সুচিত্রা মিত্র
এই রকম শ্রাবণ দিনে আমাদের বালিগঞ্জের বাড়ির টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকত ‘মা’।
দশতলার ওপর থেকে বৃষ্টির ধারা দেখতে ভারি ভালবাসত। কিন্তু নিজে বর্ষার গান গাইত না। আমাকে বলত গাইতে। এ এক অদ্ভুত ব্যাপার। বৃষ্টি নামলে মায়ের মনে গুনগুন করত ‘ওই বুঝি ওই বুঝি কালবৈশাখী’ গানটা। কিন্তু মায়ের জনপ্রিয় গান ‘কৃষ্ণকলি’তেও ভরা বর্ষার বর্ণনা আছে।
যে নারীকে এতক্ষণ ‘মা’ বললাম সে কিন্তু আদতে আমার পিসিমণি। ডাকনাম গজুু। ভাল নাম সুচিত্রা মিত্র। বাঙালির সুচিত্রা মিত্র। শান্তিনিকেতনের ছাতিমতলার সুচিত্রা মিত্র। রবীন্দ্রমননের সুচিত্রা মিত্র।
গর্ভধারিণীর কোনও স্মৃতি আমার নেই। জন্মের একুশ দিন বাদে মা-কে হারিয়েছি আমি। যাঁকে মা বলে জেনেছি সে আমার এই পিসিমণিই। বাবার ছোড়দি। আমি বরারবরই ওকে মা বলে ডেকেছি। আমার চেতন-অবচেতনে-মূল্যবোধে-রবীন্দ্রনাথে সব চিন্তায় সে আমার মা। অনেকবার দত্তক নিতে চেয়েছিল আমায়। কিন্তু আমার বিপত্নীক বাবা ওই গ্রন্থিটা ছিঁড়তে পারেনি। বলা যায় বাবার কাছ থেকে প্রায় জোর করেই মা-হারা মেয়েকে নিয়ে চলে এসেছিলেন শ্রীমতী সুচিত্রা মিত্র। যদিও তাঁর এক ছেলে আছে। আমার দাদা। দাদার নাম কুণাল মিত্র।
যাই হোক, ফিরে আসি মায়ের গানে। মা কিন্তু আজকালকার প্রজন্মের এই মেশিনের মতো গান গেয়ে চলাকে সমর্থন করতে পারেনি। বলত, ‘‘একটু থামো, গানের ভাবটা বোঝো, মানেটা বোঝো। গানের ভাব দিয়ে শ্রোতাকে কমিউনিকেট করতে হবে। দম নেবে কোথায় সেটা রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে কথার ভাব অনুসারে হবে। তাঁর প্রত্যেক গানে নাটক থাকে। সেই নাটকীয় জায়গাটাকে ধরতে হবে।” মা যে এক্সপেরিমেন্টের বিরোধী ছিল তা নয়। কিন্তু বলত, “এমন ভাবে এক্সপেরিমেন্ট কোরো না যে রবীন্দ্রনাথের গান আর রবীন্দ্রনাথের গান রইল না।”
বেঁচে থাকলে আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর মায়ের বয়স হত নব্বই। এ বার মায়ের জন্মদিন ঘিরে সারা বছর ধরে চলবে গানবাজনার আসর, সেমিনার, মায়ের সৃষ্টি নিয়ে প্রদর্শনী। মা এত ‘অ্যাকটিভ’ একজন মহিলা ছিল, এত বেশি মানুষ ভালবাসত, হইহই করতে ভালবাসত যে মায়ের জন্মদিন এলেই মনে পড়ে যায় কত কথা। অনেকেই মা-কে খুব অহঙ্কারী মনে করতেন। এখনও করেন হয়তো। যতটা বুঝেছি মা-কে জীবনে অনেক ঝড়ঝাপ্টার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে মায়ের সঙ্গে থাকতে থাকতে বুঝেছি জীবনের নানা উত্থান পতনের মধ্যে দিয়ে যেতে যেতে, রকমারি কাঠিন্যের মুখোমুখি হতে হতে নিজের একটা কঠিন বাহ্যিক রূপ মা তৈরি করেছিল। যেন বর্মের ভেতর থাকত। আর ভেতরটা ছিল ফুলের মতো নরম। এই সত্তাটা মায়ের তৈরি হয়েছিল রবীন্দ্র-দর্শন থেকেই। ক্রমাগত জীবন যুদ্ধের সৈনিক হওয়ার শক্তিতে রবীন্দ্রনাথের গানই ছিল সঙ্গী।
মা যদি অহঙ্কারী হত অত মানুষ তাঁর পাশে থাকত না। মায়ের নরম মনটাকে তাঁরাই জানেন যাঁরা ওঁকে কাছ থেকে দেখেছেন। এই শহরে থাকতে থাকতে, কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে ক্লান্ত হয়ে যেত। এক দিকে কোমল, অন্য দিকে ডাকাবুকো মায়ের মনে উদ্ভট সব খেয়াল জাগত। হঠাৎ কী খেয়াল হল কাজ সেরে বাড়ি ফিরে বলল ‘চল, শান্তিনিকেতন যাই।’
আমি হতভম্ব হয়ে যেতাম। হয়তো তখন রাত ন’টা বাজে। মা ঠিক করল বোলপুর যাবে। যাবেই যাবে। সে যত রাতই হোক। তার পর গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়তাম। বোলপুরের আগে পড়ে ইলামবাজার। ইলামবাজার থেকে বোলপুর পর্যন্ত রাস্তাটা সেই রাতবিরেতে ছিল ভয়ঙ্কর। ডাকাত পড়ত। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হেডলাইটের আলোয় মাঠঘাটের যতটুকু দেখা যায়।
এক বার এই রকম নিশুত রাতে আমরা রওনা হলাম বোলপুরে। ইলামবাজার আসার আগে যে থানা সেখানে ওই রকম ঘুটঘুটে রাতে মা গাড়ি থেকে নেমে গটগটিয়ে ঢুকে গেল। ঢুুকে পুলিশ কর্তাদের বলল, “আমাদের সঙ্গে চলুন। আমাদের বোলপুর পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিন।” পুলিশেরা তো শুনে ভিরমি খাবার জোগাড়। ভয়ে বোধ হয় ওঁদের পেটে হাত পা সেঁধিয়ে যায় আর কি! কিন্তু পুলিশদের মা বাধ্য করেছিল শেষ পর্যন্ত বোলপুর পৌঁছে দিতে। সামনে আমাদের গাড়ি চলছে, পেছনে পুলিশের গাড়ি। এই ভাবে বোলপুর পৌঁছলাম।
মা ছিল অসমসাহসী। এই সাহসী মনের সঙ্গে গানের সমন্বয়টাই সব চেয়ে অবাক করে আমাকে। এখনও মনে পড়ে শান্তিনিকেতনে গেলে মাকে গানে পেত। সব সময় গুনগুন করে গান গাইত। কখনও গাইত উদাত্ত গলায় প্রকৃতির মাঝখানে হাঁটতে হাঁটতে। একটা বড় আড্ডা বসত শান্তিমামা (শান্তিদেব ঘোষ)র বাড়ির খাবারঘরে। মা তাঁকে খুব সমীহ করত।
হয়তো সেদিন গানবাজনা হচ্ছে। আমি শান্তিমামাকে আবদার করে বলতাম, তুমি এই গানটা গেয়ো না, ওই গানটা গাও। মা প্রচণ্ড আপসেট হয়ে পড়ত। বলত, ‘কী বলছ তুমি ওঁকে। তুমি অর্ডার করছ!’
মায়ের শান্তিনিকেতনে যাওয়া মানেই ছিল বেড়িয়ে বেড়ানো। কলকাতা যদি হয় সেকেন্ড হোম, মায়ের জন্য ফার্স্ট হোম কিন্তু শান্তিকেতনই। হঠাৎ মনে পড়ল খলিল জিব্রানের ‘প্রোফেট’ বইটা মায়ের খুব প্রিয়। মা বইটার অনুবাদও করছিল। শুধু প্রোফেট নয়, এমনিতেই অনুবাদ করাটা ছিল মায়ের নেশা। নানা ধরনের বই থেকে বাংলায় অনুবাদ করত।
আমাদের দাদু, মায়ের বাবা ছিলেন সাহিত্যিক সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের প্রতি আগ্রহটা পারিবারিক ভাবেই এসেছিল। মায়ের এত রকম গুণ ছিল যে জীবনটা যদি সোজাসাপ্টা হত, ডিভোর্স ইত্যাদি যদি না হত, শুধু গানটাকেই হয়তো পেশা করত না। আরও অনেক কিছু করত। অভিনয়টা দারুণ ভাল লাগত ওঁর। সেই কারণে শেষ বয়সে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’য়ে কী উদ্দীপনা নিয়ে কাজ করল।
রবীন্দ্রনাথের নৃত্যনাট্যের মধ্যে সব চেয়ে প্রিয় ছিল চণ্ডালিকা প্রকৃতি। মা সব সময়ই বলত রবীন্দ্র সাহিত্যের মেয়েরা প্রায় সকলেই কোনও না কোনও ভাবে পাওয়ারওম্যান। আমি মায়ের মধ্যে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্ট চরিত্রগুলোর ছায়া দেখতে পাই। মা যে দারুণ ভাবে রবীন্দ্র-নারী চরিত্রে অনুপ্রাণিত ছিল। শক্তিময়ীদের মায়ের খুব পছন্দ ছিল বলেই ‘দহন’য়ের মতো প্রতিবাদী ছবিতে অভিনয় করেছিল। আসল কথা মা যেমন জীবনে নানা দুঃখ পেয়েছে তেমন দুঃখকে উত্তীর্ণও হয়ে গিয়েছে সে ওই রবিঠাকুরের জোরেই। ‘কৃষ্ণকলি’ গানটা মায়ের মুখে সবাই শুনতে চাইত। সেটা কিন্তু সব সময় তাঁর খুব ভাল লাগত তা নয়। বলত “উফফ্! ওই একটা গানই যে কেন বার বার গাইতে বলে!’’ আসলে মায়ের আরও অনেক প্রিয় গান ছিল। যেমন, ‘বেলা গেল তোমার পথ চেয়ে’, ‘বরিষ ধারা মাঝে শান্তির বারি’, ‘কান্না হাসির দোলদোলানো পৌষ ফাগুনের মেলা’ এই সব। যতই সংসারী হোক, মনটা ছিল বাউলপনা। তাই বাউলাঙ্গের গানও ছিল খুব পছন্দের। অনেক সময় বলত, “রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব ভাবতে, তাঁর দর্শন মানতে সুবিধে হয় একটা কারণেই। ওঁরও ছিল দুঃখের জীবন।”
এ হেন মায়ায় বাঁধা মায়ের বোধে আশ্চর্য এক ধরনের বৈরাগ্য মানে ডিটাচমেন্টও ছিল। কাউকে যদি খুব ভালবেসে ফেলত তো তার সঙ্গে একটা দূরত্ব রচনা করত। তাই কেউ বেশি কাছে ঘেঁষলে বলত, ‘‘অত ভালবেসো না তো। মায়া কাটাও। মায়া কাটাও।’’
মায়া বেশি থাকলেই কি এমন বৈরাগ্য আসে? সন্ন্যাসীদের কি মায়া বেশি থাকে বলেই তাঁরা বৈরাগী? জানি না।
স্মৃতিকথন: সুদেষ্ণা চট্টোপাধ্যায়।