বাংলা ছবিতে তো এখন গোয়েন্দাদেরই বাজার। সে কথা মাথায় রেখেই কি হিন্দিতে ব্যোমকেশ করলেন?
ষোলো বছর বয়স থেকে ব্যোমকেশ পড়া আরম্ভ করেছি। তখন থেকেই পুরনো কলকাতার ছবিটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। ২০০৭-এ ছবির জন্য চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করি। কিন্তু প্রযোজক পাচ্ছিলাম না। অবশেষে প্রযোজকের দেখা পেলাম। ছবিটাও হল।
হিন্দি ছবির নতুন প্রজন্ম যারা ব্যোমকেশ পড়েইনি তারা কি মাল্টিপ্লেক্সে টিকিট কেটে পুরনো কলকাতা দেখতে যাবে? এটা আবার সেই সঞ্জয় লীলা বনশালীর ‘দেবদাস’-এর মতো অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে না তো?
লোকে কি শার্লক হোমস দেখার জন্য লন্ডন থেকে ঘুরে আসে? না কি লন্ডনের ঘোড়ার গাড়ি, কুয়াশা, হ্যান্ডসাম ক্যাব দেখতে দেখতে দর্শক সেটার সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়ে? কী দেখানো হচ্ছে নয়, কী ভাবে দেখানো হচ্ছে সেটাই আসল। আমি আজকের লেন্সে পুরনো সময়কে ধরার চেষ্টা করেছি। রহস্যের ছবিতে সমসাময়িক মিউজিক ব্যবহার করেছি, ব্যবহার করেছি ড্রামও যাতে নতুন প্রজন্মের ভাল লাগে।
তাই বলে বাঙালি গোয়েন্দা ছবিতে চুমু, বাথটবের দৃশ্য? পরিবার নিয়ে ছবিটা দেখতে যাওয়া যাবে তো?
কেন যাবে না! একটু মনে করিয়ে দিই ‘চিড়িয়াখানা’র কথা। সেখানে গল্পে চুমুর জন্যই আত্মহত্যা হয়েছিল। শরদিন্দুর ‘দন্তরুচিকৌমুদি’র কথাও সকলের মনে আছে নিশ্চয়ই। শরদিন্দুর ব্যোমকেশে যৌনতা অনেক বারই এসেছে। যদিও প্রচ্ছন্ন ভাবে। আমি সেটাকেই সোজাসুজি দেখিয়েছি। এটা আলাদা করে বলার মতো কী এমন বিষয়?
চুমুর দৃশ্য বলেই কি স্বস্তিকা? মুম্বইতে কি অভিনেত্রী কম পড়েছিল?
আমার মনে হয় স্বস্তিকা ভারতবর্ষের সবচেয়ে ভাল অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন।
একটু বেশি গদগদ হয়ে যাচ্ছে না?
একেবারেই না। আমাকে সকলেই বলেছেন ওঁর মতো অভিনেত্রী খুব কমই আছেন। ওঁর অভিনয়ের মধ্যে ষাট-সত্তর দশকের ‘ন্যাচারাল’ অভিনয়টা দেখতে পেয়েছি। আজকের দিনে এই ধারার অভিনয় খুব জরুরি। এই স্বস্তিকাই যদি উনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় থাকতেন তা হলে নটী বিনোদিনীর একজন যোগ্য প্রতিযোগী হতেন। আগে নায়িকাদের শরীর দেখানো, গ্ল্যামার এ সবের ভিত্তিতে রেটিং করা হত। স্বস্তিকা সেই সময় ছবি করতে এসেছিলেন। এখন যদিও নারীকেন্দ্রিক ছবি তৈরি হচ্ছে। আশা করি স্বস্তিকা এই সময়টাকে কাজে লাগাতে পারবেন।
স্বস্তিকাকে আপনি বলেন?
পেশাদারি জায়গায় অভিনেতা, অভিনেত্রীদের আমি আপনি বলতেই পছন্দ করি।
কিন্তু বাংলা সাহিত্য নিয়ে ছবি করতে এসে ব্যোমকেশের জন্য বাঙালি কোনও অভিনেতাকে পছন্দ হল না?
বিশ্বাস করুন ‘ডিটেকটিভ ব্যোমকেশ বক্সী’ করতে গিয়ে আমি প্রচুর বাংলা ছবি দেখেছি। কিন্তু পাইনি কাউকে। তাই সুশান্ত।
শাশ্বতর অভিনয় করার কথা ছিল না এই ছবিতে?
হ্যাঁ। কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘C/O স্যার’ দেখে আমার শাশ্বতকে খুব পছন্দ হয়েছিল। ওঁর সঙ্গে যোগাযোগও করেছিলাম। কিন্তু ডেট দিতে পারেননি। আশা ছাড়ছি না। ভবিষ্যতে আমরা নিশ্চয়ই কাজ করব। আমি তো মনে করি শাশ্বত ইতিহাসের সেরা ‘অজিত’।
আবিরের ব্যোমকেশ দেখেছেন?
না, এখনও দেখিনি। খুব ইচ্ছে আছে দেখার। গত দু’বছর ধরে ইংরেজি বা বাংলা কোনও ক্রাইম থ্রিলারই আমি দেখিনি। আমার ছবিটা করার জন্য ইচ্ছে করেই এই ধারার ছবি এড়িয়ে গিয়েছিলাম।
‘পিকে’ দেখার চেয়ে বাঙালি কিন্তু এ বছর ব্যোমকেশ বা শবর বেশি দেখতে গিয়েছে। পরিসংখ্যানই বলছে সে কথা। আপনার টেনশন হচ্ছে না?
হ্যাঁ, একটু টেনশন তো হচ্ছেই। শাশ্বতর ‘অজিত’-এর পর আমার ছবির অজিতকে নিয়ে চিন্তায় আছি। দু’একটা ভুলভ্রান্তি আমার ছবিতে হয়তো থাকবেই। সেটা মেনে নিয়েই বলছি, এই ছবি বাঙালির নস্টালজিয়াকেও নাড়া দিয়ে যাবে।
অনেক সারপ্রাইজ রেখেছি ছবিটায়। সেটা ভাল কি খারাপ, তা আমি নিজেও জানি না। তবে ছবিটা যদি চলে, প্রযোজককে দ্বিতীয় ব্যোমকেশ করার কথা বলতে পারি।
ছবির বাজার নিয়ে আপনি বেশ চিন্তিত মনে হচ্ছে?
বাজার নয়, বাজেট নিয়ে চিন্তা করি আমি। যশরাজ প্রোডাকশনের ব্যানার না পেলে ব্যোমকেশের মতো পিরিয়ড ফিল্ম করা আমার পক্ষে সম্ভব হত না। ছবি শুরুর আগে টানা দেড় বছর আমার রিসার্চ টিম কলকাতার অলিগলিতে ঘুরে বেড়িয়েছে। রেকর্ড করেছে সেই সময়কার মানুষের নানা স্মৃতি। কেমন ছিল তখনকার কলকাতা? কুয়াশা মাখা রাস্তায় গ্যাসবাতির পাশ দিয়ে ভোরের ট্রাম যখন চলে যেত, সেই দৃশ্যটা কেমন হত। এই দৃশ্যগুলোই আমি আমার ছবিতে ব্যবহার করেছি। এটা করার জন্য অনেক সময় দিতে হয়েছে।
একটা ছবি করতে যদি এত সময় নিয়ে ফেলেন...
(থামিয়ে দিয়ে) শুনুন, আমি দু’বছরে একটা ছবি তৈরি করব। আমার কোনও তাড়া নেই।
সে কী? এখন বাংলা ছবির পরিচালকেরাই তো বছরে তিন-চারটে ছবি করেন!
দেখুন, আমার আগের ছবির সঙ্গে পরবর্তী ছবির কোনও মিল থাকে না। আপনি ‘সাংহাই’-এর পাশে নিশ্চয়ই ‘লভ সেক্স ধোঁকা’কে রাখতে পারবেন না। সে কারণেই আমাকে প্রত্যেকটা ছবি নতুন ভাবে শুরু করতে হয়। আগের ছবির অভিজ্ঞতা পরের ছবিতে কাজে লাগাতে পারি না আমি। ছবি চারটেই হোক বা একটা, হিট করাটা কিন্তু ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করি। ইঁদুরদৌড় আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
সুশান্ত সিংহ রাজপুতকেও কি ভাগ্যের ওপর ছেড়ে রাখছেন?
না, একেবারেই তা নয়। ওঁর মতো ইয়ং আপকামিং ট্যালেন্ট আমি দেখিনি।
নিজের ছবির নায়কের ওপর এতটা ভরসা?
সুশান্ত ব্যোমকেশ করেছেন বলে কিন্তু এটা বলছি না আমি। উনি পরিমিত অভিনয়ের গুরুত্বটা বোঝেন। বলিউডে এখন সব কিছুই একটু চেঁচিয়ে বলা, অতিরঞ্জিত করে দেখানোর ঝোঁক। ওভারঅ্যাক্টিং খুব বেশি হচ্ছে বলিউডে। নিউকামারদের মধ্যে সুশান্তই একজন, যিনি এ সবের বিরুদ্ধে গিয়ে ন্যাচারাল অ্যাক্টিং করতে চাইছেন। একবার ভাবুন তো ‘আফটারনুন’ টিভি সিরিয়ালেও সুশান্ত কী অসম্ভব ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন।
একটা কথা বলি। আশা করি কিছু মনে করবেন না। আপনি কিন্তু নায়কদের প্রতিই বেশি দুর্বল! এর কি কোনও কারণ আছে?
(হো হো করে হেসে) আপনি যেদিকে ইশারা করছেন, ব্যাপারটা কিন্তু সে রকম নয়। আমি নায়িকাদেরও খুব পছন্দ করি। তবে হ্যাঁ, আমার বেশির ভাগ ছবিতেই প্রতিবাদী পুরুষ চরিত্রের প্রাধান্য। এটা মেনে নিলাম। পরবর্তী ছবিতে এই পুরুষ আধিপত্যটা বদলাবে এটুকু বলতে পারি।
অভয় দেওল বা ইমরান হাসমি ‘স্টার’ হতে পারতেন না যদি না পরিচালক দিবাকর বন্দ্যোপাধ্যায় থাকতেন। কথাটা ঠিক?
(প্রায় টেবিল ছেড়ে উঠেই পড়লেন) প্লিজ এ ভাবে বলবেন না। লোকে ভাববে আমি নিজের ঢাক নিজেই পেটাচ্ছি। পরিচালক হিসেবে নতুন প্রতিভাকে খুঁজে বের করাই তো আমার কাজ। এর মধ্যে অভিনবত্ব কিছু নেই।
তা হলে শুধুই নতুন প্রতিভা? যশরাজের মতো বড় ব্যানারে দীপিকা পাড়ুকোন আর রণবীর কপূরকে নিয়ে ছবি করার কথা ভাবেন না আপনি?
আমি ভাবলেই কি হয়ে যাবে? তবে আপাতত ভাবছি না। ব্যোমকেশটা তো আগে চলুক।
বাঙালি হয়ে বাংলা ছবি করতে ইচ্ছে করে না আপনার?
বাংলা ছবি করা আমার পক্ষে খুব কঠিন। তার জন্য ৭-৮ বছর আমাকে কলকাতায় থাকতে হবে। সেখানকার ভাষা, সংস্কৃতি না জেনে তো আর ছবি করতে পারব না!
সৃজিত মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেছেন তিনি কিরীটী করতে চান। আপনিও তো শুনেছি কিরীটী-ভক্ত। ভবিষ্যতে কিরীটী করার কোনও পরিকল্পনা আছে?
ব্যোমকেশ বা ফেলুদার মতো কিরীটীও আমার ছোটবেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কিরীটী নিয়ে কিছু ভাবছি না।
আপনি কি খুব অগোছালো?
ঠিকই বলেছেন। তাই-ই। এখনও মনে হয় সিনেমা করাটা খুব ঝামেলার। পরপর কী কী ছবি করব বা তার কাস্টিং কী রাখব, ১০ নম্বর ছবিটা শাহরুখ খানকে দিয়েই করাব,
এমন কোনও প্ল্যান করে উঠতে পারি না। তার চেয়ে বরং ভোর থেকে মাঝরাত অবধি মুম্বই বা কলকাতার রাতের পাড়ার অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতে, সেখানকার মানুষগুলোর সঙ্গে প্রাণখোলা আড্ডা দিতে ভালবাসি আমি। নিজেকে এ ভাবে খুঁজতে খুঁজতেই হঠাৎই নতুন কোনও ছবির প্লট মাথায় চলে আসে। আবার শুরু হয় পথ চলা...