্রভাবকে। ঘরে বসেই দিনের শুরু, ঘরে বসেই শেষ। বহু ক্ষেত্রে একই বাড়ির একাধিক সদস্য প্রতিদিন এই বদ্ধ জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে গিয়েছেন। পাশাপাশি বাড়ির শিশুদের ক্ষেত্রেও পরিস্থিতি ছিল একই রকম। একই বাড়ির মধ্যে একই সময়ে প্রতিদিনের দিনযাপনের রুটিন কিন্তু কিছুটা হলেও মানসিক চাপ বাড়িয়ে দিয়েছিল। মনোবিদ জানাচ্ছেন, “কোনও পরিস্থিতি যদি হঠাৎ করে বদলে যায়, তা হলে প্রতিকুলতার সৃষ্টি করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার যে প্রক্রিয়া তার উপরে আঘাত হানে। একই সঙ্গে আমরা যেখানে কাজ করছি, সেখানকার পরিকাঠামো কেমন, তার উপরে ভিত্তি করেই কাজের পরিবেশ তৈরি হয়। পাশাপাশি, সমান তালে রান্নার হেঁশেল সামলানো, বাচ্চার দেখভাল, বা সংসারের অন্যান্য যাবতীয় কাজ করার ফলে বহু ক্ষেত্রে স্ট্রেস বা মানসিক যন্ত্রনার মধ্যে গিয়েছে বহু পরিবার।”

পাশাপাশি অন্য এক দিকও তুলে ধরলেন তিনি। জানালেন, বিষয়টি তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যাবে, “আমরা যদি একটু ভাল করে ভাবি, তা হলে বুঝতে পারব যে আমরা যাঁরা হঠাৎ করে এই বদলকে সঙ্গী করে নিতে পারলাম বা সহজ করে বললে ‘বাড়ি থেকে কাজ করা’ এই বিষয়টির সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করতে পারলাম, তাঁরা কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সুরক্ষা বলয়ে থেকেছি। অন্যরা বলতে তাঁরা, যাঁদের কাজ কখনই বাড়ি থেকে করা সম্ভব নয়। যেমন গানের শিল্পী, বা থিয়েটার আর্টিস্ট, চিকিৎসক, সংবাদকর্মী, দিনমজুর, যাঁদের পেশায় কাজের ধরন এমনই যে তা কখনও বাড়ি থেকে করা সম্ভবই নয়। অর্থাৎ পরিস্থিতির চাপে কাজ বন্ধ হয়ে গেল বা বিপজ্জনক পরিস্থিতিতেও কাজ চালিয়ে যেতে হল, এমন মানুষের সংখ্যাটাও কিন্তু অতিমারির সময় নেহাৎ কম ছিল না। এ দিক থেকে দেখতে গেলে যাঁরা বিগত বছরগুলিতে বাড়ি থেকে কাজ করেছেন তাঁরা বিকল্প ব্যবস্থার সুবিধা পেয়েছেন। এই উপলব্ধি হয়তো সামগ্রিকভাবে মানসিক চাপ ও কর্মক্লান্তি দূর করতে পারবে না। কিন্তু পরিস্থিতির প্রতি কৃতজ্ঞতাবোধ কঠিন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ক্ষমতায় শান দেবে।”

কিন্তু ওয়ার্ক ফ্রম হোম বা বাড়ি থেকে কাজ মানসিকভাবে কতটা ক্ষতি করেছে? এর উত্তরে সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায়, এর বহুস্তরীয় প্রভাবের কথা বললেন। কাজের জীবন হোক বা স্কুলের জীবন এবং সেখান থেকে দিনের শেষে বাড়ি ফিরে আসা — এর প্রতিটির একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা রয়েছে। হঠাৎ করে এই বদল কিন্তু গতে বাঁধা সেই রুটিনকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছিল। আখেরে যা জীবনকে একঘেঁয়ে করে তুলেছিল। এই সময়ে ‘স্কুলে যাব না’ বলে কান্না জুড়ে দেওয়া বাচ্চাটিও কিন্তু হাঁপিয়ে উঠেছিল ঘরে থেকে। পাশাপাশি রোজকার এই রুটিনমাফিক অফিস যাওয়া এবং বাড়ি ফিরে আসা, অনেক ক্ষেত্রেই বাড়ির আভ্যন্তরীন বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হওয়া থেকে অনেককে বিরত রেখেছে। কিন্তু বাড়ি থেকে কাজ চালু হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তা প্রকট হয়ে উঠেছে।

বাড়ির মধ্যে বদ্ধ জীবনের কারণে একঘেঁয়েমি, বিরক্তি, মন খারাপ এমনকী কোনও কোনও ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক ব্যহত হয়েছে। এমন অনেক বিষয় মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে, যা আমরা এড়িয়ে চলেছি বহুদিন। বহু সন্তান প্রত্যক্ষ করেছে বাবা-মা’র মধ্যে অশান্তি।

কিন্তু বাড়ি থেকে কাজ চালু হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই তা মাথাচাড়া দিয়েছে। তাই এই দিকটি বিশ্লেষণ করে বলা যেতেই পারে যে এই পরিস্থিতি কিন্তু সমস্যা বাড়িয়েছে। সামগ্রিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে তৈরি লিঙ্গ বৈষম্য, গার্হ্যস্থ হিংসা, কর্মক্লান্তির মানসিক অবসাদ প্রত্যক্ষ করেছেন মুষড়ে পড়েছেন বহু মানুষ।

সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, “প্রাপ্তবয়স্ক মানুষরা এসে অনেক সময়েই আমার কাছে বলেন যে এক ছাদের তলায় থাকা আর সম্ভব হচ্ছে না। কোনও সামন্তরাল সম্পর্কের অবস্থানজনিত সমস্যা নিয়ে বহু দম্পতি আমাদের কাছে এসেছেন। নিজের বাড়িতে নিজেই অচেনা হয়ে উঠেছেন পরিবারের কোনও সদস্য, এমন কথাও উঠে এসেছে। যার রেশ পড়েছে বাড়ির ছোট্ট শিশুর উপরেও। সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে আমরা এখনও দেখতে পাচ্ছি বর্তমানে স্কুল খোলার পরেও বাড়ির সমস্যা নিয়ে এই বাচ্চারা ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। এবং পাশাপাশি গার্হ্যস্থ হিংসা প্রত্যক্ষ করেছে তারা।

তবে এখানেই শেষ নয়। বাড়ি বসে কাজ করার ফলে সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছে, কথোপকথনের সুযোগ হয়েছে এমন উদাহরণও রয়েছে। সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, আগে বহু মানুষ কাজের ব্যস্ততার চাপে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারতেন না। বিশেষ করে এমন পরিবার, যেখানে স্বামী-স্ত্রী দু’জনেই বাইরে কাজ করেন। বাড়ির শিশুর দেখভাল করেন পরিচারিকা বা বাড়ির বয়স্করা। এমন পরিস্থিতিতে একে অপরের সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে — এমন উদাহরণও বহু রয়েছে। যা এই অতিমারি পরিস্থিতি সামাল দিতে সাহায্য করেছে।

অতিমারির করাল গ্রাস থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে মানুষ। তবে অতিমারির রেশ পুরোপুরি কাটেনি। বহু মানুষ এখনও ঘর থেকেই অফিসের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে কীভাবে মানসিকভাবে সুস্থ থাকা যায়? উত্তরে সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় জানালেন, “সময় কিন্তু পাল্টেছে। ধীরে ধীরে দোকান-বাজার খুলছে। মানুষ সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে যাচ্ছেন। ঘুরতে যেতে পারছেন। বহুদিন পরে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা হচ্ছে। ফলে এই একঘেঁয়েমির রেশ কিছুটা হলেও কেটেছে। ধীরে হলেও স্বাভাবিক ছন্দে ফিরছে বিশ্ব। তবে এমন অনেক অফিস রয়েছে, যেখানে এখনও অনলাইনেই কাজ হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার রাস্তা একটাই — পরিকল্পনামাফিক জীবনযাপন। অগ্রাধিকারের বিচারে কাজের একটি তালিকা তৈরি করে রাখা যেতে পারে। সারা সপ্তাহের ব্যস্ততার শেষে সুযোগ পেলেই বাড়ির চার দেওয়ালের বাইরে বেরোন। সেটা পরিবারের সঙ্গেই যেতে হবে তেমনটা নয় সবসময়। কখনও কখনও নিজে নিজের সঙ্গে বেরোন। আবার পরিবারকেও সেই তালিকাভূক্ত করুন। দু’দিন ছুটি পেলে নিজের সঙ্গে, নিজের মতো করে অন্তত একটা দিন কাটান। পছন্দের পুরনো গান শোনা হোক, সিনেমা দেখা হোক বা বাইক নিয়ে কোথাও বেরিয়ে যাওয়া, কিংবা একান্তে নিজের শখপূরণ, একাকী কফি কাপে চুমুক — যাই হোক না কেন! নিজের সঙ্গে সময় কাটানো অত্যন্ত জরুরি। তবেই এই একঘেঁয়েমি জীবন থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। মনে রাখবেন, সপ্তাহান্তে নিজের জন্য কাটানো এই সময় কিন্তু আপনাকে আগামী সপ্তাহ জুড়ে কাজ করার মানসিক শক্তি ও অনুপ্রেরণা যোগাবে।

মনোবিদ সাহেলী গঙ্গোপাধ্যায় আরও জানালেন, “বাড়ি থেকে কাজ করতে হলে, কাজের একটি নির্দিষ্ট কোনও জায়গা ঠিক করে নেওয়া উচিত। এতে মনঃসংযোগ ঠিক থাকে। ওই জায়গায় বসলেই আমাদের মানসিক প্রস্তুতি জানান দেয় যে আমরা কাজ করতে বসেছি। এ ছাড়াও একটানা বসে কাজ করার সময়ে একটি নির্দিষ্ট সময় অন্তর কিছুক্ষণের ব্রেক নিন। পরিবারের কারোর প্রয়োজন হলে তাঁর সঙ্গে কথা বলুন। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে খোলামেলা আলোচনা করুন। তাঁদেরকে কাজের সময়সূচি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করুন। এতে মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া যাবে। সব শেষে ভাল থাকার প্রয়াস করা যাবে।”

অতিমারি হয়তো আরও কিছু দিন চলবে। সময়ও পাল্টে যাবে নিজের মতো করে। কিন্তু ভাল থাকার জন্য মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া প্রয়োজন। নিজের ভাল থাকার দায়িত্ব নিজেকে নিতে হবে। নিজের আবেগের প্রতি সহিষ্ণু এবং সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে থামতে হবে। নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবার এগিয়ে যেতে হবে। মাঝে মধ্যেই পারিবারিক বৈঠক পরিকল্পনা করা যেতে পারে। যেখানে পরিবারের প্রত্যেক সদস্য তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা একে-অপরের সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারবে। কোনও ভাবে মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যা উপলব্ধি করলে মনোচিকিৎসক বা মনোবিদের পরামর্শ নিন।

এই প্রতিবেদনটি আমরি হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন