ছবি: সৌভিক দে
বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ: এই আধডজন নমুনায় শ্রেণিবদ্ধ বাঙালির মধ্যে অবশ্যই তাঁরা নেই, যাঁদের উদ্যোগী মনন জীবনের যাবতীয় ঝড়ঝাপটা সামলে সফল রোদ্দুর এনে দিয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ একান্ত সেই সব বঙ্গসন্তান ঘিরে, যাঁদের জীবনের প্রতি সমবেত মনোভাব তৈরি করে দিয়েছে আজকের বাঙালির ভাবমূর্তি।
বাঙালি মানেই কোথাও কেউ চক্রান্ত করছে
বাঙালি মানেই একটা বঞ্চনার সাইনবোর্ড কোথাও না কোথাও অনিবার্য ছাইচাপা। পারলাম না কেন? যাব্বাবা! বুঝিসনি? হতে দিল না তো! আটকাতে পারলি না কেন? সব মিলে ষড়যন্ত্র করল না!
বাঙালি অবিমিশ্র ভাবে চক্রান্তপ্রিয়। বাঙালি মানেই নিজের না পারা ব্যাখ্যার জন্য অনিবার্য একটা ষড়যন্ত্রের অ্যাঙ্গেল। বাঙালি মানেই কোথাও না কোথাও কেন্দ্রের চক্রান্ত ঘটেই চলেছে! হয় মনমোহন সরকার তাকে ভাতে মারছে। নয়তো কোনও বাজপেয়ী। নইলে কোনও রাজীব গাঁধী। দিন বদলায়। সরকার বদলায়। বাঙালির ওপর বঞ্চনা আর শেষ হয় না। সেই ১৯১১-তে রাজধানী দিল্লি চলে যাওয়ার পর থেকেই বাঙালি মনে মনে নিজেকে এক দিকে, অন্য দিকে গোটা ভারতবর্ষকে কল্পনা করে নিয়েছে। বাঙালি মানেই তার ললাটলিখনে বঞ্চনার রূপকথা।
আসলে বাঙালি চিরকালই জঙ্গি ইউনিয়ন নেতা। কখনও শিল্পপতি নয়। ব্রাঞ্চ অফিস হওয়াতেই তার অপার্থিব আনন্দ। হেড অফিস হতে নয়। আর হেড অফিসের কেষ্টবিষ্টুদের বিরুদ্ধে সে অবিরাম যুদ্ধ ঘোষণা করে চলেছে। সে যুদ্ধ ছায়াযুদ্ধ হলেও চলবে। কিন্তু তাকে প্রতিবাদী ছায়ানট হতে হবে। মনে মনে তাই বাঙালি কখনও চ্যাম্পিয়ন নয়। বরাবর চ্যাম্পিয়নের চ্যালেঞ্জার। আর গোঁয়ার্তুমিতে ভরা গোটা ভারতবর্ষ ও দিকে থাকলেও সে একা নিজেকে আরও শক্তিশালী ঠাওরে রেখেছে। টেনিদা সিনড্রোম। গড়পড়তা বাঙালির ভেতরে একটা করে টেনিদা রয়েছে। দাবিতে গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন সে। আদতে কোনও লড়াই না লড়েই।
বাঙালির হেরে যাওয়াতেও একটা মহাভারতীয় কুশন থাকবে
বাঙালি পরাজিতের মধ্যেও একটা আইডেন্টিফায়িং ফ্যাক্টর খোঁজে। বাঙালি কখনও আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ‘হিংস্র রিয়েলিটি চেক’ করে না। জন্মগত প্রতিভার পাশাপাশি যা সচিন তেন্ডুলকরের মননেরও বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু বাঙালি তাতে রাজি নয়। জয়ের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতিতে সে যাবে না। অন্য উন্নতিশীল জাতের মতো চান্স ফ্যাক্টরের কাঁটা পদে পদে নির্মূল করার জন্য খাটবে না। অথচ সে জিততে চাইবে। আর যদি স্টার্টিং ল্যাপেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে?
তাতেও কুছ পরোয়া নেই। সে ‘ভাল খেলিয়াও পরাজিত’-তে দুর্ধর্ষ খুশি। ইংরেজিতে যাকে বলে ‘গ্যালান্ট লুজার’। বাঙালির প্রিয় মহাভারতীয় চরিত্র অর্জুন নয়। কর্ণ। উপন্যাস-চলচ্চিত্র থেকে বাঙালি একাত্ম হওয়ার মতো আর এক চরিত্র খুঁজে পেয়েছে— দেবদাস। ইতিহাসে এটাই থাকবে যে কোনও এক বাঙালি ভারতীয় ক্রিকেট এবং তার মাধ্যমে আধুনিক প্রজন্মকে শিখিয়েছিল, গ্যালান্ট লুজার হতে চেয়ো না। খুব খারাপ জিনিস। হিংস্র ভাবে জিততে চেয়ো। ওটাকেই বলে জীবনে থাকা। জীবন থেকে পালিয়ে গিয়ে জীবনে জেতা যায় না। বাঙালি তা থেকে শিখেছে বলে অভিযোগ নেই।
বাঙালি মানেই খাটতে অনাগ্রহী হবে
‘বাঙালি জাগো’ আওয়াজ তুলে যিনি আধুনিক সময়ে শিবসৈনিকের মুম্বইয়েও একটা সময় তুফান তোলার চেষ্টা করছিলেন, সেই মিঠুন চক্রবর্তী দ্রুত হাল ছেড়ে দেন। হাল ছেড়ে দেওয়া সেই মিঠুন ফিল্মস্টার নন। রাজনীতিবিদও নন। উদ্যোগপতি। চেন অব হোটেল্স-এর মালিক। শুরুর দিকে যিনি চাকুরিপ্রার্থী কোনও বাঙালি হলে উৎসাহে আটখানা হতেন, তিনি পরবর্তী কালে বাঙালি প্রার্থী দেখলে ভুরু কুঁচকেছেন। ‘আরে জয়েন করেই এক মাসের মধ্যে বলতে শুরু করে মা খুব অসুস্থ। একবার আমায় চোখের দেখা দেখতে চাইছেন। সেটা যদি বা হ্যাঁ করলেন। তিন মাস বাদে বাড়ি থেকে ফোন আসবেই যে বাবা মৃত্যুশয্যায়। ছুটি চাই। কেউ কেউ আবার ছ’মাস পর বলবে, পারছি না অ্যাডজাস্ট করতে।’ এরাপল্লি প্রসন্ন একবার অনূর্ধ্ব-১৭ বাংলা দল নিয়ে চেন্নাই গিয়েছিলেন। নামার পর তাঁর অভিজ্ঞতা হয় যে প্রত্যেকেই অবিরত অভিযোগ জানিয়ে যাচ্ছে। কেউ খাওয়া নিয়ে। কেউ থাকার জায়গা নিয়ে। ‘আমি ওদের বোঝাতে গিয়ে একটা সময় হাল ছেড়ে দিই। আসলে ওরা চেন্নাইয়ে বসেও ‘কলকাতা’ খোঁজে। হয় নাকি?’ প্রসন্ন-র শ্বশুরবাড়ি সূত্রে প্রচুর বাঙালি আত্মীয়স্বজন বলেই বোধহয় দ্রুত আবিষ্কার করতে সুবিধে হয়েছে যে বাঙালি সব সময় কমফোর্ট জোন চায়। সেই জোনের বাইরে গেলেই তার সিস্টেমের মধ্যে আমাশা শুরু হয়।
বাঙালি মানেই তার মেনুতে সবচেয়ে সুস্বাদুূ খাবার ‘চাটনি দিয়ে মেখে কুয়োর ব্যাঙ’
ঐতিহাসিক ভাবে বাঙালিই দিগ্দর্শক। ভারতের সর্বকালের অন্যতম সফল ক্রিকেট-অধিনায়কের মুম্বইয়ের বাড়ির ড্রয়িংরুমে আজও স্বামী বিবেকানন্দের ছবি। আর নীচে লেখা, ওঠো, জাগো, নির্ভীক হও, লড়াই করো। কিন্তু সেই বাঙালি কালের নিয়মে বিদায় নিয়েছে। সত্তর-আশির দশকের বাঙালি-রাজ এমনই ক্ষয়িষ্ণু সময়ের প্রতিনিধি যে নিজের বাইরের বড় জগৎটা দেখতে রাজি নয়। সে ফুটবল মাঠে হাঙ্গামা বাধিয়ে একটা অভিশপ্ত ১৯৮০-র ১৬ অগস্ট ঘটিয়ে এই ভেবেও লজ্জিত হয়নি, বিশ্ব ফুটবলের ক্যানভাসের পাশে ওটা কোনও ফুটবলই ছিল না। অথচ মৃত্যুবরণ করেছিল ষোলোটি তাজা প্রাণ। বাঙালি ডিএনএ মানেই প্রতিটি জাতীয় পুরস্কার ঘোষণার পর তীব্র তর্ক: আমাদের ছবি স্রেফ রাজনীতির শিকার হয়ে প্রাইজ পেল না। এটা না জানতে চেয়েই, সে বছরের মালয়ালম ছবিটা কী দুর্দান্ত ছিল!
বাঙালি মানেই নিজের অবস্থার জন্য নিজেকে ছাড়া আর সবাইকে তীব্র দোষারোপ
বাঙালি নিজেকে নির্যাতিত বলে শুধু ভেবে এসেছে তা-ই নয়, ভেবে চলেছে। ও দ্যাট বং— এ ভাবে নাকি গোটা ভারত বাঙালিকে দেখে, আর তার ওপর বৈষম্য শানায়। যা শুনে উত্তেজিত ইতিহাসবিদ রামচন্দ্র গুহ। ‘এই স্টিরিয়োটাইপ শুরু করেছে বাঙালি নিজে। অথচ তার ছ্যাঁকাটুকু নিজের গায়ে লাগলেই সে অস্থির। বাঙালিই তো পঞ্জাবিকে পাঁইয়া বলার, দক্ষিণ ভারতীয় মানেই তাকে মেড্রু বলার অভ্যেস করেছে। ওড়িশাবাসীকে উড়ে বলে বিদ্রুপ শুরু করেছে।’
সরল সত্য, প্রতিটি ভাষাভাষীর প্রোটোটাইপ চলতে চলতে তার সম্পর্কে একটা জমাট ধারণা তৈরি হয়ে যায়। আবার তার সংস্কারও হয়, যদি সংস্কার সাধনের উপযুক্ত লোকজন পাওয়া যায়। যে ভারতীয় সমাজ বাঙালি পুরুষকে ভীরু আখ্যা দিয়েছে, তারাই আবার বঙ্গললনাকে সুন্দরী আখ্যা দিয়েছে। বলেছে, মিষ্টি দই কিনতে হলে কলকাতাতেই সেরা জিনিসটা মিলবে। কিন্তু বাঙালির সমস্যা হল যে, সে এই সত্যটা মানতে কিছুতেই রাজি নয় যে কোনও কিছু যথেষ্ট ভাল হলে কোথাও না কোথাও কেউ তার কদর করবেই। কোনও কিছুর কদর হল না, বাঙালির কাছে এই ঘটনার অনিবার্য উপসংহার হল, পাথরচাপা কপাল। আর সমস্যা নিরসনের সহজ উপায়? কেন? জ্যোতিষীবাবার আংটি!
বাঙালি মানেই অজুহাতের চচ্চড়ি
স্পোর্টস মোটিভেশন ট্রেনিংয়ে একটা কথার চল আছে, দেয়ার ইজ অলওয়েজ রুম অ্যাট দ্য টপ। শীর্ষে যদি কেউ উঠতে পারে, সে সব সময়ই বসার জন্য খালি চেয়ার পাবে। উত্তমকুমারের সময়ও হিন্দি ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি বাঙালি নায়ককে ব্যঙ্গ করত ‘রসগোল্লা বাবু’ বলে। বলত ও বেঙ্গলি হিরো— স্লো স্লো ট্রলি চালাও। উত্তর কলকাতার চক্কোত্তিবাড়ির ছেলে পরে সেটা বদলেছে। ক্রিকেটেও তাই। একটা সময় বলা হত, বাঙালি ভাগতা হ্যায়। বিপদ হলেই পালায়। বাঙালি অধিনায়ক সেটাকে শুধু ভুলই প্রমাণ করেনি, লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা উড়িয়ে গোটা ভারতকে বীররসে ভরিয়ে দিয়েছে। মানুষই ভাবমূর্তি গড়ে, মানুষই তা বদলায়— এই সার সত্য বাঙালি মানতে রাজি না। পি কে বন্দ্যোপাধ্যায় এক বার সখেদে বলেছিলেন, ‘বাঙালিকে কোচিং করানো অতি বিষম বস্তু। কিছু করতে বললে পালটা তর্ক জোড়ে, কেন করব?’ পি কে-র উপলব্ধি: ভারতীয় মিলিটারিতে কেন একটা বাঙালি রেজিমেন্ট নেই, আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। একাধিক স্থানীয় প্রশিক্ষকেরও তাই ধারণা, বাঙালি গুলতানিতে সেরা, কর্মে নয়। আর বাই চান্স যদি কেউ কাজ করতে শুরুও করে, তাকে নিরস্ত করার জন্য কতকগুলো বাঙালি কাঁকড়া তো থেকেই গেল। সেগুলো ঠিক ততটা বিষাক্ত, যতটা আফ্রিকার ব্ল্যাক মাম্বা! বাঙালিকে প্রধানমন্ত্রী করার প্রশ্নে দলীয় ভোটাভুটিতে বাঙালিই না বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিল!