মাইগ্রেনের ব্যথা।
শরীরের কোনও অঙ্গে ব্যথা হলে অধিকাংশ মানুষ প্রথমে কী করেন? ব্যথার ওষুধ কিনে খান, তাতে না কমলে ডাক্তারের শরণাপন্ন হন। ধরুন, কারও হাঁটুতে ব্যথা। ব্যথার ওষুধে না কমলে তিনি অর্থোপিডিশিয়ানের কাছে গেলেন। ডাক্তার ওষুধ দিলেন, ব্যায়াম দেখিয়ে দিলেন, জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন আনার কথা বললেন, তাতে না কমলে হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরামর্শ দিলেন। এখানেই প্রবেশ করে পেন ম্যানেজমেন্ট। শুধু হাঁটুর জয়েন্ট নয়, যে কোনও জয়েন্টে যদি অস্টিয়ো আর্থ্রাইটিস হয়, সেখানকার শুধু হাড় নয়, তার সঙ্গে লেগে থাকা লিগামেন্ট, মাসল দুর্বল হয়ে পড়েছে কি না তা দেখা হয়। শারীরচর্চা করে ব্যথাটা চলে গেলে সারাজীবন হয়তো রোগী ভাল থাকেন। কিংবা যে তিন-চারটে নার্ভের কারণে ব্যথা হচ্ছে, সেখানে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে চিকিৎসা করা হল। পরবর্তীতে এক্সারসাইজ় দেওয়া হল। রোগী ভাল থাকলে আর দরকার পড়ল না হাঁটু প্রতিস্থাপনের। ব্যথার ওষুধ খাওয়া এবং অপারেশনের মাঝের সেতুই হল পেন ম্যানেজমেন্ট। বিশেষজ্ঞ ডা. দেবাঞ্জলি রায় বিশদে বুঝিয়ে দিলেন মাইগ্রেনের ব্যথা, ঘাড়ে, কোমরে ব্যথা, নিউরোলজিক পেন ইত্যাদি ক্ষেত্রে পেন ম্যানেজমেন্ট কী ভাবে কাজ করে।
মাইগ্রেনের ব্যথা
মাইগ্রেন আসলে এক ধরনের মাথাব্যথা, তাই সেটা চিহ্নিত করতে অনেকটা সময় লেগে যায়। কারণ কখনও কখনও তার সঙ্গে মিশে যায় অফিস হেডেক, টেনশন হেডেকের মতো মাথাব্যথাও। একেও অনেকে মাইগ্রেন বলে ভুল করেন। মাইগ্রেন বিভিন্ন ধরনের হয়। তবে মাথাব্যথায় আলো নিভিয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকা, বমি পাওয়া... এ সবই টিপিক্যাল মাইগ্রেনের লক্ষণ। আবার কারও ব্যথার চেয়েও চোখের সমস্যা বেশি হয়, সেটাও মাইগ্রেন। মাইগ্রেনের ধরন অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে। ‘‘যাঁদের প্রচণ্ড মাথা যন্ত্রণা হচ্ছে, তাঁদের হয়তো ক্যালশিয়াম চ্যানেল ব্লকার দিয়ে চিকিৎসা শুরু করলাম। যখনই তিনি সুস্থ বোধ করতে থাকলেন, ওষুধ খাওয়া ছেড়ে দিলেন এবং ব্যথা ফিরে এল। কারণ তিনি চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ খাওয়া ছাড়েননি। এ সব রোগীদের কিছু নিয়ম বলে দেওয়া হয়, স্নানের, এক্সারসাইজ়ের। কিন্তু তিনি হয়তো রাত দুটো অবধি ফোন দেখেছেন, এ দিকে তাঁর তো ঘুমেরও প্রয়োজন আছে। অনেকের ধারণা, মাইগ্রেন সারে না, যেটা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। এর নির্দিষ্ট চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে এবং আপনাকে সেই নিয়মের মধ্য দিয়ে চলতে হবে,’’ পরামর্শ দেবাঞ্জলির।
হাঁটু প্রতিস্থাপনের পরিবর্তে
অপারেশনের আগে অন্য কোনও উপায়ে সমস্যার নিরাময় সম্ভব আছে কি না, সেটা সব রোগীই ভাবে। বিশেষ করে হাঁটু প্রতিস্থাপন করা নিয়ে অনেকেই সংশয়ে ভোগেন। প্রতিস্থাপনের পরেও ব্যথা যায়নি, এমন ঘটনাও চোখে পড়ে। এখানেই পেন ম্যানেজমেন্টের গুরুত্ব। দেবাঞ্জলি বললেন, ‘‘এ ক্ষেত্রে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেট করে রোগীকে ব্যথামুক্ত করা হয়। যদি পরীক্ষা করা যায়, তা হলে দেখা যাবে, অধিকাংশ মানুষের এল থ্রি, এল ফোর ডিস্ক বেরিয়ে আছে। তাঁদের মধ্যে পঞ্চাশ শতাংশ মানুষকে এক্সারসাইজ়, ব্যাক স্ট্রেংদেনিং, মাসল স্ট্রেংদেনিং করিয়ে সুস্থ করে তোলা যায়। বাকিদের মধ্যে আবার তিরিশ শতাংশের যে নার্ভের কারণে পা ভারী লাগছে, অবশ হয়ে যাচ্ছে, সেই নার্ভকে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি অ্যাবলেশন করে প্রথমে ব্যথা কমানো হয়। তার পর এক্সারসাইজ় দেখিয়ে দেওয়া হয়।’’ ফলে স্পাইন সার্জারির প্রয়োজন হল না। পিঠে ব্যথা, হাঁটুর ব্যথা, আর্থ্রাইটিসের ব্যথা এ ধরনের পেনের চিকিৎসা হয় এই চিকিৎসা পদ্ধতিতে। প্রয়োজনে রিউমাটোলজি বিভাগের পরামর্শও নেওয়া হয়। পিঠের ব্যথা, হাঁটুর ব্যথার ক্ষেত্রে দেখা হয়, ব্যথার উৎস মাসল, লিগামেন্ট নাকি ফাইব্রোমায়ালজিয়া। চিকিৎসকদের মতে, ব্যথার একটা বড় আধার ফাইব্রোমায়ালজিয়া। শারীরচর্চা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে এবং ক্রনিক পেন মেডিকেশনের মাধ্যমে যার চিকিৎসা করা হয়।
ক্যানসার রোগীদের ক্ষেত্রে
‘‘আমাদের ষাট থেকে আশি শতাংশ পেশেন্ট ক্যানসার রোগী, যারা জীবনের শেষ প্রান্তে এবং রোগের কারণে প্রচণ্ড ব্যথায় কষ্ট পাচ্ছেন। যেখান থেকে ব্যথার উৎপত্তি সেখানকার নার্ভ ব্লক করে, সেই রিলেটেড ওষুধ দিয়ে এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা করা হয়। ক্যানসারের ব্যথার ক্ষেত্রে পেন ম্যানেজমেন্ট বিষয়টা খুব জরুরি,’’ মত দেবাঞ্জলির।
স্পন্ডাইলোআর্থ্রোপ্যাথির কারণে ব্যথা
আমাদের মেরুদণ্ডের যে গঠন তাতে, একটা বয়সের পরে একজন মানুষের হাঁটাচলা, বসার ভঙ্গি, টানা কম্পিউটারের সামনে বসে কাজ বা নিয়মিত ভারী কাজের কারণে মেরুদণ্ড ধীরে ধীরে বেঁকে যায় এবং তার উপরে যখন ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে তা আরও বেঁকে যায়। প্রকৃতির নিয়মে এর উপরে ইমম্যাচিয়োর বোন ফর্মেশন হয়, যাকে বলা হয় অস্টিয়োফাইটস। বয়স বাড়া, অস্টিয়োআর্থ্রাইটিসের কারণে শরীরে ক্যালশিয়াম অ্যাবজ়র্পশন কম হওয়া... এ সব কারণেও মেরুদণ্ডের স্বাভাবিক গঠন বেঁকে যায়। ফলে যে সমস্যাটা হয় তাকে বলা হয় স্পন্ডাইলোআর্থ্রোপ্যাথি। এর ফলে কোমরে ব্যথা হতে পারে, ঝিনঝিন করে অবশ হতে পারে, ঘুম থেকে উঠে কোমর তোলা যাচ্ছে না, কিছুক্ষণ হাঁটাচলার পরে ঠিক হল... এ রকম বেশ কিছু উপসর্গ দেখা যায়। এ ধরনের সমস্যায় সাঁতার কাটা হচ্ছে সবচেয়ে ভাল চিকিৎসা।
হাড়ের গঠন একটা বয়সের পরে আর বদলায় না। প্রকৃতির নিয়মে হাড় ক্ষয়ে যাবে এবং অস্টিয়োফাইটস হবেই। এর থেকে সুস্থ হতে হলে মাসল স্ট্রেংথ বাড়াতে হবে, যার উপায় সাঁতার, ব্যাক স্ট্রেংদেনিং এক্সারসাইজ়। এর সঙ্গে ক্যালশিয়াম অ্যাবজ়রবেন্টও দেওয়া হয়। কিন্তু বয়সজনিত বা অন্য কোনও কারণে যাঁদের সাঁতার কাটা সম্ভব নয়, তাঁদের এক্সারসাইজ় দেখিয়ে দেওয়া হয়। এ সব ক্ষেত্রে বেশি হাঁটলে ব্যথা বাড়তে পারে। তাই কতক্ষণ হাঁটা যেতে পারে, সেটাও বলে দেওয়া হয়।
কাঁধে ও পিঠে ব্যথা
‘‘ওয়ার্ক ফ্রম হোমের কারণে পিঠে ও কাঁধে ব্যথার অনেক রোগী আমাদের কাছে আসছেন। এক্ষেত্রে মাসল স্ট্রেংদেনিং এক্সারসাইজ়, লাইফস্টাইল মডিফিকেশন, হট কমপ্রেসের পরামর্শ দেওয়া হয়। খুব বেশি ব্যথায় নিউরোপ্যাথিক মেডিসিন দেওয়া হয়। এ ছাড়াও ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিয়মিত হেলমেট পরে বাইক চালানোর কারণে অনেকের কানের পিছনে ব্যথা হয়, যাকে ক্রনিক নিউরালজিয়া বলা হয়। এ ক্ষেত্রে নিউরোপ্যাথিক ওষুধের সঙ্গে এক্সারসাইজ়ের পরামর্শ দেওয়া হয়,’’ বললেন দেবাঞ্জলি। শপিং মলে বা অন্যত্র যাঁদের দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়, তাঁদেরও পিঠে, কোমরে ব্যথা হয়। সে ক্ষেত্রে স্ট্রেচিং এবং মাসল স্ট্রেংদেনিং এক্সারসাইজ় দেখিয়ে দেওয়া হয়, যা তাঁরা কাজের ফাঁকেও করতে পারবেন। ছোটদেরও পিঠে ভারী ব্যাগ নেওয়া, কম্পিউটারের সামনে বহুক্ষণ থাকার কারণে পিঠে ব্যথা হয়। সাঁতার ও যোগব্যায়াম খুব ভাল সমাধান। সেই সঙ্গে ছোটদের নিয়ম করে দুধ ও চিজ় খাওয়াতে হবে, যাতে ক্যালশিয়ামের ঘাটতি না হয়।
অনেকের ধারণা, পেন ম্যানেজমেন্টের চিকিৎসকের কাছে যাওয়া মানে পেনকিলার দিয়ে চিকিৎসা। কিন্তু বিষয়টা একেবারেই তা নয়। ক্রনিক ব্যথার ক্ষেত্রে ওষুধের সঙ্গে পরামর্শ দেওয়া হয় শারীরচর্চা ও জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনার।
পারমিতা সাহা