ছবি: শুভম দে সরকার
স্বাধীনতার দেড় বছর বাদে জন্মেছি। পার্ক সার্কাসে থাকতাম। যখন পাঁচ-ছ’বছর বয়স, লাল-পাগড়ি পরা পুলিশ দেখলেই আমাদের খেলা ছিল, একটি ছড়া পুলিশের উদ্দেশে ছুড়ে দিয়ে এক দৌড়ে পালিয়ে যাওয়া: ‘বন্দে মাতরম্, পুলিশের মাথা গরম’। বড়রা আমাদের শিখিয়েছিলেন, এই লাইনগুলো শুনলেই পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে তেড়ে আসবে। নিশ্চয়ই স্বাধীনতা-পূর্ব সময়ের দুষ্ট বাঙালি ছেলেদের ছড়া ছিল এটা। কিন্তু তখন তো দেশ স্বাধীন। পুলিশ আমাদের ছেলেমানুষি দেখে ফিকফিক হাসত। আমরাও কেমন নিশ্চিত জানতাম যে ওরা সত্যি সত্যি আমাদের মারবে না। তবুও সেই দুষ্টুমিতে একটা স্বাধীনতা আন্দোলনের আমেজ ছিল।
স্বাধীনতা দিবসে বাবা তেরঙা পতাকা বাঁধতেন বাড়ির বারান্দায়। পতাকার তিনটি রং ও তার কেন্দ্রস্থিত চক্র-চিহ্নটির মানে বোঝাতেন। স্বাধীনতার গোড়ার দিকের কয়েকটি বছরই ওই রকম করতেন বাবা। স্কুলের পতাকা-উত্তোলনের চাইতে বাড়ির ওই ছোট অনুষ্ঠানটি আরও অর্থবহ ছিল। বাবার ব্যাখ্যায় ভারত নামে দেশটার একটি শান্তিকামী, নির্লোভ, প্রাচীন হয়েও তরুণ, এই ধরনের ছবি মনে গেঁথে যেত। ‘ও আমার দেশের মাটি’, ‘সার্থক জনম আমার’ বা ‘বলো বলো বলো সবে’ গানগুলো আবেগময় হয়ে উঠত। ইস্কুলের পতাকা উত্তোলন ঠিক মনের ভেতর পৌঁছত না। সেখানে বড় মানুষের সঙ্গে স্বাধীনতার মানে নিয়ে কোনও অন্তরঙ্গ সম্পর্ক হত না। উঁচু পতাকার নীচে দাঁড়িয়ে হেডমাস্টারমশাইয়ের বক্তৃতা ও তার পর মিষ্টান্ন বিতরণ, তাতে আনুষ্ঠানিকতাই বেশি প্রাধান্য পেত। স্বাধীনতার অর্থের চাইতে দিনটায় ছুটির আমেজটাই ছিল বেশি।
আরও পড়ুন: দেখুন স্বাধীনতার প্রথম সকালের সেই দুর্লভ মুহূর্তগুলো
তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর ভাবে দেশভক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠতাম যখন ইস্কুলে বাংলা ক্লাসে তরুণ শিক্ষক উদাত্ত কণ্ঠে পড়ে শোনাতেন, ‘হে ভারত, আজি নবীন বর্ষে শুন এ কবির গান।’ বা ‘নববৎসরে পণ করিলাম লব স্বদেশের দীক্ষা’ জাতীয় কবিতা। গায়ে কাঁটা দিত। এক দিকে যেমন প্রাচীন তপোবনের বা বৈদিক সামগানের ছবি ফুটে উঠত চোখে, তেমনই মনে হত, কত অজস্র কাজ পড়ে আছে দেশের জন্য। চারপাশে গরিব ও বঞ্চিত মানুষগুলোকে দেখে কত বার মনে অনুরণিত হয়েছে, ‘এই সব ম্লান মূক মুখে দিতে হবে ভাষা।’ আর ছিল একটি বই, তার নাম ‘আমরা বাঙালি।’ হালকা সবুজ রঙে, হাফ-টোন ছাপা বই। সেই বইয়ের প্রতিটি বাঁ দিকের পাতায় এক-এক জন বাঙালি মনীষীর ছবি, ডান দিকে এক পাতা জুড়ে জীবনী। প্রতিটি জীবনীতে যেন একটি পথের দিশা— জাতীয় জীবন কী ভাবে ব্যক্তিগত জীবনে মেশাতে হবে। যাঁদের কথা পড়তাম, তাঁরা বেশির ভাগই উচ্চবর্ণের পুরুষ ও হিন্দু, হয়তো দু-এক জন মহিলা ও মুসলমান ছিলেন। কিন্তু কোনও ধর্ম বা বর্ণ-বিদ্বেষ ছিল না রচনাগুলোতে। আমার প্রিয় কাজ ছিল প্রথমে ট্রেসিং কাগজের সাহায্য নিয়ে এবং পরে তা না নিয়ে ওই সব মানুষের মুখচ্ছবি মন থেকে আঁকা। এমন করেই মনের মধ্যে গাঁথা হয়ে গিয়েছিল এমন কিছু ছবি যাঁদের নিয়ে গর্ব করে বলতাম, ‘আমরা বাঙালি।’
কিন্তু এই ‘বাঙালি’ বা ‘ভারতীয়’ পরিচয়ে ধীরে ধীরে ফাটল ধরতে শুরু করল। মনে হতে শুরু করল, বইয়ে যা পড়ি তা জীবনে তত দেখি না কেন? একটু বড় হতে পড়লাম সত্যেন দত্তের কবিতা, ‘কে বলে তোমায় বন্ধু অস্পৃশ্য অশুচি?’ এবং গান্ধী মহারাজের কাহিনি। অথচ প্রতি দিন সকালে বিহারের অধিবাসী, কর্পোরেশনের সাফাইকর্মী লক্ষ্মণ যখন তার ভিজে ঝাড়ু হাতে বাড়ি ঢুকত বাথরুম পরিষ্কার করতে, বাড়িতে রব পড়ে যেত, লক্ষ্মণের ঝাড়ু বা শরীর যেন কিছু না ছোঁয়। দরিদ্রের অপমান— আত্মীয়মহলে বা রাস্তায়— চোখে পড়ত রোজই। দু’টো বড় ধাক্কা দিয়ে গেল ১৯৬২-র চিনের যুদ্ধ ও ’৬৫-তে পাকিস্তানের সঙ্গে লড়াই। চিনের সঙ্গে যুদ্ধের সময় স্কুলে পড়ি, তখনও ভারতের শান্তিকামী চেহারাটিই মনের মধ্যে দেদীপ্যমান। দেশের শোচনীয় পরাজয়ের পর স্কুলের এক বন্ধু আমাকে এসে বলল, ‘দেখ, আমরা জিতব কী করে? যে দেশের প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর এক জন শ্রেষ্ঠ ইংরেজি গদ্যলেখক ও রাষ্ট্রপতি পৃথিবীর এক জন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, সে দেশ কি কখনও সফল ভাবে জঙ্গি হতে পারে?’ কথাটা এখনও মনে পড়ে। ’৬৫-র যুদ্ধ ফিরিয়ে নিয়ে এল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার স্মৃতি। হঠাৎ আওয়াজ উঠল, রাতে যাতে বাড়ির আলো রাস্তায় না পড়ে তার ব্যবস্থা করতে হবে। জানলায় কাগজ সেঁটে দিতে হবে, বোমা যাতে না পড়ে। উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে সেই প্রথম পরিচয়। অবাক হয়ে দেখলাম, পাড়ার সব মস্তান-গুন্ডারা ‘সিভিক ভলান্টিয়ার’ হয়ে বাবাদের ধমকে কথা বলছেন, ‘আলো বন্ধ করুন!’ আর পাড়ায় পাড়ায় ছাদে সম্ভাব্য মুসলিম আক্রমণের প্রতিরোধের প্রস্তুতি: লাঠিসোঁটা, ইট-পাটকেল, ফুটন্ত গরম তেল তৈরি রাখা! আমার সেই ছোটবেলার ‘আমরা বাঙালি’ মনোভাব তখন খানখান হয়ে বহুধা।
১৯৬০-এর দশকের মাঝামাঝি স্কুল ছাড়তেই দেখি ‘ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি’। কিন্তু এই ক্ষুব্ধতা কি আমার শৈশব-কৈশোরের অবসান? কিছুটা নিশ্চয়ই তা-ই, কিন্তু পুরোটা মনে হয় না। বরং বলতে পারি, ১৯৭০-এর দশক থেকে ভারত কোন পথে, তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত তৈরি হয়েছে। বিখ্যাত সাহিত্যিক ভি এস নইপল ১৯৭৭ সালে ভারতকে বর্ণনা করেছিলেন এক ‘আহত সভ্যতা’ বলে। কিন্তু আশির দশকে ভারতে এসে তাঁর মনে হল লক্ষাধিক বিদ্রোহের আগুন যেন একই সঙ্গে জ্বলছে। বইয়ের নাম দিলেন ‘ইন্ডিয়া: আ মিলিয়ন মিউটিনিজ নাও’। সত্যিই তো, নকশাল আন্দোলন, বহুজন ও দলিত সমাজের অভ্যুত্থান, আদিবাসী মানুষের আন্দোলন, শহরের বস্তিবাসী মানুষের রাজনৈতিক কার্যকলাপের মেজাজ দেখে অনেকেই ভেবেছেন, ভারতবর্ষে এক নতুন গণতন্ত্রের সূচনা হচ্ছে। এই যদি গণতন্ত্রের ‘লাভের দিকের’ অঙ্ক হয়, ‘খরচা’-র খাতায় জমা পড়েছে শ্রীমতী গাঁধীর জরুরি অবস্থা ঘোষণা, কাশ্মীর, খালিস্তান ইত্যাদি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, ১৯৮৪-র শিখ গণহত্যা, ২০০২-এর গোধরা ও তৎপরবর্তী মুসলিম-নিধন। ’৮০-র দশক থেকেই চাঙ্গা হয়েছে হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের আন্দোলন।
আরও পড়ুন: স্বাধীনতার সকালে পাওয়া দু’টি বিস্কুটই ছিল নিজের অর্জন
মোট কথা, জাতীয়তাবাদী আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা, ও স্বাধীনতার পরে দেশ গঠনের পর্যায়— ইতিহাসের এই সরল ছকটি, যা এক সময় পণ্ডিত নেহরু দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে নানান বক্তৃতায় বলে বেড়াতেন, ১৯৭০ থেকে যে ভারতবর্ষ তৈরি হয়েছে, তাকে আর ওই জাতীয়তাবাদ-স্বাধীনতা-দেশগঠনের ছকে ধরা যাবে না। একটি জটিল, বৈচিত্রময় দেশ জটিলতর হয়েছে। স্বাধীনতার পরে জনসংখ্যা চতুর্গুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশ্বায়ন, নগরায়ণের প্রক্রিয়া জোরদার হয়েছে। গ্রামের মানুষ শহরে আসছে, শহরের বস্তি বাড়বাড়ন্ত। মধ্যবিত্তের সম্প্রসারণ হয়েছে, কিন্তু প্রতিযোগিতাও বেড়েছে জীবনের সর্বক্ষেত্রে। কর্মসংস্থান তেমন হয়নি। সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য— এই দুই ক্ষেত্রে রেকর্ড খুবই মিশ্রিত। ভাষার বৈচিত্রই ভাবুন। নেহরু যখন আত্মজীবনী লেখেন, তখন ভাবা হত ভারতে উল্লেখযোগ্য ভাষার সংখ্যা দশ-বারোটি হবে। আজ কত অজস্র ভাষাভাষী মানুষ তাঁদের নিজস্ব প্রদেশ বা স্বায়ত্তশাসনের অভিলাষী। ছোটবেলায় বুড়োমানুষরা বলতেন, ‘ইংরেজ আমলই ছিল ভাল’। তাঁদের সঙ্গে কত তর্ক করেছি, বলেছি, সুশাসনের চাইতে স্বশাসন দামি। কিন্তু আজ যখন পিতৃপ্রদত্ত তেরঙা পতাকার ব্যাখ্যা ফিকে হয়ে এসেছে, তখন বুঝি, দেশের গতি একই সঙ্গে নানামুখী, এবং এই নানামুখী প্রবণতার জন্যে বহু বৈচিত্রও বর্তমান।
‘সত্যিই, কোথায় চলেছি’, তারাপদ রায়ের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে এখন ধৈর্য লাগে। কারণ উত্তরটি সহজ নয়। এক কথায় বলা যায় না। কিন্তু মনে হয় বেশ কিছু শিক্ষিত ও বিত্তশালী ক্ষমতাবান মানুষের ধৈর্যচ্যুতি হয়েছে। তাঁরা ও তাঁদের সমর্থনপুষ্ট রাজনৈতিক দল ও নেতারা ঠিক করেছেন হিন্দু-সংহতি ও তার পরিণতিতে একটি হিন্দুরাষ্ট্র গঠন করতে পারলেই এই দেশ চিনের মতো শক্তিশালী দেশ হয়ে উঠবে বা নিদেনপক্ষে একটি বৃহৎ সিঙ্গাপুর! ফলে এঁরা চেষ্টা করছেন আগ্রাসী, সংখ্যালঘু-বিরোধী একটি নতুন ও উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদ তৈরি করতে। তাই জিগির উঠেছে যে, সংখ্যালঘু মানুষকে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে হবে ‘ভারতমাতা কি জয়’ বলে, প্রস্তাব করা হয়েছে যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের জাতীয়তাবোধ বাড়ানোর জন্য সাঁজোয়া গাড়ি বসানো হোক, যাতে সীমান্তে প্রহরারত জওয়ানদের কথা ছাত্ররা সর্বদা স্মরণে রাখে। তথাকথিত গো-রক্ষকরা ও তাদের হিংসাও এই জাতীয়তাবাদের অভিব্যক্তি। এ ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় গালিগালাজ ও অপছন্দের মিডিয়ার ওপর সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে চাপের নজির তো আছেই। রাজনৈতিক হিসেবটাও পরিষ্কার। মেরুকরণের রাজনীতির ফলে যদি সমস্ত হিন্দু ভোটকে এককাট্টা করা যায়, তা হলে সংখ্যালঘু মানুষ কোণঠাসা বোধ করলেও তাঁদের বিরোধিতা করার কোনও ক্ষমতা থাকবে না।
ভারতবর্ষ একটি ‘হিন্দু পাকিস্তান’ হয়ে পুনর্জন্ম নেবে!
সত্যি যদি এমনটা হয়, তা হলে আমাদের সীমান্তের স্বাধীনতা রক্ষিত হলেও, দেশের মানুষের যে সব অভ্যন্তরীণ স্বাধীনতা বা নাগরিক অধিকার আছে, তাদের খর্ব করেই এই ‘হিন্দু পাকিস্তান’কে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে হবে। গণতন্ত্রের ভিত্তি ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা। বিতর্কের ক্ষেত্রটিই গণতন্ত্রের প্রকৃত জন্মভূমি। আজ যদি ভারতবর্ষের মানুষ, যে কোনও কারণেই হোক, মনে করেন যে সরকার-বিরোধী মতকে দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত করলেই দেশ শক্তিশালী হবে, সে অধিকার তাঁদের আছে। কিন্তু তাঁদের ভেবে দেখতে হবে, দেশের ভেতরের স্বাধীনতাগুলি খর্ব করে কি ভারতের মতো একটি বহুজাতিক ও নানা ধর্মের সমন্বয়ে তৈরি দেশকে প্রকৃতই শক্তিশালী করা যায়? মাঝে মাঝে মনে হয়, আমাদের অধৈর্য, দর্পিত নেতারা স্থির করেছেন, দেশটার শক্তিশালী হওয়ার পথে অন্তরায় মানুষের সত্য ও তথ্য জানার গণতান্ত্রিক অধিকার। তাই তাঁরা তাঁদের প্রচারিত উগ্র জাতীয়তাবাদের যা কিছু বিরোধিতার টুঁটি টিপে ধরছেন। তবে নেতারা যা-ই ভাবুন, চূড়ান্ত উত্তরটা ভারতবর্ষের মানুষের হাতেই। এইটুকু আশা করি, স্বাধীনতা দিবসে দেশের মানুষ স্মরণ করবেন যে স্বাধীনতা শুধু বিদেশি রাজার শাসন থেকে স্বাধীনতার প্রশ্ন নয়, দারিদ্র, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অসাম্যের হাত থেকে আজাদির প্রশ্নও বটে। স্বাধীনতার লড়াই শুধু সীমান্তে নয়, ঘরেও।