বর্ষা যাওয়ার মুখে রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতি বছরই দেখা যায়। এ বারও বাড়ছে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি ও টাইফয়েডে আক্রান্তের সংখ্যা। তাই জ্বর হলে তা ফেলে রাখবেন না। সঙ্গে-সঙ্গে পরীক্ষা করে চিকিৎসা শুরু করা জরুরি। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি ও টাইফয়েডের উপসর্গ হিসেবে জ্বর, গা ব্যথা, বমি ভাব দেখা যায়। তার সঙ্গে আর কী কী লক্ষণ থাকে? কোন রোগে চিকিৎসা কেমন? জেনে নেওয়া যাক...
তিনটি রোগের সূচনা এক রকম
জেনারেল ফিজ়িশিয়ান ডা. সুবীর কুমার মণ্ডল বললেন, “ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি, টাইফয়েড... এই তিনটি রোগই এখন বাড়ছে। ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি মশাবাহিত ও টাইফয়েড জলবাহিত রোগ। ম্যালেরিয়া হলে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর, ডেঙ্গিতে র্যাশ বেরোনো, টাইফয়েডে ডায়েরিয়া... এগুলোই মূলত রোগ চেনার উপায় ছিল। কিন্তু এখন এদের উপসর্গ অনেকটা মিলে গিয়েছে। ম্যালেরিয়ায় জ্বরের সঙ্গে কাঁপুনি না-ও থাকতে পারে, ডেঙ্গির র্যাশ দু’দিন পরে বেরোতে পারে, টাইফয়েডে জ্বরের সঙ্গে সবসময়ে ডায়েরিয়া কিন্তু থাকছে না। তাই এখন জ্বর এলেই মোটামুটি ভাবগতিক বুঝে প্রাথমিক ভাবে এই তিনটি রোগের পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। ঠান্ডা লেগে সর্দিকাশি বা ইউটিআইয়ের (ইউরিনারি ট্র্যাক ইনফেকশন) উপসর্গ না থাকলে এই তিনটি টেস্ট করাতে হবে। কারণ এই রোগগুলোর চিকিৎসা তাড়াতাড়ি শুরু করা দরকার।” রোগগুলো নিয়ে আলোচনা করলে আরও স্পষ্ট হবে বিষয়টা।
ম্যালেরিয়ার ক্ষেত্রে
ম্যালেরিয়ায় জ্বরের সঙ্গে লো ব্লাড প্রেশারও দেখা যাচ্ছে। তবে ম্যালেরিয়ার ভাগ আছে। ভাইভ্যাক্স ও ফ্যালসিফেরাম বা ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়া। ডা. মণ্ডল বললেন, “ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়া কম ক্ষতিকর। এটাই বেশি হতে দেখা যায়। অন্যটা হল ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া। একে ম্যালিগন্যান্ট ম্যালেরিয়াও বলে। এই ম্যালেরিয়ায় প্রাণহানি পর্যন্ত হতে দেখা যায়। কারণ এ ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক জড়িত। অপর দিকে ভাইভ্যাক্স সহজে সারলেও তার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। এখন দু’ধরনের টেস্ট হয়, স্লাইড টেস্ট ও অ্যান্টিজেন টেস্ট। এমপি ডুয়াল অ্যান্টিজেন টেস্ট করালেই বোঝা যায় ভাইভ্যাক্স না ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়া। সেই অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু হয়।” এই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হলে জ্বরের সঙ্গে মাথার সামনের দিকে যন্ত্রণা ও বমির মতো উপসর্গ দেখা যায়। তাই বমির ওষুধ দেওয়া হয়। ডা. মণ্ডল আর একটি বিষয়েও সতর্ক করে দিলেন, “ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়া রিল্যাপ্স করতে পারে। এই ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত রোগীরা সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যাওয়ার সাত দিন পরেও রোগ রিল্যাপ্স করে। কারণ এই রোগের জার্ম লিভারের মধ্যে চুপচাপ লুকিয়ে থাকে। ওষুধের প্রভাব চলে যাওয়ার পরে তা আবার প্রকট হতে পারে। তাই ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়ার রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরেও দু’সপ্তাহের ওষুধের কোর্স দিয়ে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়। এতে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনও রোধ করা যায়। না হলে সেই রোগীর কাছ থেকে তাঁর বাড়ির লোকদের মধ্যেও রোগ সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে।”
ভাইভ্যাক্স ম্যালেরিয়ার রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলে তাঁকে ওষুধ দিয়ে তিন দিন রাখা হয়। সাধারণত অ্যান্টি-প্রোটোজ়োয়াল ওষুধ দেওয়া হয়। রোগীকে ছাড়ার আগের দিন প্যাথোজেন টেস্ট করা হয়। যদি দেখা যায় যে, তখনও প্যাথোজেন রয়েছে, তখন তা রেজ়িস্ট্যান্স টাইপ ধরা হয়। সে ক্ষেত্রে আইভি অর্থাৎ ইন্ট্রাভেনাস ওষুধ শুরু করতে হবে। ভাইভ্যাক্সের চিকিৎসা বাড়িতেও করা যায়, তবে অবশ্যই বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে।
ফ্যালসিফেরাম ম্যালেরিয়ায় হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। ইন্ট্রাভেনাস ওষুধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এই ধরনের ম্যালেরিয়ায় যে ওষুধ দেওয়া হয় তাতে সুগার নেমে যেতে পারে। তাই সে বিষয়ে চিকিৎসক ও রোগীকে সচেতন থাকতে হবে। দিনে তিন বার করে সিবিজি ব্লাড টেস্ট করে ব্লাডসুগারের মাত্রা মনিটর করা জরুরি।
ডেঙ্গির ক্ষেত্রে
জ্বরের সঙ্গে হাত-পায়ে র্যাশ বেরোতে দেখা যায়। তবে র্যাশটা প্রথম দিনেই বেরোয় না। কয়েক দিন পরে বেরোয়। এই রোগে ভাইরাসগুলো প্লেটলেট ধ্বংস করে দেয়, আর যেখান থেকে প্লেটলেট তৈরি হয়, সেই মেশিনারিও ব্লক করে দেয়। ফলে প্লেটলেটের মাত্রা কমতে থাকে। তবে এই রোগে পাঁচ দিন মতো জ্বর থাকে। তাই প্যারাসিটামলের একটা কোর্স দেওয়া হয়। ডা. মণ্ডল বললেন, “রোগীর প্রয়োজন অনুযায়ী দিনে তিন বা চার বার করে প্যারাসিটামল খেতে দেওয়া হয়। ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হলে তিন থেকে পাঁচ দিন থাকে ইনকিউবেশন পিরিয়ড। পাঁচ দিন পর থেকে প্লেটলেট ফল করতে শুরু করে। তাই পাঁচ দিনের পর থেকে প্লেটলেট কাউন্টের দিকে নজর রাখতে হবে। রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে না পারলেও পাঁচ দিন পর থেকে প্লেটলেট কাউন্ট করাটা খুব জরুরি। ডব্লিউ এইচ ও-র নির্দেশিকা অনুযায়ী, প্লেটলেট দশ হাজারের নীচে নেমে গেলে প্লেটলেট ট্রান্সফিউশন দিতে হবে। আর হেমারেজ হলে, নাক দিয়ে রক্ত বেরোনোর মতো উপসর্গ দেখা দিলে আরও আগে থেকেই প্লেটলেট দিতে হবে। তবে এ দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা অনুযায়ী সাবধানতা অবলম্বন করতে কুড়ি হাজারের নীচে নামলেই প্লেটলেট দেওয়া শুরু করে দিই। মানুষের জীবন নিয়ে টানাটানি যাতে না হয়, তাই আগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়।”
টাইফয়েডের ক্ষেত্রে
এটি মূলত জলবাহিত রোগ। দূষিত জল পান করলে সালমোনেলা টাইফি ব্যাকটিরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এর থেকেই টাইফয়েড ফিভার হয়। এই রোগে মূলত গ্যাস্ট্রো-ইনটেস্টিনাল ট্র্যাকে ইনফেকশন ছড়ায়। তাই একে এন্টেরিক ফিভারও বলে। জ্বরের সঙ্গে টাইফয়েডে ডায়েরিয়া হতে দেখা যায়। চিকিৎসকের কাছে গেলে প্রথম দিনই ব্লাড কালচার করতে দেওয়া হয়। রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসা শুরু করা হয়। এ রোগে সাধারণত অ্যান্টিবায়োটিকস দেওয়া হয়। আর যেহেতু ডায়েরিয়া হয়, তাই রোগীর ডিহাইড্রেশন যাতে না হয়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে। ফ্লুয়িড ইনটেক ঠিক রাখতে হবে। টাইফয়েডে ওরাল মেডিসিন না নিয়ে আইভি-র মাধ্যমে ওষুধ দেওয়া গেলে রোগী তাড়াতাড়ি সারবেন।
রোগগুলোর চিকিৎসা পদ্ধতি তো জানা গেল। কিন্তু কথায় আছে, প্রিভেনশন ইজ় বেটার দ্যান কিয়োর। বর্ষায় বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার রাখুন। রাতে মসকিউটো রেপেল্যান্ট জ্বালিয়ে বা মশারি টাঙিয়ে ঘুমোন, যদিও ডেঙ্গির মশা দিনে কামড়ায়। তাই দিনেও সাবধান থাকতে হবে। পরিশোধিত জল পান করুন। রাস্তার কাটা ফল, ফলের রস বা লস্যি খাবেন না। সঙ্গে একটা জলের বোতল রাখুন। প্রয়োজনে মিনারেল ওয়াটার কিনে খান। মনে রাখবেন, সাবধানের মার নেই।