যোদ্ধা

শিশির সর্বাধিকারীর লেখা ‘অভি লে বাগদাদ’ বইখানা, আমার মতে, বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ-বিষয়ক স্মৃতিকথাগুলোর একটি। আদতে ছিল একটা ডায়েরি। সেই ডায়েরি সর্বাধিকারীবাবুর সঙ্গে ঘুরেছে কত না ভ্রমণে। মেসোপটেমিয়ায়, সিরিয়ায়, তুরস্কে, ভূমধ্যসাগরের পুব দিকের যে অঞ্চলটা ‘লেভান্ত’ নামে পরিচিত, সেখানেও। বুটের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়েই সে সাক্ষী থেকেছে ক্লেশকর বহু পথ-হাঁটার। এমনকী লেখক তাকে সঙ্গে রেখেছিলেন প্রিজন ক্যাম্পেও, যেখানে ডায়েরিটা কেউ খুঁজে পেয়ে গেলে সমূহ বিপদ ছিল। এত শত যুদ্ধ পেরিয়েও যে ডায়েরিটা আস্ত, অক্ষত ছিল, এটাই এক অসম্ভব মির্যাক্ল।

Advertisement

অমিতাভ ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৪ ০২:৩১
Share:

ছবি: দেশকল্যাণ চৌধুরী

শিশির সর্বাধিকারীর লেখা ‘অভি লে বাগদাদ’ বইখানা, আমার মতে, বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ যুদ্ধ-বিষয়ক স্মৃতিকথাগুলোর একটি।

Advertisement

আদতে ছিল একটা ডায়েরি। সেই ডায়েরি সর্বাধিকারীবাবুর সঙ্গে ঘুরেছে কত না ভ্রমণে। মেসোপটেমিয়ায়, সিরিয়ায়, তুরস্কে, ভূমধ্যসাগরের পুব দিকের যে অঞ্চলটা ‘লেভান্ত’ নামে পরিচিত, সেখানেও। বুটের মধ্যে লুকিয়ে লুকিয়েই সে সাক্ষী থেকেছে ক্লেশকর বহু পথ-হাঁটার। এমনকী লেখক তাকে সঙ্গে রেখেছিলেন প্রিজন ক্যাম্পেও, যেখানে ডায়েরিটা কেউ খুঁজে পেয়ে গেলে সমূহ বিপদ ছিল। এত শত যুদ্ধ পেরিয়েও যে ডায়েরিটা আস্ত, অক্ষত ছিল, এটাই এক অসম্ভব মির্যাক্ল।

সেই ডায়েরিটাই বই হয়ে উঠল। পরে।

Advertisement

বইয়ের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেশ অনেকটা গেলে পাওয়া যাবে ছোট্ট একটা অনুচ্ছেদ। এই যাত্রার ইতিহাস, লেখকের কথায়। তুলে দিলাম এখানে:

মার্চ ১৮, ১৯১৭

এর পর প্রায় এক বছর আমার জার্নালে কিছু লিখতে পারিনি। প্রথমত, লেখার সুযোগ পাওয়াটাই ছিল মস্ত কঠিন একটা ব্যাপার। আর তা ছাড়া, অনেক লেখা নিজেকেই ছিঁড়ে ফেলতে হয়েছিল, কেউ খুঁজে পেয়ে যাবে, এই ভয়ে। পরে তার কিছু কিছু আবার লিখেছি, আবার অনেক লেখা লিখতে পারিনি। যে ডায়েরির কথা এত ক্ষণ বললাম, আবার পরেও বলব, সেটাই আমার প্রথম ও একমাত্র ডায়েরি, তা ভাববেন না। ভাবলে ভুল হবে। কুৎ-এ সারেন্ডার করার পর আমি আমার ডায়েরিটা ছিঁড়ে ফেলেছিলাম। প্রত্যেকটা পাতা কুটিকুটি করে ফেলেছিলাম, তার পর ভরে রেখেছিলাম আমার বুটের মধ্যে। অনেক পরে— বাগদাদে— সেই ছেঁড়া টুকরোগুলো থেকে নতুন একটা জার্নাল তৈরি করেছিলাম। পায়ে হেঁটে টাইগ্রিস নদী পেরোনোর সময় এই জার্নালটাও নষ্ট হয়ে যায় পরে। লেখাগুলো কিন্তু পুরোপুরি মুছে যায়নি, একটা পেনসিলে লিখেছিলাম বলে। খাতাটা শুকোলাম, আর পরে সামারা থেকে রাস আল-আইন অবধি যে পথ হাঁটতে হয়েছিল, তার বর্ণনার জন্য ব্যবহার করলাম। রাস আল-আইন’এ কিছু দিনের জন্য ডায়েরিটা মাটির তলায় পুঁতে ফেলতে হয়েছিল বটে, কিন্তু খুব একটা কিছু ক্ষতি হয়নি তাতে। আলেপ্পো-র হাসপাতালে থাকার সময় ডায়েরিটা আবার লিখলাম। (পৃ: ১৫৬-৭)

এই বর্ণনাই, শিশির সর্বাধিকারীর ‘অভি লে বাগদাদ’ বইটিকে অসামান্য এক দ্রুতি দিয়েছে। লেখকের বর্ণনায় যুদ্ধ, বন্দিদশায় দীর্ঘ পথ-হাঁটা, প্রিজন ক্যাম্প, সবই যেন হয়ে উঠেছে আশ্চর্য জীবন্ত। আর কোনও ভারতীয় ভাষায় এ রকম লেখা অন্তত আমি পাইনি। তবে আমার ধারণা, মরাঠিতে একই রকমের বই অন্তত একটা থাকা উচিত, কেননা মেসোপটেমিয়ায় যুদ্ধ করেছিল যে সেনারা, তাদের অনেকেই ছিল মরাঠি।

কিন্তু বইটার গুণগত মানই সব নয়। আমি বলতে চাইছি লেখক, মানুষ শিশির সর্বাধিকারীর কথা। তিনি শুধু এক জন দারুণ জীবন-দর্শকই নন, তাঁর বর্ণনা আশ্চর্য রকমের দ্বেষহীন, পক্ষপাতহীন। যে বিভীষিকা তিনি নিজে চোখের সামনে দেখেছেন, যে আতঙ্কের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা তাঁর হয়েছে, তার সামনে দাঁড়িয়েও তিনি অন্য মানুষের মধ্যেকার মানবতা, মানবিকতাকে ভোলেননি। সে ‘অন্য মানুষ’ তাঁর শত্রু, অপহরণকারী দুর্বৃত্ত হলেও।

আস্তে আস্তে তিনি তুরস্কের ভাষাতেও স্বচ্ছন্দ হয়ে ওঠেন। তুরস্কের সৈন্যদের রোজকার সাধারণ জীবনযাপনের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে যে অ-সাধারণ, তা ফুটে ওঠে তাঁর চোখের সামনে। তিনি বুঝতে পারেন, ওরা যে বন্দিদের পাহারা দিচ্ছে, তাদের থেকে এদের অনেকের অবস্থা বরং বেশি খারাপ। এমনকী অনেক সময়ই তাঁর লেখায় ফুটে ওঠে এমন এক মনোভাবও, যেন তিনি স্রেফ দূর থেকে দেখছেন আর লিখে যাচ্ছেন এক একটা জাতির আখ্যান। অথচ সামান্য কোনও ভান, ন্যূনতম আড়ম্বর ছাড়াই। এটাই তাঁর লেখার সবচেয়ে বড় গুণ। হরবখ্ত মাথা-নাড়া, মহাবিজ্ঞ-মার্কা হাবভাব তাঁর বিন্দুমাত্র নেই। আগাগোড়া তিনি অকৃত্রিম, অকপট।

যুদ্ধের রোজনামচা লিখেছেন, এমন কোনও লেখকের বর্ণনাতেই সচরাচর এই গুণগুলো থাকে না। বিশেষত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বর্ণনার ক্ষেত্রে এটা আরও বেশি সত্যি। সময়টাই ছিল এমন, যে কোনও লেখকই (এমনকী চরম প্রতিভাবান লেখকরাও) নিজের জাতের বাইরেই মনুষ্যত্বের মতো বৈশিষ্ট্য দেখতে পেতেন না বললেই চলে, আর অন্য জাতের, ধর্মের বা দেশের মানুষ হলে তো প্রশ্নই নেই।

শিশির সর্বাধিকারীর অনন্য অনুভূতিপ্রবণতার চিহ্ন ধরা আছে বইয়ের নামেও। তিনি নিজেই বর্ণনা করেছেন: সিক্সথ পুনা ডিভিশন-এর কমান্ডিং অফিসার, মেজর-জেনারেল চার্লস টাউনসেন্ড ১৯১৫ সালের ৩ নভেম্বর বলেন: ‘আমরা সাহিল, কুরনা, কুৎ আল-আমারা এবং এ রকম আরও অনেক অঞ্চল জিতে নিয়েছি। এ বার আমাদের লক্ষ্য বাগদাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া।’ আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম যে বাগদাদ জিতে নিতে কোনও সমস্যাই হবে না, এর অন্যথা যে আদৌ হতে পারে, মনেই আসেনি। অনেক ইউনিটের ব্রিটিশ অফিসাররা বলাবলি করতে থাকে যে ১৯১৫ সালের ক্রিসমাসটা বাগদাদেই উদ্যাপন করা যাবে।

কিন্তু উলটোটা হল। বাগদাদ দখলের বদলে আমরা বরং বাগদাদ থেকে পিছু হটতে বাধ্য হলাম। উম আল-তাবুল’এর পর এমন এক মার্চিং অর্ডার এল, আমরা এক ফোঁটা বিরতি না নিয়ে শুধু হাঁটতেই থাকলাম। আমার পাশে হাঁটছিল সিক্সটি সিক্সথ পঞ্জাবি ডিভিশনের এক মুসলমান সেপাই। পা থেকে বুটজোড়া খুলে নেওয়া, ফিতে দিয়ে বাঁধা একটা আর একটার সঙ্গে। রাইফেল হাতে সে খুঁড়িয়ে চলছিল আর নিজের মনে বলছিল, ‘ইয়া আল্লা, অভি লে বাগদাদ’। ‘বেশ তো বলেছিলি, ‘এখন লক্ষ্য বাগদাদ’, এ বার বোঝ ঠ্যালা!’

লেখকের অনুমতিক্রমে তাঁর

http://amitavghosh.com/blog/?p=4404 থেকে অনূদিত

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement