• ‘লুটেরা’ দেখার পর তিনি পরিচালক বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানেকে বলেছিলেন ছবিটা তাঁর দারুণ লাগলেও এ যেন আইপিএলের জমানায় দর্শককে টেস্ট ক্রিকেট দেখানো।
• ফুটবল টিম কেনা নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, রণবীর কপূরের মতো তাঁর অত টাকা নেই যে ফুটবল টিম কিনবেন।
• কন্ডোমের বিজ্ঞাপন করতে গিয়ে স্বীকার করেছিলেন নিজের ওয়ালেটে সব সময় কন্ডোম থাকে!
গত এক বছরের মধ্যে নানা সময় এই রকম উক্তি করেছেন রণবীর সিংহ। শুনে কেউ ভেবেছেন তাঁর অভিধানে ‘পলিটিকাল কারেক্টনেস’ শব্দটা নেই। কেউ বুঝেছেন ২৯ বছরের ছেলেটা ঠোঁটকাটা। আবার কেউ কুর্নিশ জানিয়ে বলেছেন তারকা হয়ে মিডিয়ার প্রশ্নে এ ভাবে সত্যি কথা বলতে গেলে দম লাগে।
অবশ্য রণবীরের এই সব নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। আজও যে আছে অমনটা নয়। আপাতত মাথা কামিয়ে ফেলেছেন তিনি। সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘বাজিরাও মাস্তানি’র জন্য। সেখানে তিনি বাজিরাও। আর মাস্তানির ভূমিকায় আছেন দীপিকা পাড়ুকোন। যার সঙ্গে তাঁর অন আর অফ স্ক্রিন ‘স্পেশাল’ সম্পর্ক নিয়ে চর্চার শেষ নেই। গত বছর নভেম্বর মাসেই এই দীপিকাকে নিয়ে তাঁর অভিনীত ‘গলিয়োঁ কি রাসলীলা: রামলীলা’ রিলিজ করেছিল। কিছু মাস আগে ‘ফাইন্ডিং ফ্যানি’তে তিনি ছিলেন দীপিকার স্বামীর চরিত্রে।
সামনেই মুক্তি পাবে রণবীর অভিনীত ‘কিল দিল’। দুই খুনির গল্প। যার একজন রণবীর। এখানে তাঁর নায়িকা দীপিকা নন। ‘লেডিস ভার্সেস রিকি বহেল’য়ে তাঁর নায়িকা পরিণীতি চোপড়া এ ছবির হিরোইন। সঙ্গে রণবীরের চাইল্ডহুড হিরো গোবিন্দা।
পরিণীতি আর দীপিকা - দু’জন অভিনেত্রীর মধ্যে পার্থক্য কী? “ব্যক্তি হিসেবে দু’জনে বেশ আলাদা। ২০০৭-৮ থেকে দীপিকা সিনেমায় অভিনয় করছে। অভিজ্ঞতা বেশি। দীপিকার থেকে অন্তত তিন/চার বছর পরে পরিণীতি বলিউডে এসেছে। দু’জনে আলাদা রকমের এনার্জি বহন করে চলে,” বলেন রণবীর। ব্যাপারটা একটু খোলসা করে বলতে অনুরোধ করলে রণবীর জানান, “পরিণীতি হল উচ্ছল। সেটে গেলে দেখবেন ও একদম হার্ডকোর পঞ্জাবি মেয়ের মতো। ঘুরে বেড়াচ্ছে, ফুতির্র্ করছে। ডিরেক্টর/কো-অ্যাক্টরদের সঙ্গে মজা করছে।” আর দীপিকা? “পিসফুল এনার্জি আছে ওর মধ্যে। এই নয় যে দীপিকা এনজয় করতে ভালবাসে না। ও শান্ত। তবে ‘রামলীলা’র বিষয় ইনটেন্স। তাই হয়তো সেখানে দীপিকাও ও রকম ছিল।”
‘পিকু’র জন্য দীপিকা শ্যুটিং করছেন কলকাতায়। আসবেন নাকি এই শহরে তাঁর মাস্তানিকে সারপ্রাইজ ভিজিট দিতে? কলকাতা রণবীরের পরিচিত শহর। ‘গুন্ডে’ আর ‘লুটেরা’র শ্যুটিং করছেন এখানে। সাক্ষাত্কার নেওয়ার সময় রণবীর জানতেন না যে দীপিকা কলকাতায় শ্যুটিং করছেন। “তাই নাকি? আসলে একটা ব্যবসায়িক কারণে কলকাতাতে আমার যাওয়ার কথা। ফিল্মের কিছু কাজে। দেখি....”
দীপিকা তাঁর থেকে বয়সে এক বছরের ছোট। মিডিয়া তাঁদের সম্পর্ক নিয়ে নানা রকমের কথা বললেও রণবীর এখন আর তা পাত্তা দেন না। জিজ্ঞেস করলে শুধু বলেন দীপিকার থেকে তিনি কত কী শিখেছেন। কী ভাবে সাফল্যে গা ভাসাতে নেই, কী ভাবে শত ব্যস্ততা থাকলেও স্ট্রেস নিতে নেই আর কী ভাবে ইনসিকিওর না হয়ে নিজের জায়গাটা ধরে রাখা যায়... তবে ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে কচকচানি শুরু করলেই রণবীর ব্যাকফুটে। দীপিকা কবে তাঁর গাড়ি চেপে ‘গন গার্ল’ দেখতে গিয়েছিলেন তা জেনে মিডিয়ার কী লাভ? নায়ক মানে তাঁর ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে কথা হবেই। তাই বলে তার কাজের থেকে বেশি গুরুত্ব তো এ সব পেতে পারে না!
কলকাতার প্রসঙ্গ এলে নিজেই মনে করিয়ে দেন যে আগের বার সাক্ষাত্কার দেওয়ার সময় হোটেলের পুলসাইডে আমাদের চিত্রগ্রাহক জলে পড়ে গিয়েছিলেন। “বাংলাতে ‘গুন্ডে’র গানগুলো কী জনপ্রিয় হয়েছে! ‘গুন্ডে’ তো টেলিভিশনেও দারুণ জনপ্রিয় হয়েছে। আজকাল প্রায় প্রত্যেক সপ্তাহে দেখবেন ছবিটা টেলিভিশন চ্যানেলে দেখাচ্ছে,” বলেন তিনি।
১৪ নভেম্বর মুক্তি পাচ্ছে ‘কিল দিল’। শাদ আলির ছবি। যে শাদ এক সময় ‘সাথিয়া’র মতো জনপ্রিয় ছবি পরিচালনা করেছেন। ‘কিল দিল’ যশরাজ প্রযোজিত ছবি। তবে ‘বান্টি অউর বাবলি’র পরে আর হিট ছবি দিতে পারেননি শাদ। হিতৈষী সেজে কেউ কি তাঁকে বলেননি যে সেই শাদের সঙ্গে কাজ করাটা বেশি রিস্কি? শুনে রণবীর বলেন রিস্ক নেওয়াটা তাঁর কাছে নতুন ব্যাপার নয়। কেরিয়ারের প্রথম দিকেই ‘লুটেরা’ বেছে নেওয়াটা রিস্ক-ই ছিল। “জানতাম বিক্রমাদিত্য একজন অনেস্ট পরিচালক। নিশ্চিত ছিলাম ছবিটা ভাল বানাবে,” বলেন তিনি।
এই বছর তো আবার কন্ডোমের বিজ্ঞাপন করলেন। বলিউডের মূল ধারার তারকারা হঠ্কে কিছু করতে গেলেই ভয় পান। অনেকেই নেগেটিভ বা সমকামী চরিত্র করতে চান না। আজ পর্যন্ত রণবীর ছাড়া কোনও মূলধারার ছবির নায়ক কন্ডোমের বিজ্ঞাপন করেননি। মডেলদের তাতে আপত্তি নেই। সানি লিওনেরও সেই সব নিয়ে ছুঁত্মার্গ ছিল না। রিস্ক নেওয়ার সময় কেউ যদি বলে ‘তুমি এটা প্রথম করেছ’ তা হলে কি একস্ট্রা মজা পান তিনি? “আলবাত তাই,” হেসে বলেন রণবীর। তার পর স্বীকার করেন, “সেফ খেলায় তো নতুন কিছুই নেই।”
ব্র্যান্ড রণবীর মানে কি রিস্ক? “অত ভাবিনি। অর্গ্যানিকালি আমার রিস্ক নিতে বেশ ভাল লাগে।’’
আচ্ছা, এই রকম ঝুঁকি নিলে বাবা-মা রেগে যান না? বলেন না ‘বাছা, আশা করি বুঝতে পারছ কী করতে চলেছ?’ “ঝুঁকি নিলেও প্রচুর সাপোর্ট পেয়েছিলাম। আদি স্যর (আদিত্য চোপড়া) আর আমার বাড়ির লোকেরা বলেছিল ‘গো উইথ ইওর ইনস্টিংক্টস।’ আমি দেখলাম ব্যাপারটা বেশ কুল। আর আমাদের দেশে যৌনতা নিয়ে যে লুকাছুপি হয় সেই দৃষ্টিভঙ্গিটা তো পাল্টাতেই হবে।”
জনপ্রিয় নায়কের একটা বিজ্ঞাপন। তাতে কি সমাজের দ্বিচারিতা কমেছে? দৃষ্টিভঙ্গির ফারাক নিয়ে আলোচনা না করে রণবীর বলেন, “আই অ্যাম ফিয়ারলেস। ভয় পাই না। আর যা কিছু করি সেটা অনেস্টলি করি। সিনসিয়ারলি করি। যখন ঝুঁকি নিই তখন মনটা পজিটিভ রাখি। জানি যেটা করছি সেটা খারাপ কিছু নয়। সেই থেকেই বিশ্বাস জন্মায় যে, এই কাজের মাধ্যমে কিছু পজিটিভ মানুষের সঙ্গে কানেক্ট করতে পারব।”
তবে তাঁর জীবনের সবথেকে বড় রিস্ক হল অভিনয় করতে আসা। তিন কুলে এমন কেউ ছিল না যে অভিনয় করে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে ঢুকেও আবার বাছাবাছি শুরু করেছিলেন। তিন-তিনটে ছবিতে অফার পেয়েও ‘না’ বলেছিলেন। তা শুনে তো এক প্রযোজক রেগে গিয়ে বলেই দিয়েছিলেন যে লোখন্ডওয়ালাতে এ রকম শ’য়ে শ’য়ে উঠতি অভিনেতা আছে যারা এই রোল করার জন্য হাতটাও কেটে দেবে। তবু রণবীর রাজি হননি। তারপর অবশ্য তাঁর জীবনে আসেন আদিত্য চোপড়া। বাকিটা যাকে বলে ইতিহাস।
শাদয়ের ছবিতে কাজ করার রিস্ক নেওয়াটা তাঁর কাছে কোনও বিশাল ব্যাপারই নয়। “শুধু ‘সাথিয়া’ কেন, আমার শাদয়ের সব কাজ ভাল লেগেছে। ‘বান্টি অউর বাবলি’ খুব পছন্দের। ‘ঝুম বরাবর ঝুম’ ছবিটাও আমার খুব পছন্দ। ছবিটা যদি এখন মুক্তি পেত তাহলে হিট হত!”
সাত বছর আগের ছবি ‘ঝুম বরাবর ঝুম’। তবে বক্স অফিসে চিঁড়ে ভেজেনি। “ছবিটা সময়ের চেয়ে অনেক আগে তৈরি হয়েছিল। আমাদের দেশের দর্শক ফিল্মে চায় ইমোশন। আর ‘ঝুম বরাবর ঝুম’য়ের ক্ষেত্রে অনেকেই বলেছেন ছবিতে সেটাই কম ছিল। হালকা ফুলকা ফ্রিভোলাস ছবি বলেই ধরে নিয়ে ছিল অনেকে। আজকালকার দিনে তো ওই হালকা ফুলকা ছবিও রমরমিয়ে চলে। কোনও গুরুগম্ভীর ব্যাপার নেই। তাই তো বলছি এ ছবি এখন তৈরি হলে সেটা হিট হতই,” বলছেন রণবীর।
শুধু যে ‘কিল দিল’য়ের ডিরেক্টরের প্রতি আনুগত্য রেখেই এ কথা বলা এমনটা নয়। কথা বলতে বলতে চলে যান পুরনো দিনে। কেরিয়ারের প্রথম দিকে তিনি বেশ কিছু বিজ্ঞাপনে শাদের অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন। দু’-তিনমাস এ রকম কাজ করার মধ্যেই শাদ বলেছিলেন ক্যামেরার পিছনে নয়, রণবীরের জায়গা ক্যামেরার সামনে। “দু’জন আছেন যাঁরা প্রথম থেকেই আমার ট্যালেন্টে বিশ্বাস করে এসেছেন। একজন কাস্টিং ডিরেক্টর শানু শর্মা। অন্য জন শাদ,” বলেন রণবীর।
তখন থেকেই শাদের সঙ্গে সম্পর্ক গুরু আর চেলার মতো। অ্যাসিস্ট্যান্ট ডিরেক্টর এক রকম আর বলিউডে জনপ্রিয় তারকা হওয়াটা অন্য ব্যাপার। সাফল্যে পেশাদার জগতের সমীকরণগুলো ওলটপালট হয়ে যায়। শাদের সঙ্গে সেটা পাল্টায়নি? “না, একদম না। আজও সেই গুরু চেলাই রয়েছি। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিই দু’জনে। কখনও এন্টারটেন করছে। কখনও বা সিরিয়াস কিছু আলোচনা করছে। কত রকমের যে গল্প আছে শাদের ঝুলিতে।” শাদ যে আড্ডাবাজ এমন কথা মিডিয়াতে অন্তত কেউ বলবেন না। অনেকটা আদিত্য চোপড়া ঘরানায় বিশ্বাসী তিনি। আর সেই শাদ সম্পর্কে রণবীর বলছেন যে তিনি খুব হুল্লোড়ে! “দেখুন, শাদ আমাদের সঙ্গে ব্যক্তিগত লেভেলে মেশে। পরিচিতি নিয়ে ওর বেশি মাথাব্যথা নেই। সেই বিজ্ঞাপন করার থেকেই স্বপ্ন দেখতাম শাদের ছবিতে অভিনয় করার।”
আর সেই ছবিটা নাকি ‘কিল দিল’। রণবীরের দাবি ছবিটা দেখলেই নাকি শাদের ছাপ পাওয়া যাবে সেখানে। তাঁর ভাষায় ‘চূড়ান্ত দেশি’ সিনেমা। গান-অ্যাকশন-অনুভূতির মিশেল রয়েছে সেখানে। আর গল্প? “হ্যাঁ, সেটাও রয়েছে। শাদ ঠিক করে রেখেছিল যে, যত দিন না চিত্রনাট্যটা ওর মনমতো হচ্ছে তত দিন ও ফিল্ম করবে না।”
‘কিল দিল’য়ে না হয় একটা ঠিক মতো চিত্রনাট্য রয়েছে, বলছেন রণবীর। তবে এটা তো ঠিক যে আজকাল বহু এ রকম বাণিজ্যিক ছবি রমরমিয়ে ব্যবসা করে যেগুলোর গল্পের কোনও মাথামুণ্ডু নেই। হৃতিক থেকে শাহরুখ থেকে সইফ সব্বাই তো এ রকম ছবি করছেন। রণবীর নিশ্চয়ই এ ধরনের ছবির অফার পেয়ে থাকেন। কিন্তু করেন না কেন? “আমি এই ধরনের ছবির অফার পেয়ে থাকি। বুঝতে পারি সেগুলো তৈরি করা হয় বিনোদন দেওয়ার জন্য। আমি নিজে অবশ্য একদম ব্রেনলেস ছবিতে কাজ করতে পারি না। যদিও এটা বলে রাখা ভাল যে যাঁরা এগুলো বানান বা অভিনয় করেন তাঁদের আমি একদম বিচার করি না।” দর্শক হিসেবে তিনি কি এ ধরনের ছবি দেখতে পছন্দ করেন? “মাঝে মধ্যে হালকা ছবি দেখতে খারাপ লাগে না। এন্টারটেনমেন্ট প্যাকেজ হাই থাকে সেখানে। তবু ব্রেনলেস হওয়ারও তো একটা পার্সেন্টেজ থাকে। এ রকম কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছে যেখানে ছবিটা এতটা ব্রেনলেস যে আমি দেখতে পারিনি...” সেগুলোর নাম? “কিছু নাম যে ভেসে আসছে না তা নয়। ওগুলো একদম ট্র্যাশ... না থাক, এখানে নামগুলো বলা ঠিক হবে না।”
আগেকার রণবীর হলে গড়গড় করে সিনেমার নামগুলো বলে যেতেন। তোয়াক্কাই করতেন না, তাতে কে কী ভাবল! তবে এখনকার রণবীর পরিমিত। সোনালি প্যাটার্নের ব্লেজার, কোবরা প্রিন্টের স্যুট, হ্যারি পটারের চশমা পরতেই পারেন তিনি। এমনকী ছবির প্রচারে গিয়ে জুতোর দু’পাটিতে আলাদা আলাদা করে ‘কিল’ ‘দিল’ লিখে ঘুরতে তাঁর আপত্তি নেই। তবে কথা বলতে গেলে তিনি পারতপক্ষে বিতর্ক এড়িয়ে চলেন। সত্যিটা বলেন ঠিকই। কিন্তু কতটা বলবেন সেই ঝুঁকিটা মেপে নিতে শিখে গিয়েছেন রণবীর সিংহ।