কালো ফুল স্লিভ টি-শার্ট আর জিন্স। চোখে কালো রোদচশমা। গেঞ্জির মধ্যে দিয়েও ঠিকরে বের হচ্ছে পেশির আস্ফালন।
শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কামরার আরাম নয়, গুয়াহাটি নেমে, ভ্যাপসা গরমে সোজা ছুটলেন স্টেডিয়ামে। ফুটবল কর্তাদের স্টেডিয়ামের ঘাস থেকে ফুটবল— সব নিয়ে বোঝালেন!
সেখান থেকে দৌড় হোটেলে। ঘাগু ব্যবসায়ী, টিমের সহ-মালিক সঞ্জীব নারায়ণকে পাওয়ার পয়েন্টে হিসাব কষে দেখালেন লাভ-খরচের হিসাব আর লগ্নির ভবিষ্যৎ। কে বলবে তিনি ফুটবলার নন? আবার অনায়াসে ম্যানেজমেন্ট গুরুও হতে পারতেন। বলছেন, “আমি সানগ্লাস পরে, ভিআইপি বক্সে বসে হাত নাড়াতে আসিনি। আমি চিয়ার-লিডার নই। আমি মনেপ্রাণে ফুটবলার। একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফুটবল দলের মালিক। তাই খেলাটা ‘আমরা’ অত্যন্ত সিরিয়াসলি খেলতে চাই।”
জন আব্রাহামের পুরো জীবনটাই তো এখন ফুটবল! ভারতীয় ফুটবল লিগে ‘নর্থ-ইস্ট ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব’-এর মালিক। ঘরের চৌকাঠে কড়া নাড়ছে বিশ্বকাপ। ফিফা ও একটি টিভি চ্যানেলের হয়ে তিনি যার ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’। টিভিতে ফুটবল নিয়ে মতামত দেবেন। নিজের দলের জন্য প্লেয়ার বাছবেন। দলের জার্সি পছন্দ করবেন। ছবিও করবেন ফুটবল নিয়েই। শিবদাস ভাদুড়ির ভূমিকায়। তাই তিনি নিশ্চয়ই বলতে পারেন, “আমার অফিস এখন কোনও বলিউড নায়কের মতো নেই, ফুটবল দলের দফতর হয়ে উঠেছে।” দলের নাম ঘোষণা করতে গুয়াহাটিতে ঝটিকা সফর সেরে যাওয়ার ফাঁকে আনন্দবাজারকে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন জন আব্রাহাম। শর্ত একটাই: কোনও ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়।
হকিতে দিল্লির দল কেনার পরে, ফুটবলে হঠাৎ গুয়াহাটি দল কিনলেন কেন?
হঠাৎ নয় বা অন্য দল চেয়ে না পেয়েও নয়। আমি একটাই দল প্রথম থেকে চেয়েছি, সেটা হল গুয়াহাটি। লাজং ফুটবল ক্লাবের অংশীদার আমি। মিং (লারসিং মিং সাউয়ান-লাজং ক্লাবের মালিক)-এর সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আবার আমার ‘ভিকি ডোনর’, ‘মাদ্রাস কাফে’ ছবির সহ প্রযোজক রনি শিলং-এর ছেলে। ম্যঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের পাগল ফ্যান ও। এদের সঙ্গে এত দিন ঘর করার পরে, অন্য কোনও দলের দিকে তাকানো যায়?
উত্তর-পূর্ব মানেই তো মূল ভূখণ্ডের পাশে ভিন্ গ্রহ। সেখানে এত বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাস। তার মধ্যে ফুটবলের বিপণন সম্ভব হবে?
উত্তর-পূর্বকে যে অন্যান্য ক্ষেত্রে সেইভাবে ‘এক্সপ্লোর’ করা হয়নি, সেটাই তো আমাদের ইউএসপি। বাকি ভারতে তো ক্রিকেটই সর্বেসর্বা। একমাত্র উত্তর-পূর্বেই ফুটবল এখনও তার সিংহাসন ধরে রেখেছে। এখানকার মানুষের কাছে ফুটবল লিগ আর তাতে ‘নিজেদের দল’-এর আবেগটাই আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হতে চলেছে। আর, খেলার চেয়ে বড় মৈত্রীবন্ধন কী হতে পারে? অনেক ভেবেই দলের নাম রাখা হয়েছে ‘নর্থ ইস্ট ইউনাইটেড’। অন্য ৭টি দল কোনও না কোনও শহরের প্রতিনিধিত্ব করছে, আর আমরা একসঙ্গে উত্তর-পূর্বের এতগুলো রাজ্যের দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নামব। আশা করি, মানুষ মাঠে এসে আমাদের সমর্থনে গলা ফাটাবেন। ভারতের যেখানেই যাব, এই আটটা রাজ্যকে সঙ্গে করে নিয়ে যাব।
সিনেমা থেকে ফুটবল। সেখান থেকে বিশেষজ্ঞ। ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর। ‘কমফর্ট জোন’ থেকে বেরিয়ে আসছেন। টেনশন হচ্ছে না?
উঁহু। সিনেমা থেকে ফুটবল নয়। ফুটবলটাই আগে ছিল জীবনে। শেষ অবধি জীবনের একটা মোড়ে এসে খেলা ও পড়ার মধ্যে পড়াশোনাকেই বেছে নিতে হল। না হলে, হয়ত আজ ভারতীয় দলের অংশ হতে পারতাম। তবে, ফের ফুটবল নিয়ে বাঁচার সুযোগ এসেছে। এখন সেটা নিয়েই আষ্টেপৃষ্টে বাঁচতে চাই।
ভাবতে পারছি না, পিটার শিলটনের মতো কিংবদন্তি গোলকিপার, পিটার ক্রাউচ, রবি ফোলার, মিকায়েল সিভেসট্রে, সুনীল ছেত্রীদের সঙ্গে ফুটবল নিয়ে স্ক্রিন শেয়ার করব। নিজের ফুটবল খেলা, খোঁজ-খবর রাখা নিয়ে গর্ব ছিল। কিন্তু, এখন নিজের জ্ঞান তুচ্ছ মনে হচ্ছে। আমি ওখানে খালি শিখতে যাচ্ছি। মাঠে ‘টিম ফর্মেশন’, ‘টিম স্ট্র্যাটেজি’সহ ফুটবলের খুঁটিনাটি সব গিলব। নিজের দলের জন্য ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করব।
কিন্তু, ঘুরে ফিরে সেই ক্লিশে প্রশ্নটাই ফিরে আসে। ক্রিকেটসর্বস্ব এই দেশে, অন্য খেলা কবে জনপ্রিয়তা পাবে? দেড়শো কোটির দেশ কবে বিশ্বকাপে খেলবে? পারবে কি আইএফএল, আইপিএলকে টেক্কা দিতে?
ফুটবলকে টেনে তোলার জন্য একটা ধাক্কা দরকার ছিল। আর দরকার একজন তারকা। আই লিগ যে পথে প্রথম পদক্ষেপ। সেটাকেই আমরা অন্য মাত্রায় নিয়ে যেতে চাইছি। আর, মানুষ মাঠে আসে তারকার টানে। সিনে-তারকার কথা বলছি না। তারকা খেলোয়াড়। ক্রিকেটে যেমন ভারতের একজন সচিন আছেন। টেনিসে গ্ল্যামার এনেছেন সানিয়া। ফুটবলে বাইচুং অনেকটা সেই জায়গায় গিয়েছিলেন। কিন্তু, আপামর ভারতবাসী, আন্তর্জাতিক মানের ফুটবল তারকা এখনও পাননি। হয়তো আইএফএল তেমন কারও সন্ধান দেবে। হয়তো ফিফা ওয়াইল্ড কার্ড পেলে ভারতে ফুটবলই সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা হবে। আমি কেবল আইএফএল কেন্দ্রিক ভাবছি না। লাজং-এ দেশের অনূর্ধ্ব ১৯ দলে খেলা ৭০ শতাংশ ফুটবলারকে টার্গেট করা হবে। আমরা, উত্তর-পূর্বের ফুটবল পরিকাঠামোকেই তৃণমূল স্তর থেকে বদলে দিতে চাইছি। যাতে, ভবিষ্যতে এটাই ভারতীয় ফুটবলের আঁতুড়ঘর হতে পারে। আমি মুনাফা লুঠতে আসিনি। এসেছি দায়বদ্ধতা থেকে। সেটাই প্রমাণ করব। কাউকে টেক্কা দেওয়া নয়, আমার স্বপ্ন একদিন আইএফএল, আই-লিগ মিলেমিশে প্রিমিয়ার লিগ খেলা হবে ভারতে।
আইপিএল পরবর্তী জমানায়, এহেন প্রতিযোগিতা মানেই বেটিং-এর হাতছানি আর সন্দেহ। কী ভাবে দলকে দূরে রাখবেন?
(এই প্রথম হাসিকে ছাপিয়ে গেল ক্রোধের অভিব্যক্তি) আমি, এই জন আব্রাহাম, সশরীরে দাঁড়িয়ে আছি আমার ড্রেসিংরুম আগলে। দেখি কোন জুয়াড়ির কত হিম্মত। আমার দলের খেয়োলাড়দের সঙ্গে খেলার আগে হোক বা পরে, কোনও অবাঞ্ছিত লোকের যোগাযোগ বন্ধ। কড়া নজর রাখা হবে। নীতা অম্বানীর সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। দলে নিয়মিত কর্মশালা হবে, মনোবিদ আসবেন। আমি জিততে এসেছি ঠিক। কিন্তু, প্রয়োজনে অষ্টম হব, তবু, দলের দিকে কেউ যেন আঙুল তুলতে না পারে।
কলকাতা তো অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। আপনারা কি কোনও বিদেশি দলের সঙ্গে যোগ দেওয়ার কথা ভাবছেন?
মালিকানার স্তর থেকে নয়। তবে, খেলার জন্য গাঁটছড়া বাঁধার ব্যাপারে বেশ কিছু দলের সঙ্গে কথা চলছে। তবে, আমাদের ভিত্তি হবে লাজং-এর খেলোয়াড়রাই। এর পর, প্যানেলে থাকা বিদেশিদের দিকে হাত বাড়াব।
বিশ্বকাপে ফেভারিট দল কে?
দেখুন আমার কাছে ফুটবল মানেই ব্রাজিল। ওদের খেলা কবিতার মতোই। কিন্তু, এইবার আমি আর্জেন্তিনার উপরে বাজি ধরছি। এদিকে, জার্মানি সবচেয়ে যুব দল নিয়ে নামছে। দৌড়েই অন্য দলের দম শেষ করে দিতে পারে ওরা। আর ডার্ক হর্স বেলজিয়াম।
শিবদাস ভাদুড়ির জীবন নিয়ে ছবি ‘১৯১১’। মোহনবাগানের গোরা বাহিনীকে হারাবার সেই ইতিহাসে আপনিই পর্দার নায়ক হতে চলেছেন। প্রস্তুতি কোন পর্যায়ে?
সবচেয়ে সুবিধা, আমি ফুটবলের এ-বি-সি-ডিটা জানি। সুজিত (সরকার) আপাতত রিসার্চ ওয়ার্কটা করছে। আমায় একটাই নির্দেশ দিয়েছে মাস্ল বাড়ানো নয়, পেটানো, পাতলা চেহারা ধরে রাখতে হবে। কাজ একটু এগোলে বাংলার পুরোনো ফুটবলারদের সঙ্গে কথা বলতে চাই। এটা কেবল একটা ফুটবল ম্যাচ নয়, একটা ‘পিরিয়ড পিস’। তাই, সেই সময়কার বাংলাকে বুঝতে হবে। খেলার ধারাও ছিল অন্যরকম। বাংলার ফুটবল নিয়ে পড়াশোনাও করতে হবে মনে হচ্ছে।
আর বাংলা শেখা?
আমি বাংলা অল্প-বিস্তর জানি তো! তবে, সিনেমার ভাষার মতো পারব না। বাংলা আরও অনুশীলন করতে হবে। তবে ঠিক উচ্চারণ আসবে। অনেক বাংলা ছবি দেখতে হবে। যেমন, ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’।
এর পর, আর কোনও বাংলা ছবির নাম মনে আনতে পারলেন না।
শর্ত মেনেই সাক্ষাৎকার শেষ।
তবে, অ্যাদ্দিন ধরে, বাঙালি পরিচালক আর বাঙালি সহ-প্রযোজকের সঙ্গে থাকার পরেও, জন আব্রাহামের কণ্ঠস্থ বাংলা ছবির নাম সেই ২০০৯ সালেই আটকে রয়েছে কেন? যাক্গে, ব্যক্তিগত হয়ে যাবে ব্যাপারটা। সব সম্পর্ক তো আর কাল্পনিক নয়।