আজ বিশ্ব এডস দিবস। খানিকটা চুপি চুপি এসে গেল দিনটা। নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে নতুন শতকের প্রথম দশকে যে ভাবে এই দিনটি আসার আগে সাড়া পড়ে যেত এখন তেমনটা নয়। সবই হচ্ছে। সবই চলছে। কিন্তু, কোথায় যেন আগের মতো নয়। কোথাও যেন একটু শৈথিল্য। মধ্য এশিয়া জুড়ে গৃহযুদ্ধ। ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর হাত ধরে সন্ত্রাসবাদের নতুন পর্যায়ের সূচনা। ইউরোপে একের পর এক হামলা। তার উপরে শরণার্থী সমস্যা। সব মিলিয়ে বিশ্বনেতাদের অগ্রাধিকারের তালিকায় বেশ পিছিয়ে পড়েছে এডস।
গত শতাব্দীর আটের দশকের গোড়ায় আমেরিকায় এডস প্রথম ধরা পড়ে। তার পরে মহাদেশ আর মহাসাগরের সীমানা পেরিয়ে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে পিছিয়ে পড়া দেশগুলিতে। বিশেষ করে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলিতে প্রায় মহামারীর আকার নেয় এডস। এই পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষে চুপ করে থাকা সম্ভব ছিল না। রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগেই তৈরি হয় ‘ইউএন এডস’ সংস্থাটি। বিশ্ব জুড়ে এডসের মোকাবিলা করার নীতি ও পন্থা ঠিক করার মূল দায়িত্ব এর হাতে। এডস-এর মহামারী রুখতে, এডস রোগীদের চিকিৎসা আর তাদের সামজিক সুরক্ষার মূল উদ্দেশ্যে নিয়ে এই সংস্থার যাত্রা শুরু হয় ১৯৯৪-এ। তার পরে এডস এবং এইচআইভি সংক্রমণ নিয়ে সচেতনতা অনেক বেড়েছে। দেশে এডস নিয়ন্ত্রণের আলাদা সংস্থা তৈরি হয়েছে। যেমন, ভারতে ন্যাশনাল এডস কন্ট্রোল অর্গানাইজেশন (ন্যাকো)। কাজও হয়েছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক প্রচারের সুফলও মিলিছে।
তার পরে ২২ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। কিন্তু গত কয়েক বছরে কোথাও যেন শৈথিল্য লক্ষ করা যাচ্ছে। সেই শৈথিল্য ‘ইউএন এডস’-এর চোখ এড়ায়নি। তাই ২০১৬-২০২১ পর্যন্ত এডস নিয়ে পরিকল্পনা স্থির করতে গিয়ে এই শৈথিল্যের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে ‘ইউএন এডস’-ও। তবে পরিকল্পনা থমকে থাকেনি। বেশ কয়েকটি লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। যেমন:
• শিশু, কিশোর, পূর্ণবয়স্করা যাতে তাদের এইচআইভি সংক্রমণ সম্পর্কে দ্রুত জানতে পারেন এবং দ্রুত চিকিৎসা শুরু হয় তার ব্যবস্থা করা। চিকিৎসার খরচ যেন আয়ত্তের মধ্যে থাকে।
• নতুন প্রজন্ম, বিশেষ করে মহিলা ও কিশোরীরা যাতে এইচআইভি সংক্রমণ থেকে বাঁচার সমান সুযোগ পায় তা দেখা। এ ক্ষেত্রে কোনও বৈষম্য যাতে না থাকে।
• শিশুদের এইচআইভির সংক্রমণ থেকে বাঁচানো। মায়ের থেকে শিশুর সংক্রমণের পথটি বন্ধ করে দেওয়া। গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের দিকে নজর দেওয়া।
• এইচআইভি সংক্রমণের চিকিৎসার সুযোগ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়া। বিশেষ করে যৌনকর্মী, সমকামী, মাদকাসক্ত, রূপান্তরকামীদের প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া।
অলঙ্করণ: মণীশ মৈত্র
পাশাপাশি দেশগুলির আইন, বিচারব্যবস্থা যাতে আক্রান্তদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ না করে সে দিকেও নজর রাখতে হবে। কিন্তু, ভারতের নতুন এডস সংক্রান্ত আইনটি এই লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হবে বলে এডস নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞ এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির দাবি। সরকার এই নতুন আইনে ‘সুকৌশলে’ নিজেকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে নিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠছে। সুলভে চিকিৎসার সুযোগ সবার কাছে পৌঁছে দেওয়ার পথে এই আইনটি অন্তরায় হবে বলেও অনেকের মত। নানা স্তরে এই নিয়ে প্রতিবাদ হচ্ছে। প্রতিবাদটা জরুরি। কারণ, নানা কাজে ব্যস্ত সরকারের দৃষ্টি এ দিকে আরও জোরালো করতে না পারলে পরিস্থিতির অবনতির আশঙ্কা থেকে যায়।
এই ধরনের লক্ষ্যস্থির আগেও হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রেই লক্ষ্য পূরণ হয়নি। কিন্তু এ বারের লক্ষ্যগুলি পূরণ করতে পারলে এডস নির্মূল করাও অসম্ভব নয় বলে দাবি ‘ইউএন এডস’-এর। তবে তার জন্য গা-ঝাড়া দিয়ে উঠতে হবে। ইউএন এডস’ যাকে বলছে ‘ফাস্ট ট্র্যাক নীতি’। মনে রাখা দরকার এই কয়েকটি লক্ষ্য কিন্তু মূল সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের পরিকল্পনার সঙ্গে যুক্ত। দারিদ্র দূরীকরণ, খাদ্যাভাব মেটানো, মূল স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উন্নতি, শিক্ষায় সবার সমান সুযোগ, লিঙ্গবৈষম্য দূর করা, অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বাড়ানো, বৈষম্য দূর করা, শহরাঞ্চলের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা, সমাজে শান্তিপূর্ণ ভাবে সকলকে নিয়ে বাঁচার ব্যবস্থা করা এবং কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উপায়গুলিকে সুনিশ্চিত করার মতো উন্নয়নের প্রথাগত মাপকাঠিগুলির দিকে খেয়াল রাখতে হবে। আলাদা ভাবে এডস নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। পিছনে উন্নয়নের এই প্রক্রিয়াগুলি সক্রিয় থাকতে হবে।
কিন্তু এর জন্য অর্থের প্রয়োজন। ইউএন এডস-এর হিসেবে মতো প্রায় ৩১১০ কোটি ডলার দরকার। এর এক-চতুর্থাংশ শুধু এইচআইভি সংক্রমণ ঠেকাতে লাগবে। ‘ইউএন এডস’-এর হিসেব মতে নিম্নবিত্ত দেশগুলিকে প্রয়োজনীয় অর্থের অন্তত ১২ শতাংশ নিজেকে দিতে হবে। মধ্যবিত্ত দেশগুলিকে এই কাজে সম্পদের প্রায় ৪৫ শতাংশ নিজেকে দিতে হবে। আর উন্নতদেশগুলিকে প্রয়োজনীয় অর্থের ৯৫ শতাংশ নিজেকে দিতে হবে। কিন্তু সন্ত্রাসবাদ, শরণার্থী-সহ নানা সমস্যায় জর্জরিত দেশগুলি আদৌ এডস নিয়ন্ত্রণে সম্পদের এই অংশ কাজে লাগাতে আগ্রহী হবে কি না তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। সে ক্ষেত্রে লক্ষ্যপূরণ আবারও অধরা থেকেই যাবে।