পুজোয় কোন কোন রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা আছে? গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
পুজোর আনন্দ, হইহুল্লোড়ের ফাঁক গলে কখন যে জীবাণু-রূপী অসুরেরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়বে, তা আগে থেকে বোঝা সম্ভব নয়। খামখেয়ালি আবহাওয়ায় এ বছর বৃষ্টি-দানবের চোখরাঙানি বাংলা জুড়ে। কখনও রোদ, আবার কখনও ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি, জমা জলে তিতিবিরক্ত কলকাতা। পুজোর ক’টা দিন বৃষ্টি হবে কি না, তার পূর্বাভাস এখনও না এলেও, অনুমান করা হচ্ছে আবহাওয়া এমনই অনিশ্চিত থাকবে। আর উৎসবের মরসুমের অনিয়মের ফাঁক গলে ঢুকে পড়বে জ্বরজারি, জল বা পতঙ্গবাহিত অসুখবিসুখ। ভাইরাস-ব্যাক্টেরিয়ারাও যে চুপটি করে থাকবে, তা নয়। বরং সংক্রামক জীবাণুদের হানা দেওয়ার আশঙ্কাই বেশি। অতএব, পুজোর সাজ, ভোজ যেমন চলবে চলুক। তার মাঝেই বিবিধ রোগবালাইকে চিনিয়ে তাদের থেকে সতর্ক থাকার উপায় বাতলে দিচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
জ্বরের জীবাণুরা প্রস্তুত
আবহাওয়ার পরিবর্তনের সময়ে বিভিন্ন ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়ার সক্রিয়তা বাড়ে। মেডিসিনের চিকিৎসক অরুণাংশু তালুকদার বললেন, “ঋতুবদলের সময়ে জীবাণুদের বংশবৃদ্ধি হয়। একগুচ্ছ ভাইরাস দাপট দেখাতে থাকে। সর্দিকাশির অ্যাডেনোভাইরাস তো আছেই, শ্বাসনালির অসুখের জন্য দায়ী রাইনোভাইরাস বা রেসপিরেটরি সিনসিটিয়াল ভাইরাস, ইনফ্লুয়েঞ্জা, সোয়াইন ফ্লু-র মতো সংক্রামক রোগের প্রকোপ বাড়ে। ব্রঙ্কাইটিসও হতে পারে। পুজোর ভিড়ে মানুষ থেকে মানুষে এই সব ভাইরাস ছড়ায়।” জ্বর, সর্দিকাশি, গলাব্যথা, নাক থেকে অনবরত জল পড়া, চোখ জ্বালা, চোখে সংক্রমণ এই সময়ে ভোগাতে পারে। বৃষ্টির জলে ভিজে ঠান্ডা লাগার আশঙ্কাও বেশি। ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে যদি ভিজে যান, তা হলে ঘরে ফিরেই আগে ভিজে জামাকাপড় ছেড়ে ফেলুন। তার পরে ভাল করে স্নান করে নিন।
ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের বিভিন্ন প্রকারভেদের মধ্যে একটি হল সোয়াইন ফ্লু (এইচ১এন১)। অন্য জীবাণুর তুলনায় ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের দ্রুত মিউটেশন হয়। চিকিৎসক অনির্বাণ দলুইয়ের মতে, একেবারে শুরুর দিকে শূকরের শরীর থেকে সোয়াইন-ফ্লু ভাইরাস মানুষের শরীরে সংক্রমিত হলেও, এখন এটি বাতাসবাহিত সংক্রমণে পরিণত হয়েছে। এর থেকেও সাবধান থাকা জরুরি।
দাপট দেখাবে মশারা
প্রতি বছরই পুজোর এই সময়টাতে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গির প্রকোপ বাড়ে। এ বছরেও সাবধানতা মেনে চলতে হবে বলেই জানালেন চিকিৎসক অনির্বাণ দলুই। পুজোর ভিড়ের মধ্যে ডেঙ্গি বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অনির্বাণের পরামর্শ, “ঠাকুর দেখতে বেরোলে বড় হাতা জামা, ভাল করে শরীর ঢাকা পোশাক পরাই উচিত। ডেঙ্গি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ মতো ওষুধ খেতে হবে ও বিশ্রাম নিতে হবে। বৃষ্টির জমা জল এড়িয়ে চলুন। সম্ভব হলে পাড়ায় পাড়ায় পুজো কর্তৃপক্ষকে উদ্যোগ নিতে হবে, যাতে মণ্ডপের আশপাশে জল বা আবর্জনা না জমে।”
রাস্তার জল, নরম পানীয় নৈব নৈব চ
মণ্ডপে মণ্ডপে ঘুরে ঠাকুর দেখা, দিনভর হাঁটাহাঁটি করলে শরীরে জলের চাহিদা বাড়বে। গলা শুকিয়ে গেলে যদি রাস্তায় বিক্রি হওয়া বরফ ঠান্ডা শরবত গলায় ঢালেন বা নরম পানীয় কিনে খান, তা হলে জলবাহিত জীবাণুরা হইহই করে ঢুকে পড়বে শরীরে। চিকিৎসক সুবর্ণ গোস্বামী সাবধান করে দিলেন। চিকিৎসকের কথায়, “পুজোর সময়ে পেটের রোগ বেশি ছড়ায়। তার কারণই হল রাস্তা থেকে কেনা খাবার, জল, শরবত ইত্যাদি। বেসিলারি ও এমিবয়েড নামক দু’রকমের জীবাণুর সংক্রমণেই আমাশয় হয়। আর এই রোগ হয় দূষিত জলের মাধ্যমে। ডায়েরিয়া, কলেরা, টাইফয়েডও ছড়ায় জলের মাধ্যমে।” সাধারণ পেটের সমস্যা হলে নুন-চিনির জল খাওয়া উচিত। এ ছাড়াও পাতলা ডাল দিয়ে ভাত খাওয়া যেতে পারে। আর সমস্যা যদি বেশি হয়, তা হলে খুব দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত।
খাই খাই করলেই বিপদ!
রাস্তার ধারের রোল-চাউমিন, গরম তেলে ভাজাভুজির ছ্যাঁকছোঁক শব্দ যতই আকর্ষণ করুক না কেন, সে মায়া ত্যাগ করলেই সুস্থ থাকবেন। চিকিৎসক অরুণাংশুর মতে, “পুজোর সময়ে খুব একটা টাটকা খাবার বিক্রি হয় না রাস্তায় বা রেস্তরাঁগুলিতে। ভিড় সামলে তাড়াতাড়ি পরিবেশনের জন্য দুই থেকে তিন আগে থেকেই খাবার বানিয়ে রাখা হয়। অনেক রেস্তরাঁতে মাংস তাজা রাখার জন্য রাসায়নিকের প্রয়োগও হয়। তা ছাড়া, ফুড কালার তো আছেই। কাজেই যে খাবার কিনে খাচ্ছেন, তা কতটা স্বাস্থ্যকর, তা আপনার জানা নেই। এই সব খাবার থেকেই কলেরার মতো মারাত্মক পেটের রোগ বেশি ছড়ায়।” এই সময়ে বাইরের খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে যেতে হবে। ফাস্ট ফুড একদমই না। ঘরের হালকা খাবার এই সময়ে খুবই উপকারী। মাল্টিভিটামিনে ভরা পুষ্টিকর খাবার, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ লেবু জাতীয় ফল, পর্যাপ্ত জল পান করলে এই ধরনের সংক্রমণ আটকানো যেতে পারে।
ওষুধ না মাস্ক?
অসুখ যা-ই হোক, চিকিৎসকের পরামর্শ মতোই ওষুধ খেতে হবে। নিজে থেকে ডাক্তারি করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ঠিক হবে না। চিকিৎসকেদের পরামর্শ, সিওপিডি-তে ভুগছেন এমন বয়স্ক মানুষদের ফ্লু, নিউমোনিয়ার ভ্যাকসিন দিয়ে রাখলে অনেকটা সুরক্ষিত থাকবেন। শিশু ও বয়স্কদের নিয়ে ঠাকুর দেখতে বেরোলে মাস্ক পরা খুবই জরুরি। সেজেগুজে মুখে মাস্ক পরা অনেকের কাছেই কঠিন। কিন্তু পুজোর ভিড়ে জীবাণু সংক্রমণ ঠেকাতে গেলে মাস্ক পরতেই হবে। কারণ, ভিড়ের মধ্যে কেউ একজন যদি হাঁচেন বা কাশেন, তা হলে তাঁর নাক বা মুখ থেকে নির্গত জলবাহিত বা বায়ুবাহিত কণা ৭ থেকে ৮ ফুট অবধি ছড়াতে পারে। আর পুজোর সময়ে তো পারস্পরিক দূরত্ব মেনে চলা সম্ভব নয়। তাই মাস্ক পরলে সংক্রামক অসুখবিসুখ থেকে অনেকটা সুরক্ষিত থাকা সম্ভব।