নীরা, তোমায় দেখে হঠাৎ নীরার কথা মনে পড়লো।
নীরা, তোমায় দেখি আমি সারা বছর মাত্র দু’দিন
দোল ও সরস্বতী পূজোয়– দুটোই খুব রঙের মধ্যে
রঙের মধ্যে ফুলের মধ্যে সারা বছর মাত্র দু’দিন—
নাছোড়বান্দা দোল। প্রেম, রং, গান, বিষাদ আর রিক্ততার দোল। সে কালের রাধাই হোক বা এ কালের রুপস (রুপসা), রঙের হাতে ধরা পড়লে তার আর নিস্তার নেই। আবীরে, আগুনে, দহনে ফুল ফোটার সঙ্গে ফুল ঝরার খেলা।
সে দিনের সোনাঝরা সন্ধ্যায়
একদা রাধা-কৃষ্ণের বাঁধনছেঁড়া প্রেমযাপনের উৎসবই তো শুনিয়েছিল হাজার কোকিলের দোল খেলার ডাক। সেখান থেকেই শুরু, তারপরে হুতোম প্যাঁচার নকশা বলছে জেলেপাড়ার সঙের পথে নামার কথা, ইতিহাস বলছে রাজা নবকৃষ্ণ দে-র বাড়ির দোলের সন্ধের বাঈনাচের কথা, সব দর্শক কনিয়াক হাতে সাহেবসুবো।
দিন গড়াল।
পাথুরিয়াঘাটা ঘোষ পরিবারে পুরনো তরফের, অর্থাৎ ভূপেন্দ্রকৃষ্ণ-মন্মথনাথের বাড়ির দোল-উৎসব অনুষ্ঠিত হচ্ছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে। আর ছোট তরফ, খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়ির দোল আরম্ভ হয় ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। দুই শরিকের দোলের আচার-অনুষ্ঠান প্রায় একই রকম। দোলের আগের দিন সন্ধ্যাবেলা বেশ জাঁকজমক করেই হয় মেড়া পোড়ানোর অনুষ্ঠান চাঁচর, খেলাৎচন্দ্র ঘোষের বাড়িতে দোলের আগের দিন বসন্ত নাচের অনুষ্ঠান। সে দিন বাড়ির নাচঘরের মেঝেতে আবীর ছড়িয়ে দিয়ে তার ওপরে নাচতেন সে যুগের নামী নৃত্যশিল্পীরা।
শোভাবাজার দেব পরিবারের চাঁচরের গান অন্যতম বৈশিষ্ট্য। বহুকাল আগে পরিবারের সদস্যেরা এই গান লিখে গিয়েছেন। সুরও দিয়ে গিয়েছেন। পুরনো সেই পরম্পরা মেনে চাঁচরের দিন সেই গানগুলি এখনও গাওয়া হয়। এই গানের অনুষ্ঠানে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করেন পুরুষ-নারী নির্বিশেষে। গান শেষ হলে আরম্ভ হয় প্রসাদী বাতাসার ‘হরির লুঠ’ দেওয়া এবং ফাগ খেলা, সবশেষে ভূরিভোজ।
চোরবাগান শীল পরিবারে রয়েছে নিজস্ব ‘পূজা-পদ্ধতি’ পুস্তিকা। সেখানকার বর্ণিত নিয়ম মেনেই হয় এখানকার সমস্ত পুজো। চোরবাগান এলাকার ধনাঢ্য গৃহস্বামী রামচাঁদ শীল ও তাঁর স্ত্রী ক্ষেত্রমণি দাসী ১৮৫৫ সালে এই পরিবারের গৃহদেবতা রাধাদামোদর জিউ-এর দোল উৎসব আরম্ভ করেন। দোলের সমারোহটাও দেখার মতো। শীল পরিবারের দোল-উৎসব হয় সাধারণত দোলের এক দিন পরে। চাঁচরের দিন ঠাকুরবাড়ির বাগানে হোলিকার কুশপুতুল পোড়ানোর পরে আরম্ভ হয় গানবাজনার অনুষ্ঠান। আগেকার দিনে, এই শীল পরিবারে দোলের জন্য আলাদা গান লেখা হত, সুর দেওয়া হত এবং মাসখানেক ধরে তার মহড়া দেওয়া হত। দোল উপলক্ষে সেই সব গান নিয়ে প্রতি বছর প্রকাশ করা হত গানের পুস্তিকা, যাতে উপস্থিত সকলে সেই গানের বই দেখে সমবেত সঙ্গীতানুষ্ঠানে যোগ দিতে পারেন।
শরীরে দোল
সারা ভারতের ‘হোলি’র পাশাপাশি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রইল বাঙালির এই পার্বণ, ‘শান্তিনিকেতনে’ পা রাখলেই যা বসন্তোৎসব। ভারতবর্ষের যে কোনও কালচারাল ফেস্টিভালেই শারীরিক যোগ থাকে। কোলাকুলি, প্রণাম এই ধারাগুলো চলে আসছে সেই প্রাচীন কাল থেকে। দোলও সে রকমই একটা উৎসব। আমাদের প্রজন্মের কাছে দোল ছিল প্রেমের সময়, একটু আবীর গালে লাগিয়ে বুঝিয়ে দেওয়া, ‘তোমাকে চাই’। অথবা গানের সুরে বাঁধন বা বসন খোলার ইঙ্গিত। হলুদ শাড়িতে কয়েকগুচ্ছ মেয়ের, ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল’ বলে নেচে ওঠার সরাসরি সম্প্রচার দেখানোর অগুন্তি চ্যানেল তখনও জন্ম নেয়নি, তবু আমবাঙালির তাবৎ অশান্তিনিকেতনেও ওই একটি দিনের গায়ে লেগে থাকত কাঁচা হলুদ রং। তবে শরীর থেকে মনে পৌঁছনোর যে রাস্তা সে বেছে নিত, তার নাম, ‘গান’। সকাল থেকে সন্ধ্যা হাওয়ায় শুধু আবীর নয়, শরীর মিশে যেত গানের নেশায়।
শোলে’র, “হোলি কে দিন দিল খিল যাতে হ্যায়” থেকে শুরু করে কাটি পতঙ্গ’-এর “চাহে ভিগে রে তেরি চুনারিয়া, চাহে ভিগে রে চোলি” আর সর্বোপরি, সিলসিলা’র ‘রঙ্গ বরষে...’ ১৮ আনা বাঙালিয়ানায় ঢুকে পড়ল ‘রঙ্গ বরষে’ পরকীয়ার দোল। কিন্তু এই রঙের খেলাতেও থেকে গেল না ছাড়ার দুষ্টুমি!
আসলে মাল্টিপ্লেক্স বা শপিং মল বা কফি শপ আসার আগের তিরিশ-চল্লিশ বছর ওই সুরে-সুরেই প্রেম আসত শহর বা শহরতলিতে, “রং শুধু দিয়েই গেলে/আড়াল থেকে অগোচরে” গানের মধ্য দিয়ে। প্রতিটি দোলের দিন ছিল স্বাধীনতা দিবস!
ভার্চুয়াল দোল
এর পরে এল সাউথ সিটি আর সিটি সেন্টার। এল হাইরাইজ। আর সঙ্গে এল কানে হেডফোন গুঁজে পাড়ার ভিতর দিয়ে আশি কিলোমিটার স্পিডে বাইক নিয়ে বেরিয়ে যাওয়া সব ‘নূতন যৌবনেরই দূত’, যাদের কাছে এখন ‘লেটস প্লে হোলি!’ এখন পাড়ার দোলের জায়গায় হোলি পার্টি মাস্ট। পুরনো জামাকাপড়ের দোল খেলা এখন ব্যাকডেটেড। চাই স্টাইলিশ সাদা পোশাক সঙ্গে বিউটি ট্রিটমেন্ট।
এই প্রজন্ম বসন্তের জন্য দিন গোনে না, গোনে তার নিজের বাসন্তী রংয়ের ফেসবুক প্রোফাইলে কটা লাইক এল? বসন্তের মনকেমন করা ঝরা পাতার শব্দ-গন্ধ আজ ঢেকে গেছে জেন ওয়াইয়ের ‘হোলি হ্যায়’-এর রিংটোনে। কোনও উঠতি গায়িকা বসন্ত সুখে কলেজের সিড়িতে গলা ছেড়ে গান গেয়ে ওঠে না। সে তার গলা বাঁচিয়ে রাখে হোলির মেহফিলে মুগ্ধ শ্রোতাদের বশ করবে বলে। বসন্তকে বশ করাতে সে আর আনন্দ পায় না। কলেজের উঠতি কবিও ফাগুন হাওয়ায় নিজের কবিতার খাতা ভরিয়ে লুকিয়ে রাখে না তার প্রেয়সীর জন্য। ফেসবুকের দেওয়ালে সে কবিতা না উঠলে তো তার বসন্তই ব্যর্থ। তাই মাঝেমধ্যে রং-আবীর ছাড়াও বসন্তের রংবাজিতে মাতছে জেন ওয়াই। বন্ধুরা সব দূরে? কুছ পরোয়া নেই, মোবাইল তো আছে। এসএমএস থেকে ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ থেকে স্কাইপ, রং না মেখেই দিব্যি ‘হ্যাপি হোলি!’ দোলের দিন তিনেক আগে থেকেই রং ছড়াচ্ছে নেট-দুনিয়া।
বিয়ের পর প্রথম রঙের উত্সবেই অনসাইট-প্রবাসে আইটি কর্মী আবীর সেন। আজ, দোলের দিনটা স্ত্রী পারমিতার জন্য রঙিন করে তুলতে নানা উজ্জ্বল রং দিয়ে ই-কার্ড তৈরি করে ফেলেছে আবীর। রং মেলানোর শুভক্ষণে পারমিতার টাইমলাইনে পোস্ট করবেন সেটাই। বাকি বন্ধুদের জন্যও তৈরি নানা রঙে ভর্তি পিচকিরি, বেলুন।
কাজের সূত্রে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাওয়া বন্ধুদের আর এক বার একজোট হওয়ার অজুহাতও তো দোলই। সকলে অন্য শহরে? সেটা আবার সমস্যা নাকি! গবেষক অঙ্কিতা আর তাঁর বন্ধুদের তাই হোলি স্পেশ্যাল চ্যাট-গ্রুপ তৈরি। বন্ধুরা মিলে আতিপাতি খুঁজে বেরিয়ে পড়েছে কলেজ জীবনের হোলির ছবি। দু’এক দিন আগে থেকেই চ্যাট গ্রুপে আপলোড হচ্ছে নিজেদেরই রং মাখা অবতার। সঙ্গে রংচঙে বার্তা তো আছেই!
খেলব হোলি রং দেব না
দোলে আবার অনেক অফিসই খোলা। তাই বলে কি বাদ যাবে উদ্যাপন? দমছেন না তরুণ কর্মীরা। প্ল্যান হয়ে গিয়েছে পার্টির। এইচআর-এর কড়াকড়িতে অফিসে আবীর-রং বাদ। তাই দোলের দিনের পোশাকেই থাকবে নানা রং, জানালেন আইটি কর্মী রূপম। খাওয়াদাওয়া, হুল্লোড় তো থাকছেই।
জমিয়ে রং না মাখলে যাঁদের সাদাকালো লাগে দিনটা, উদ্যাপনে টুইস্ট আনছেন তাঁরাও। কী পরবেন, কী মাখবেন থেকে কী খাবেন, হোলি টিপসের ছড়াছড়ি সর্বত্র। ফিল্মি কায়দায় হোলি পার্টিও বেশ ‘ইন’। সব দেখেশুনে অনেকে স্রেফ দোলের জন্য কিনেছেন সাদা ডিজাইনার পোশাক। বাদ যাচ্ছে না গয়না, জুতো, হোলি স্পেশ্যাল চশমাও। ইন্টারনেট ঘেঁটে বেরোচ্ছে ভাঙ-ককটেল-ভাজাভুজির নিত্যনতুন রেসিপিও।
পেশায় ব্যবসায়ী চয়ন জানালেন, ডিজাইনার টিপস্ মেনে সাদা পোশাক-হোলি চশমায় উদ্যাপন প্রায়ই দেখা যায় সল্টলেকের রাস্তায়। ‘‘আমাদের ছোটবেলায় যেমন সবচেয়ে খারাপ জামাটা তুলে রাখতাম রং খেলার জন্য, এখন দেখি রেওয়াজটাই পাল্টে গিয়েছে। রং খেলতেও নামছে নতুন জামা,” বলছেন তিনি। দোলের এই রং-বদলটা চোখে পড়েছে বেসরকারি সংস্থার কর্মী সোহম, পায়েলেরও। বললেন, “ছোটবেলার মতো পাড়ায় রং মেখে ভূত হওয়ার বদলে অনেকে এখন আবীরটাই বেশি পছন্দ করছেন। আসলে বাঙালি বোধহয় প্রফেশনাল হয়ে গিয়েছে! দোলের পর দিন ক্লায়েন্ট মিটিংয়ে কি আর বাদুরে রং মাখা লাল মুখ নিয়ে যাওয়া যায়? সঙ্গে স্বাস্থ্য সচেতন হয়ে রাসায়নিক রং-আবীরের চেয়ে ভেষজ আবীরই এখন জনপ্রিয় জেন ওয়াইয়ের কাছে।”
হারা ফাগুন রাতি
‘দোল মানে হলদে শাড়ি, দোল মানে রবীন্দ্রনাথ, পলাশ আর বেগম আখতার। এই ফ্লেভারটা অন্য আড্ডায় মেলে না। তাই যতই সরস্বতী পুজো বা ভ্যালেন্টাইনস ডে আসুক, দোলের পথ চেয়ে থাকি’, বললেন বছর পঁচিশের আয়ুসি। আবীরের গন্ধেই প্রেম এসেছিল ওর জীবনে। দোল যেমন ‘বসন্ত উৎসব’, ঠিক তেমনই দোল মানে ‘হোলি’। রাখঢাক না করেই আইটি সেক্টরের দীপ্তার্ক বলছে, ‘দোল মানে মেয়েদের কাছাকাছি পৌঁছে যাওয়া। রং বরষে আর ভাঙ নাচনের দিন।”
আর দোলের গান? হাসাবেন না প্লিজ! দোলের আগের দিন কলকাতার অলিতে-গলিতে মদের দোকানগুলোর সামনে যে বিরাট লাইন পড়ে, খাদ্য-আন্দোলনের সময় কোনও রেশন দোকানের সামনেও তত বড় লাইন পড়েনি হয়তো। সেই লাইনের বাসিন্দাদের ভদকা-জিন-হুইস্কি নিয়ে যতটা পরিকল্পনা, গান নিয়ে তার শতাংশের এক ভাগও নেই। যেটুকু আছে তার মধে একটা যদি হয়, “ডু মি আ ফেভার, লেট’স প্লে হোলি”, তো অন্যটা, “বালম পিচকারি/যো তুনে মুঝে মারি/তো সিধিসাধি ছোড়ি শরাবি হো গ্যায়ি”। কবে যেন কে বলেছিলেন, “তিথির পরে তিথির ঘাটে আসিছে তরী দোলের নাটে।’’
তিনি কি অবসোলিট হয়ে গেলেন পুরোপুরি?
একেবারেই না! রবিঠাকুর শহরতলির ফার্ম হাউস, ছাদের বাগান বা বসন্তের একলা ঘরের মন হু হু করা সন্ধ্যায় বা ফাগপূর্ণিমার জোছনা ভর্তি রাস্তায় পলাশের নেশা ধরিয়ে দেন! আজও!