| পক্ষে |
টলিউডে আবার একটা বিভাজন হল
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
ছাত্ররা যেটা দাবি করছে সেটা একদমই ঠিক। আমার একশো ভাগ সমর্থন আছে। আমি একটা ফিল্ম ইন্সটিটিউটের দায়িত্বে ছিলাম। ছাত্রদের সঙ্গে আমার সম্পূর্ণ যোগাযোগ ছিল। তখনও ঝামেলা হয়েছে। সেটা হওয়াটাও স্বাভাবিক। কিন্তু কখনও মনে হয়নি যে পুলিশ ডাকব।
এখন যাদবপুর ইউনিভার্সিটির উপাচার্য তো একটা রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র। আদৌ সে পদের জন্য তিনি যোগ্য কি না, সেটা নিয়ে ভাবা দরকার। উনি যে সেখানে একটা রাজনৈতিক কারণে আছেন সেটাও স্পষ্ট। এমন গায়ের চামড়া মোটা উপাচার্য আমি দেখিনি। সোমবার যে মিছিল বেরিয়েছিল সেটা তৃণমূলের মিছিল ছিল। ছাত্রদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাপারটার মোকাবিলা করা যেত। যাদবপুরে যে প্রতিবাদ হয়েছিল সেটা শুধুমাত্র বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের প্রতিবাদ ছিল না। সব দলের ছাত্ররা ছিল। ওদের কোনও রাজনৈতিক দাবি ছিল না। তা নিয়ে উপাচার্য এমন গোঁসা করবেন, বলে বসবেন যে ছাত্ররা তাঁকে মারতে আসছেন, পুলিশ ছাড়া কেউ তাঁকে বাঁচাতে পারবে না এ সব একটা অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি করল।
এ বিষয় নিয়ে আমি অনেক ছবিকরিয়ে বন্ধুদের প্রতিবাদ করতে এসএমএস-ও পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু ওঁরা উত্তর দেননি। তার কারণ ভয়। টলিউডে আবার একটা বিভাজন হল। একদল প্রতিবাদ করছেন। একদল বলছেন ঠিক হয়েছে। আর একদল মুখ খুলছেন না। কেউ হয়তো ভাবছেন এটা বললে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি পুরস্কার পাবেন না। এঁদের দ্বারা আর যাই হোক, সিনেমাটা হবে না।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাঁর দেখা সেরা ছবি: লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ‘ইফ...’ ছবিটা আমার বড় প্রিয়। এই ব্রিটিশ ছবিটা কান চলচ্চিত্র উত্সবে পাম দি’ওর পেয়েছিল।
| মাঝামাঝি |
ছাত্রদের উপর মারধর কখনওই কাম্য নয়
গৌতম ঘোষ
আমি রাজস্থানে শু্যটিং করছিলাম। ফিরে এসে শুনলাম যে এখানে একটা গণ্ডগোলের পরিস্থিতি হয়েছে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এ বিষয় নিয়ে বিভাজন হওয়াটা কাম্য নয়। আমার মনে হয় আমাদের সব্বার উচিত এগিয়ে এসে বিষয়টার সমাধান করা। তা না করলে ছাত্রসমাজের ক্ষতি। রাজ্যের ক্ষতি। সত্তরের দশকে নিজে যখন ছাত্র ছিলাম, তখন ছিল একটা উত্তাল সময়। পুলিশের অনেক লাঠি খেয়েছি। থানার লকআপে ছিলাম এক সময়। ফলে ছাত্র রাজনীতি আমার জানা।
ছাত্রদের স্বভাব হল, ওরা প্রতিবাদ করবে। এখনও তাই হচ্ছে। একটা প্রতিবাদের পরে পাল্টা প্রতিবাদ চলতে থাকে। উপাচার্যের পদত্যাগের বিষয়ে আমি কোনও মতামত দেব না। আমি মনে করি সিদ্ধান্তটা আচার্যের নেওয়া উচিত। প্রত্যেকটা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একটা নিয়মকানুন থাকে। সব তরফের মতামত নিয়েই একটা সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব। তবে বলব যে, ছাত্রদের উপর মারধর কখনওই কাম্য নয়। একটা কমিটি তৈরি করে তদন্ত করা দরকার। এবং সেই কমিটিতে ছাত্র প্রতিনিধি থাকা প্রয়োজন।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তাঁর দেখা সেরা ছবি: আমার ‘কালবেলা’। মৃণালদার ‘পদাতিক’। গোদারের ‘লা শিনোয়াঁ’। লিন্ডসে অ্যান্ডারসনের ‘ইফ....’, এমএস স্যথু-র ‘কঁহা কঁহা সে গুজর গয়ে’।
| মাঝামাঝি |
সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি ঢোকানোর প্রয়োজন নেই
দেব
আমি জানি যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারটা নিয়ে বিশাল একটা ইস্যু হচ্ছে। আমি চাই সমস্যাটার তাড়াতাড়ি সমাধান হোক। কোনও বিষয়কে বেশি টানলে লাভ হয় না। কোনও একটা পার্টিকে আপস করতেই হবে। ছাত্ররাই আমাদের ভবিষ্যত্। আমি ওই প্রজন্মের ছেলে। আমার মনে হয় শিক্ষক-ছাত্রদের বোঝাপড়ায় একটা সমস্যা হচ্ছে। স্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি করতে হবে। সেটা করতে যা যা করণীয়, তা
করা উচিত। কাউকে দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে যাতে সমস্যাটার সমাধান হয়।
আর সব থেকে বড় ব্যাপার হল এই বিষয়টা থেকে রাজনীতিকে দূরে রাখা দরকার। প্লিজ, আমি অনুরোধ করছি এটাতে কোনও রাজনৈতিক রং লাগিয়ো না। ছাত্রদের ক্ষমতা অনেক। পাওয়ার অনেক। ওরা নিজেরাই একটা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। সেখানে কোনও রাজনৈতিক রঙের দরকার নেই।
মূল সমস্যাটা (একটি মেয়ের শ্লীলতাহানির অভিযোগ) নিয়ে তদন্ত করা দরকার। সঙ্গে এটাও বলব যে আমাদের উচিত শিক্ষকদের সম্মান করা। ক্যাম্পাসে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কটা ভাল করতেই হবে। সেটা করতে রাজনীতির প্রয়োজন নেই। সব কিছুর মধ্যে পলিটিক্স ঢোকানোর দরকার নেই। যাদবপুরের এই সমস্যাটা নিয়ে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি কেন, অন্য কোনও ইন্ডাস্ট্রিতেই কোনও বিভাজন হওয়াটা বাঞ্ছনীয় নয়।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তৈরি তাঁর দেখা সেরা ছবি: ‘রং দে বসন্তী’। আমি আমির খানের ভক্ত। তাই ছবিটা পছন্দ।
পর্দায় ছাত্র-রাজনীতি
| পক্ষে |
শনিবার কলকাতায় থাকলে মিছিলে যেতাম
কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়
ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ আমি সমর্থন করি না। এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। ছাত্র রাজনীতি তো থাকবেই। আমি নিজেও এক সময় ছাত্র রাজনীতি করেছি। ছাত্ররা গণতান্ত্রিক দাবি পেশ করতেই পারে। সারা পৃথিবীতেই এটা হয়ে থাকে। দু’টো ছাত্র সংগঠনের সংঘাতও তাই স্বাভাবিক। আমার বিশ্বাস ছাত্র আন্দোলন যে কোনও সামাজিক পরিবর্তনের সহযোগী হতে পারে। শনিবার কলকাতায় ছিলাম না। থাকলে মিছিলে যেতাম। উপাচার্যের পুলিশ ডাকা উচিত ছিল ছাত্রীটির অভিযোগের তদন্ত করতে। ছাত্রদের উপর লাঠিচার্জ করতে নয়। তবে এই ইস্যুর ওপর ভিত্তি করে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে একটা বিভাজন হয়ে গিয়েছে, এমনটা বলা ঠিক নয়। যে কেউ ব্যক্তিগত প্রতিক্রিয়া জানাতেই পারেন। এর সঙ্গে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কোনও সম্পর্ক আছে বলে আমি মনে করি না।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তৈরি তাঁর দেখা সেরা ছবি: গৌতম ঘোষের ‘কালবেলা’, সুধীর মিশ্রর ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’। এই ছবিগুলো ছাত্র রাজনীতির বিষয়টাকে বাস্তবসম্মত ভাবে তুলে ধরেছে।
| বিপক্ষে |
আন্দোলনে আছি হোক কলরবে নেই
রুদ্রনীল ঘোষ
আমার স্পষ্ট মত হল যে মেয়েটিকে কেন্দ্র করে সমস্যা তৈরি হয়েছিল, পুরো আন্দোলনের অভিমুখ তার থেকে সরে গিয়েছে। সম্পূর্ণ অন্য একটা কারণে আন্দোলন শুরু হয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন এমন কিছু মানুষ যাঁরা আসল ঘটনার সূত্রপাত সম্বন্ধে স্পষ্ট করে কিছু জানেন না। তাঁরা শুধু ভিড় দেখে ভিড় করি ধরনের লোকজন।
যত দূর আমি জানি, রাত্রিবেলা দু’টো বা আড়াইটের সময় যাদবপুর ক্যাম্পাসে এই মেয়েটির সঙ্গে যাদবপুরের ছাত্রদের একাংশ কোনও রকমের অসভ্যতা করে। অত রাতে একটি মেয়ে ওখানে কী করছিল, জানি না। যার ওপরে শ্লীলতাহানি হয়েছে বলে অভিযোগ এবং যারা করেছে বলে অভিযোগ, তারা প্রত্যেকেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের। বিষয়টি নিয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের অনুসন্ধান বা কঠোর দায়িত্ব নেওয়া অবশ্যই উচিত ছিল। সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষের সমালোচনা করা যেতেই পারে। কিন্তু ঠিক যে কারণে আন্দোলনটা হল, যে কারণে অনেক মানুষ রাস্তায় নামলেন, আমার তাঁদের কাছে একটাই প্রশ্ন। তাঁরা কি আদৌ জানেন তাঁরা লাঞ্ছিতা মেয়েটির সুবিচারের জন্য রাস্তায় নামছেন? নাকি ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার জন্য রাস্তায় নামছেন?
বিভিন্ন কারণে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ সারা ভারতবর্ষে এবং গোটা পৃথিবীতে সর্বস্তরেই হয়। তবে এখানে প্রতিবাদের কারণটা যথেষ্টই রহস্যজনক। পুলিশ কমিশনারের বক্তব্য পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি। তার সত্যতার প্রমাণ আমি টেলিভিশনের পর্দায় দেখতে পাইনি।
তাই সে ক্ষেত্রে আন্দোলন পুলিশ কমিশনারের বক্তব্যের বিরুদ্ধে, নাকি ছাত্রদের ওপর পুলিশি হামলার বিরুদ্ধে, নাকি উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি সেটা আমার কাছে গুলিয়ে যাচ্ছে।
এর সমাধান একমাত্র ছাত্ররাই করতে পারবে। ছাত্র আন্দোলনের ওপর আমার যথেষ্ট ভরসা আছে কারণ আমি নিজে সেটা করেই বড় হয়েছি।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তৈরি তাঁর দেখা সেরা ছবি: নিজের অভিনয় করা ‘কালবেলা’। সময় অনুযায়ী সেটা খুব প্রাসঙ্গিক একটা কাজ।
| পক্ষে |
এই বিষয় নিয়ে একমাত্র সোশ্যাল মিডিয়াতেই লিখব
সৃজিত মুখোপাধ্যায়
এই সম্বন্ধে আমার একদম সুনির্দিষ্ট মতামত এবং স্ট্যান্ড দুটোই আছে। এবং সেটা আমি ব্যক্ত করেও চলেছি প্রতিনিয়ত। কিন্তু সেটা এমন জায়গায়, যার বর্ণহীনতা, ‘ইমিউনিটি ফ্রম পলিটিক্যাল হাইজ্যাক’ এবং অরাজনৈতিক হওয়া আমার আয়ত্তে। অর্থাত্ কিনা আমার ফেসবুক আর ট্যুইটার পেজ। যাঁরা আগ্রহী, তাঁরা দেখে নিতে পারেন। এই বিষয়টা এতটাই বৃহত্ যে এর কারণে কোথাও কোনও বিভাজন হওয়া নিয়ে আমি ভাবতে রাজি নই।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তৈরি তাঁর দেখা সেরা ছবি: রাকেশ ওমপ্রকাশ মেহরার ‘রং দে বসন্তী’, অনুরাগ কশ্যপের ‘গুলাল’। এই ছবিগুলো আমার বাস্তবের অনেক কাছের ঘটনা নিয়ে তৈরি।
| পক্ষে |
হোক আরও কলরব
সুদীপ্তা চক্রবর্তী
ভাবতাম যে, আজকালকার ছাত্ররা শুধুমাত্র ক্যাফে-ফেসবুক নিয়েই ব্যস্ত থাকতে ভালবাসে। এই রকম ভাবে যে তারা প্রতিবাদ করতে চায়, তা দেখে আমার খুব ভাল লেগেছে। আমার নিজের ইচ্ছে ছিল শনিবারের মিছিলে যাওয়ার। ব্যক্তিগত কারণে আটকে গিয়েছিলাম বলে যেতে পারিনি। তার সঙ্গে এটাও বলব যে, আমি চাই না যে এ রকম একটা মিছিলে কোনও রাজনৈতিক রং লাগানো হোক। চাইব না যে বিষয়টা নিয়ে আজ সবুজ পতাকা আর লাল পতাকার মধ্যে একটা যুদ্ধ ঘোষণা করা হোক। অবশ্য মেয়েটির বাবার সোমবারের মিছিলে হাঁটাটা পুরো বিষয়টাকে একটা অন্য বাস্তবের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এই বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের। আমি নিশ্চিত যে ওরা লড়াইটা চালিয়ে যাবে। হোক হোক আরও কলরব হোক। অনেক দিন ধরে সব্বাই চুপচাপ আছে।
ছাত্র রাজনীতি নিয়ে তৈরি তাঁর দেখা সেরা ছবি: অনুরাগ কশ্যপের ‘গুলাল’। দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, রাজ সিংহ চৌধুরী আর অভিমন্যু সিংহের অভিনয় অনবদ্য। ছবিটার নাম বললেই কয়েকটা দৃশ্য আজও মনে পড়ে।
ছবি: সুদীপ্ত ভৌমিক।