গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
যদি কাউকে জিজ্ঞাসা করা হয়, কেমন আছেন, তিনি কি আদৌ মন থেকে বলতে পারবেন যে ভাল আছেন? ভাল থাকার অর্থ কিন্তু রোগমুক্ত থাকা নয়, সত্যি সত্যি ভাল থাকতে হলে আপনাকে কিন্তু শারীরিক, মানসিক এবং সামাজিক দিকটাও দেখতে হবে। নানাবিধ কারণে এই তিনটি ক্ষেত্রেই ভাল আছেন এমন মানুষের সংখ্যা কম। অনেকেই জোর গলায় বলতে পারবেন না যে, তাঁরা ভাল আছেন। আমি মনে করি মহিলাদের অবস্থা আরও খারাপ। প্রত্যেক বছর নারী দিবসে নারীদের না পাওয়া বিষয়গুলি নিয়ে আমরা কথা বলি, কখনও আবার নারীদের সফল হওয়ার কাহিনি চলে আসে আমাদের আলোচনার কেন্দ্রে। নারীদের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, সাফল্য-ব্যর্থতা নিয়ে চর্চা হলেও তাঁদের স্বাস্থ্য নিয়ে কিন্তু কখনওই খুব বেশি কথা হয় না। নারীরা নিজেরাও সে সব কথা মন খুলে বলেন না।
এক জন মধ্যবিত্ত বাঙালি ঘরের বৌ যিনি কারও মা-ও বটে, তিনি কিন্তু নিজের স্বাস্থ্য সম্পর্কে একেবারেই সচেতন নন। তাঁর মনে সর্ব ক্ষণ চলতে থাকে, আমার বাচ্চাটা খেল তো? আমার বরের টিফিনে সব কিছু ঠিকঠাক ভরলাম তো? শ্বশুর-শাশুড়ির জলখাবারটা ঠিক সময়ে দিতে পারব তো? এ সবের মাঝে তাঁদের মধ্যে কিন্তু নিজের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ট গাফিলতি থেকে যায়। অনেক শিক্ষিত, কর্মরত মহিলারা আমার কাছে এসে বলেন, তাঁদের বরের জন্য একটা ডায়েট চার্ট বানিয়ে দিতে। আমি জিজ্ঞাসা করি, ‘‘আপনার কোনও রকম সমস্যা নেই তো?’’ সেই প্রশ্ন করায় জবাব আসে, ‘‘আমারটা পরে হবে। ওর চার্টটা আগে বানিয়ে দিন।’’ নিজে ভাল না থাকলে আপনি কিন্তু অন্যকেও ভাল রাখতে পারবেন না— এই সত্যিটা সবার আগে বুঝতে হবে। মধ্যবিত্ত বাঙালি মহিলাদের বলব এ বার একটু নিজের স্বাস্থ্যের দিকটাও ভাবুন। সুস্থ না থাকলে কিন্তু ভাল মা, ভাল স্ত্রী কিংবা ভাল বৌমা— কোনওটাই আর হওয়া হবে না।
মহিলাদের শরীর কিন্তু একাধিক বদলের মধ্যে দিয়ে যায়। ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর, মা হওয়ার পর এমনকি, ঋতুবন্ধের পর তাঁদের শরীরে নানা রকম বদল আসে। কারও শরীরে মেদ জমতে শুরু করে, কারও ওজন খুব বেশি বেড়ে যায়, শরীরে ক্যালশিয়ামের ঘাটতি হয়, কারও আবার মেজাজ বিগড়ে যায়। পরিবর্তনটা শুধু শরীরে হয় না, মনের উপরেও কিন্তু ব্যাপক প্রভাব পড়ে। মহিলাকেন্দ্রিক এই সব সমস্যা নিয়ে কিন্তু মহিলারা নিজেরাই ভাবেন না। আর তাতেই আরও সমস্যা বাড়ে। অথচ একটু সজাগ থাকলেই কিন্তু এই শারীরিক সমস্যাগুলির সঙ্গে শরীর মানিয়ে নিতে পারে। চাই সচেতনতা। চাই মহিলাদের ভাবনাচিন্তায় বদল।
ঋতুস্রাবের পর: প্রথম মাসিকের পর থেকেই মেয়েদের শরীরে হরমোনের মাত্রা ওঠানামা করতে শুরু করে। নতুন নতুন হরমোনের সঙ্গে শরীর যখন মানিয়ে নিতে শুরু করে তখন কিন্তু মেজাজেও পরিবর্তন আসে। শুধু তা-ই নয়, ঋতুস্রাবের পরে চেহারাতেও বড় বদল আসে। এই সময়ে কিন্তু মেয়েদের বিশেষ সাহায্যের প্রয়োজন হয়। তাঁদের ডায়েটেও কিছু বদল আনা জরুরি। ঋতুস্রাবের সময়ে শরীর থেকে রক্তপাত হয়। অনেক মেয়ের আবার অ্যানিমিয়ার ধাত থাকে, তাই এই সময়ে আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার ডায়েটে বেশি করে রাখতে হবে। এর জন্য চিনির বদলে গুড় খাওয়া, বেশি করে শাকসব্জি খাওয়া, খিদে পেলে একটু বাদাম খেয়ে নেওয়া, বেশি করে প্রোটিনও খাওয়া যেতে পারে। তবে শুধু আয়রন-সমৃদ্ধ খাবার খেলেই হবে না, চাই ভিটামিন সি-ও। তবেই শরীরে আয়রনের শোষণ ঠিকমতো হবে। এ ক্ষেত্রে পেয়ারা, আমলকি, লেবুর রসও ডায়েটে রাখতে হবে। অল্পবয়সি মেয়ের বাবা-মায়েদের একটু বেশি সতর্ক থাকতে হবে প্রথম মাসিকের সময়ে।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
সন্তানধারণের সময়ে: এই সময়ে কিন্তু এক এক জনের শরীরে এক এক রকম বদল আসে। সকলের ক্ষেত্রে ডায়েটের ধরনও হয় আলাদা। তবে সকলের ক্ষেত্রেই কম বেশি আয়রন সাপ্লিমেন্ট, ক্যালশিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়ার পরামর্শ দেন চিকিৎসকেরা। এই সময়ে কিন্তু অনেক মহিলার খাওয়াদাওয়ার প্রতি ইচ্ছে কমে যায়। এই সময়ে কিন্তু অল্প খাবার বার বার করে খেতে হবে। যাই খাবেন, তা যেন প্রোটিন-সমৃদ্ধ ও ক্যালোরি-সমৃদ্ধ হয়। এই সব দিক মাথায় রাখলেই নিজের শরীরটাও ঠিক রাখা যায় আর হবু সন্তানও সুস্থ থাকে।
সন্তানের জন্মের পর: জন্মের পর সন্তানকে প্রথম ক’মাস কেবল স্তন্য খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। খুদেকে তাঁর প্রয়োজন মতো স্তন্য খাওয়ানোটা কিন্তু এক জন মায়ের কাছে মোটেই সহজ কাজ নয়। এ সময়ে কিন্তু ডায়েটে ভীষণ ভাবে ক্যালোরি, প্রোটিন আর ক্যালশিয়াম রাখতে হবে। অনেকের শরীরেই পরিমিত মাত্রায় স্তন্য তৈরি হয় না। সে ক্ষেত্রে পুষ্টিবিদের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
ঋতুবন্ধের সময়ে: মেনোপজ়ের সময়ে কিন্তু মহিলাদের শরীরে ব্যাপক রকম বদল আসে। এই নিয়ে কিন্তু সচেতনতা আরও কম। এই নিয়ে যত কথা বলা হবে, ততই ভাল। বিশেষ করে বিবাহিত মহিলাদের কিন্তু এই সময়ে মানসিক সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে। মহিলাদের শরীরটা এত বছর যেমনটা ছিল, সে রকম আর থাকবে না, এই সত্যিটা অনেকেই মেনে নিতে পারেন না। তাঁদের মনের মধ্যে চলতে থাকে নানা রকম টানাপড়েন। এই সময়ে কিন্তু মহিলাদের এক জন পুষ্টিবিদ ও এক জন মনোবিদের সাহায্য নেওয়া প্রয়োজন। না হলে অনেকেই মেনোপজ়ের মানসিক ও শারীরিক ধকল থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন না। এই বিষয়টি কিন্তু পুরুষদেরও অবহিত হতে হবে। মেনোপজ়ের সময়ে মহিলারা কী কী সমস্যার মধ্যে দিয়ে যান, তা ভাল করে বুঝতে পারলে তবেই তো তাঁরা সঙ্গীর দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারবেন। মহিলাদেরও কিন্তু এ বিষয়ে খোলাখুলি কথা বলতে শিখতে হবে।
অফিস, বাড়ির কাজকর্ম, সংসার সামলে মহিলাদের কিন্তু নিজের কথাও ভাবতে হবে। আপনি ভাল থাকলেই আপনার সঙ্গে জড়িত মানুষগুলিও ভাল থাকবে। নিজের স্বাস্থ্যের কথা ভাবা কিন্তু আপনার প্রাথমিক দায়িত্ব। কেমন আছেন, কেউ এই প্রশ্ন করলে ১০ সেকেন্ড চিন্তা না করেই যে দিন উত্তর দিতে পারবেন, সে দিন বুঝবেন সত্যিই ভাল আছেন আপনি। খারাপ থাকার জন্য আর পাঁচ জনকে দোষারোপ না হয় না-ই করলেন, নিজে কতটা নিজেকে ভাল রাখতে পারছেন, আগে সেটা ভেবে দেখুন।
(লেখক পেশায় পুষ্টিবিদ ও যাপন সহায়ক। মতামত নিজস্ব।)