জানেন আমার মোবাইলে মাঝে মাঝে ফোন আসে দিদির।
সেই বিখ্যাত গলায় বলেন, “সোনুজি বোল রহে হ্যায়...”
আজ অবধি বুঝিনি কেন আমাকে সোনুজি বলেন তিনি? জিজ্ঞেস করারও সাহস হয়নি। তবে এটাই বুঝেছি এই ‘তেহজীব’টার জন্যই তিনি লতা মঙ্গেশকর।
আর এমনিতে বাকিদের ফোন এলে আমি যে অবস্থায় থাকি সেই অবস্থাতেই কথা বলি। হয় শুয়ে, না-হয় সেন্টার টেবিলের ওপর পা তুলে।
কিন্তু দিদির ফোন এলে বিশ্বাস করবেন না আমি কিন্তু সোজা দাঁড়িয়ে, ‘হাঁ দিদি, বোলিয়ে’ বলে কথা শুরু করি। এই রেসপেক্টটার লেভেলই আলাদা। এবং এই সম্মানটা লতা মঙ্গেশকরকে দেব না তো কাকে দেব বলুন?
আজ আনন্দplus-এ ওঁর গায়কি নিয়ে কথা বলার আগে আমি কয়েকটা কথা বলতে চাই আপনাদের পাঠকদের।
হিন্দিতে একটা কথা আছে ‘ভগবান কে দান কো টুকড়ে মে মত বাঁটিয়ে।’
দিদির গানের ক্ষেত্রেও কিন্তু একই কথা প্রযোজ্য। স্কুলের ফিজিক্স বইকে আলাদা চ্যাপ্টারে ভাগ করা যায়। মার্কেটিংয়ের নানা দিক নিয়ে আলাদা আলাদা বই লেখা যায়। কিন্তু দিদির গায়কিকে কম্পার্টমেন্টালাইজ করা যায় না। কিন্তু তা-ও আমি আমার মতো চেষ্টা করছি লতা মঙ্গেশকরের গানের বিভিন্ন দিককে বিশ্লেষণ করার।
ওটা দৈব লেভেল
প্রথমেই বলি এই পৃথিবীতে তিন রকমের শিল্পী আছেন।
প্রথম শ্রেণি হল যাঁরা গান গাইতে পারেন না। সুর লাগাতে জানেন না। কিন্তু তাঁরা মনে করেন তাঁরা শিল্পী। এ রকম বহু গায়ক-গায়িকাকে আমি ‘ইন্ডিয়ান আইডল’য়ে দেখেছি।
দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পীরা গান নিয়ে অসম্ভব প্যাশনেট। সারা দিন তাঁরা গান নিয়ে ভাবেন। সাধনা করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিশ্লেষণ করেন বিভিন্ন গানের। প্রত্যেকটা গানের হরকত, মুরকি, সুরকে কী ভাবে আরও ভাল করা যায় তার চেষ্টায় থাকেন দিনের পর দিন, রাতের পর রাত। তাঁরা রেওয়াজও নিয়মিত করেন পাঁচ থেকে ছ’ঘণ্টা। আমরা বেশির ভাগ গায়ক যারা একটু আধটু নাম করেছি, তারা এই শ্রেণিতেই পড়ি। আর এর ওপরে একটাই লেভেল হয়।
দৈব।
এটাই এক্সেলেন্সের শেষ ধাপ। এটা ভগবানের রূপ। লতা মঙ্গেশকর এই দৈব লেভেলের আর্টিস্ট। আপনি দিনের পর দিন রেওয়াজ করুন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা গান নিয়ে পড়ে থাকুন, তা-ও আপনি এই লেভেলটা ছুঁতে পারবেন না।
আমার কাছে ক্রিকেটে এই লেভেলটা সচিন তেন্ডুলকর অর্জন করেছিল।
আর গায়কিতে দিদি।
এই নে লতাকে পাঠালাম
কিন্তু দিদিও তো মানুষ, দিদিও পারফেক্ট নয়। দিদিরও তো কাশি হয়। দিদির গলাও তো কোনও কোনও দিন খারাপ হয়। ইমপারফেকশন কি নেই? নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু ক্লোজেস্ট টু পারফেকশন যদি কিছু থেকে থাকে, সেটা লতা মঙ্গেশকরই।
কখনও কখনও আমার মনে হয় ভগবান মর্তের মানুষের আর্তি শুনে বলেছিলেন, ‘আমাকে অনুভব করতে চাস তো তোরা? ঠিক আছে। এই নে, লতাকে পাঠালাম।’
ভারতবর্ষে তো অনেক বড় বড় ক্লাসিকাল সিঙ্গারও তৈরি হয়েছেন। তাঁদের আমি অসম্ভব শ্রদ্ধাও করি। কিন্তু বলতে বাধ্য হচ্ছি লতা মঙ্গেশকর নন তাঁরা। ওটা আর হবে না। বড় বড় পণ্ডিতকেও দেখেছি পাগল হয়ে যেতে যখন দিদি একটা সুরকে ধরে সেটাকে অন্য লেভেলে নিয়ে যান। তাঁরা শুধু ওয়াহ্, ওয়াহ্ করতে থাকেন, আর বলেন ‘সোনু, অ্যায়সে ক্যয়সে গা সকতি হ্যায় ও? আমি শুনি তাঁদের কথা। আর ভাবি এটার জন্যই তো দিদি দিদি।
সুনামি অব সিডাকশন
এ বার একটু গানের বিশ্লেষণে আসি। আমাদের শেখানো হয়, স্পেশালি ফিল্মের গানের ক্ষেত্রে কিছু শব্দে জোর দিতে।
যেমন ‘শ্বাস’, যেমন ‘জোশ’। ‘শ্বাস’ শব্দটা প্রধানত আমরা একটু টেনে বলি যাতে সত্যি মনে হয় নিশ্বাস নিচ্ছি। তেমনই ‘জোশ’ বললেই আমরা একটু জোর দিয়ে বলি যাতে শব্দের এনার্জিটা ঠিক মতো ব্যক্ত হয়।
কিন্তু বিশ্বাস করুন, দিদির এ সবের দরকার হয় না। ওঁর গানে এই শব্দগুলো থাকলে খেয়াল করবেন উনি কিন্তু কোনও এক্সট্রা এফর্ট দিচ্ছেন না। ওঁর দরকারই হয় না। আমাদের মতো সিঙ্গারদের সেটা দরকার হয়।
না হলে ওই ক্যাবারে গানটার কথা ভাবুন, ‘আ জানে যা’।
যে কোনও ফিমেল সিঙ্গার ওই গানটায় গলাটাকে সেক্সি করবে, রঞ্চি করবে, ‘আহ্’ শব্দটাকে ভাঙবে যাতে আরও মাদকতা আসে।
একমাত্র লতা মঙ্গেশকরের এ সবের দরকার হয় না। উনি শুধু সুরে গেয়ে দেবেন গানটা। এবং এমন করে গাইবেন যে ‘জান’-টা ক্যাবারেও লাগবে, কিন্তু গায়কিটা এফর্টলেস মনে হবে। উনি ততটুকুই নুয়্যান্স আনবেন তাঁর গলায়, ঠিক যতটা দরকার। কখনও তার ওপরে যাবেন না। কখনও তার নীচে আসবেন না। আমি তো প্রায়ই বলি এই একটা গানেই দিদি বুঝিয়ে দিয়েছেন গলা দিয়েও কী ভাবে ‘সুনামি অব সিডাকশন’ তৈরি করা যায়।
আমার কাছে ‘মন মোহনা’ একটা মাস্টার ক্লাস
এই ক্যাবারে দিয়ে যদি দিদির গায়কির একটা দিক বোঝানো যায়, তা হলে আরও দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী গানের কথা বললে আপনাদের ওঁর রেঞ্জটা বুঝতে সুবিধে হবে।
‘আল্লা তেরো নাম...’।
যাঁরা গান শেখেন বা গান, তাঁদের অনেক সময় গুরুজিরা বলেন দরদ দিয়ে গাও। আমাকেও বলতেন আমার গুরুজিরা। আমি ঠিক বুঝতাম না দরদ দিয়ে গাওয়া গান কাকে বলে। তার পর একদিন এক সন্ধেবেলায় ‘আল্লা তেরো নাম’টা শুনলাম। ব্যস, তার পর থেকে আর আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি ‘দরদ’ মানে কী। আমার কাছে ওই গানটা একটা লেসন ইন লাইফ।
এটা তো একটা লেভেল গেল।
এ বার আমি একটা অন্য গানের প্রসঙ্গে আসি। ছবির নাম ‘সীমা’। সুরকার শঙ্কর-জয়কিষেন। ওই ফিল্মে দিদির একটা গান ছিল। ‘মন মোহনা বড়ে ঝুটে’।
আমি এ বার এক স্টেপ নীচে নেমে কথাটা বলছি। ওই গান আমাদের মতো সিঙ্গাররা শুরু করে দেবে সুরে সুর লাগিয়ে। প্রথম স্ট্যাঞ্জাটা গেয়ে দেবে। সেকেন্ড স্ট্যাঞ্জাটাও গেয়ে দেবে। কিন্তু ওটা হাতির লেজ। আসল হাতি তখনও বাকি।
আমরাই যদি গেয়ে দিতে পারি তা হলে লতা মঙ্গেশকর, লতা মঙ্গেশকর থাকবেন কী করে?
ওই গানটার শেষ স্ট্যাঞ্জাতে লতা মঙ্গেশকরের গলার কিছু হরকত আছে। পারলে এই লেখাটা পড়ে আর এক বার শুনবেন গানটা। এমন একটা রেঞ্জে গানটাকে নিয়ে গিয়ে দিদি শেষ করেছেন যেটা অভিনব, অকল্পনীয়।
আমি ভারতের যে কোনও সিঙ্গারকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছি আনন্দplus-এর মাধ্যমে: কেউ যদি ওই গানটা একটা টেক-এ গাইতে পারে ওই পারফেকশনে, তা হলে আমি নিজে গিয়ে তাকে প্রণাম করে আসব।
আমি এতটাই কনফিডেন্ট যে আমাকে সেই কাজটা করতে হবে না। তার কারণ, ‘মন মোহনা’ একটা মাস্টারক্লাস। আমি আজও সময় পেলেই শুনি গানটা। নিজের মতো করে চেষ্টাও করি গাইতে। কিন্তু কোনও দিন পারিনি দিদির মতো সুরগুলো লাগাতে।
সবচেয়ে ইন্টেলিজেন্ট মানুষের নাম লতা মঙ্গেশকর
এ তো গেল দিদির গানের মাস্টারক্লাসের কথা। দিদির ব্যক্তিত্বের আর একটা দিকের কথাও আমি বলতে চাই। আমি মোটামুটি মানুষ চিনি, এত দিন ইন্ডাস্ট্রিতে থেকে কে কী রকম, তার ধারণা আমার হয়ে গিয়েছে।
আমি সবার কথা (মাইন্ড ইউ, সবার কথা) ভেবে একটা স্টেটমেন্ট করছি। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে ব্রাইটেস্ট, সবচেয়ে ইন্টেলিজেন্ট মানুষের নাম লতা মঙ্গেশকর।
আপনি দিদিকে বোকা বানাতে পারবেন না। চিট করতে পারবেন না। ওঁর অ্যাডভান্টেজ নিতে পারবেন না। ওঁর আশেপাশে থেকে শুধু চামচাগিরি করলেও উনি আপনাকে ছুড়ে ফেলে দেবেন। উনি এতটাই ইন্টেলিজেন্ট। এবং তাই জন্য ওঁর পেরিফেরি, ওঁর আশেপাশে কাউকে আসতে দেন না।
ওঁর সামনে আপনি কাউকে ক্রিটিসাইজ করতে পারবেন না কারণ উনি সেটা পছন্দ করেন না। কোনও ফালতু জোক মারতে পারবেন না। কাউকে ছোট করে কোনও কথা বলতে পারবেন না।
এবং এগুলো বন্ধ করতে কিন্তু ওঁর গলার আওয়াজ বাড়াতে হয় না। দিদির একটা চাউনিতে আপনি বুঝে যাবেন আপনি ভুল করে ফেলেছেন।
এতে আমার একটা থিওরি আছে।
‘কোহিনুর’ হিরে দেখে মানুষের দু’টো রিঅ্যাকশন হয়। হয় কোহিনুরের শুধু প্রশংসা করা। না হয় কী করে কোহিনুর চুরি করে তার অ্যাডভান্টেজ নেওয়া যায়, তার ফন্দি আঁটা।
তাই কোহিনুরকে সাবধান হতে হয় যাতে সে বুঝতে পারে কোন প্রশংসাটা অনেস্ট, আর কে তার অ্যাডভান্টেজ নেওয়ার কথা ভাবছে।
তাই আক্ষরিক অর্থে কোহিনুর আর ‘দিদি’র কোনও তফাত নেই আমার কাছে।
আমাকে অনেকে এটাও জিজ্ঞেস করে, আপনি তো দিদির এত ক্লোজ। কখনও দিদিকে জিজ্ঞেস করেননি ‘শ্রী ৪২০’য়ের গানের রেকর্ডিংয়ে কী হয়েছিল? বা ওই ডুয়েটটা রফিসাবের সঙ্গে গাওয়ার আগে রিহার্সাল কত বার হয়েছিল? সত্যি বলছি, আমি কিছু কিছু কথা যে জানি না তা নয়। তবে আমি কোনও দিন আগ বাড়িয়ে কোনও কথা জিজ্ঞেস করিনি।
ওঁর ক্লোজ হওয়ার কোনও অ্যাডভান্টেজ আমি নেব না বলেই কোনও দিন জিজ্ঞেস করিনি। খালি মনে হয়েছে উনি এটা না ভেবে বসেন, সোনু ওর লিমিটটা ক্রস করছে।
দিদির সামনে আমি আমার লিমিটটা জানি। এবং এটাও বুঝি, হিমালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে শুধু চোখ নামিয়ে নেওয়া উচিত। চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায় না।
আমার কাছে দিদিও তাই।
কখনও হিমালয়।
কখনও কোহিনুর।
দৈব।