এ যেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্যের মতোই একটা ব্যাপার।
অন্তত বোলপুরে এসে প্রথমেই যে ভাবে আমাদের ব্যাপারটা বলা হল তা শুনে এটা মনে হওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। বোলপুরে যাওয়ার কারণ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত অভিনীত ‘বেলাশেষে’র আউটডোর শ্যুটিং। স্টেশন থেকে লোকেশনে যাবার জন্য ফিল্ম ইউনিটের এক প্রতিনিধি এসেছিলেন আমাদের নিয়ে যেতে। গাড়িতে উঠে খুব স্বাভাবিক ভাবে তাঁকে কাজকর্ম নিয়ে জিজ্ঞেস করাতে প্রথমেই তিনি চোখ বড় বড় করে বললেন, “এই শ্যুটিংয়ে একটা কাণ্ড হয়েছে!”
কাণ্ড? মানে?
সব্বাই সুস্থ আছেন তো?
ঝামেলা-টামেলা? শান্তিনিকেতনে আবার কিছু চুরি-টুরি হয়নি তো?
“এমা ছি ছি। ওই রকম কিছু নয়। এই প্রথম বার দেখছি যে শ্যুটিং করতে এসে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বিফোর টাইম পৌঁছে যাচ্ছেন।”
বলছেন কী মশাই? বোলপুরে এসে ঋতুপর্ণার হলটা কী?
“শুধু বোলপুর নয়। কলকাতাতেও একই ঘটনা ঘটেছে। প্রথম দিন আমরা হাজরার একটা বাড়িতে শ্যুটিং করছি। কলটাইম সকাল সাড়ে সাতটায়। আর ঋতুদি দেখি সাতটা পঁচিশে সেটে পৌঁছে গিয়েছেন। আমরা তো সব্বাই অবাক! হয়তো শিবু (শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়)-র সিনেমা বলেই এমনটা হচ্ছে। তবে যে কারণেই হোক না কেন ব্যাপারটা বেশ অন্যরকম,” বলে মুচকি হেসে আবার ড্রাইভারকে লোকেশনে যাবার নির্দেশ দিতে শুরু করলেন ইউনিটের সেই প্রতিনিধি।
বোঝা গেল যে বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য না হলেও শ্যুটিং ইউনিটের কাছে এটা বেশ বড় একটা গসিপ। পাংচুয়াল ঋতুপর্ণা বোলপুরে বেশ হিট! না হলে বোলপুরে প্রথম পা দিতেই এই খবরটা কানে আসে নাকি?
মনে পড়ে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’
লোকেশনে পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর। দুটো বাড়ি জুড়ে শ্যুটিং চলছে সেখানে। একশো চল্লিশ জনের ইউনিট। ছবির সব অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই সেখানে উপস্থিত। লাঞ্চের পরেই শ্যুটিং শুরু। কিন্তু এ বারে ক্যামেরা বসেছে বাড়ির সামনের মাঠে। সেখানেই গোল করে সব্বাই বসে। ফ্যামিলি পিকনিকের দৃশ্য। একটা গেম খেলা হবে। শতরঞ্চি বিছানো। কেউ এলিয়ে শুয়ে পড়েছেন। কেউ কমলালেবুর খোসা ছাড়াচ্ছেন। কেউ বা মগ্ন নিজস্বী তুলতে। ছবির অন্যতম পরিচালক নন্দিতা (রায়) মনিটরের সামনে বসে। শিবপ্রসাদ শ্যুটিংয়ের কাছে দাঁড়িয়ে। খানিকটা নাটকীয় ভাবে বললেন, “অ্যা...অ্যা... অ্যা...অ্যাকশন।”
অমনি শুরু হয়ে গেল ‘আই ওয়ান্ট টু...’ গেম।
কানে ভেসে আসে শিশুশিল্পী অরুণিমা হালদারের সংলাপ। “মনে করো টুডে ইজ দ্য লাস্ট ডে অন আর্থ। তখন তোমাদের চারটে প্রশ্ন করা হবে। আই ওয়ান্ট টু বি..., আই ওয়ান্ট টু ডু..., আই ওয়ান্ট টু মিট..., আই ওয়ান্ট টু হ্যাভ...”
এক এক করে সব্বাই উত্তর দিতে শুরু করলেন। ক্যামেরা গোল করে ঘুরতে থাকে। খরাজ মুখোপাধ্যায়ের শ্বশুরমশাই হলেন সৌমিত্র। ছবিতে পেশায় খরাজ স্বর্ণকার। স্বপ্ন দেখেন মুম্বই গিয়ে ‘কৌন বনেগা ক্রোড়পতি’তে এক কোটি জিতে, অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে দেখা করার। টিপ্পনী কেটে ছবিতে তাঁর শুচিবাইগ্রস্ত স্ত্রী অপরাজিতা আঢ্যর সম্পর্কে বলেন যে, তাঁর একমাত্র স্বপ্ন টালা ট্যাঙ্কের সব জল যেন তিনি ব্যবহার করতে পারেন! শুনে সবার সে কি হাসি! ছবিতে শঙ্কর চক্রবর্তী স্বপ্ন দেখেন লেখক হওয়ার। অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় স্বপ্ন দেখেন অ্যাঞ্জেলিনা জোলিকে পরিচালনা করার...
লম্বা দৃশ্য। শ্যুটিং দেখতে দেখতে মনে পড়ে যায় ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র মেমারি গেমের কথা। শর্মিলা ঠাকুর বুঝিয়ে দিয়েছেন খেলার নিয়ম। তার পরে একের পর এক সব্বাই নাম বলে চলেছেন।
আট মিনিট সাতচল্লিশ সেকেন্ডের সেই আইকনিক দৃশ্য!
২০১৪তেও যা অনুপ্রেরণা দিচ্ছে বাংলা ছবির পরিচালকদের।
আর দুই ছবির মধ্যে যোগসূত্র একজন।
তিনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র অসীম। ছিপছিপে গড়ন। শতরঞ্চিতে বসে সিগারেটে সুখটান দিতে দিতে যিনি বলেছিলেন “রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপেট্রা, অতুল্য ঘোষ, হেলেন অব ট্রয়, মাও সে তুং, ডন ব্র্যাডম্যান, রানি রাসমনি, ববি কেনেডি, টেকচাঁদ ঠাকুর, নেপোলিয়ান, মমতাজ মহল...”
তার পর শর্মিলার পালা। কিছুক্ষণ ভেবেছিলেন, “বোধহয় পারব না... আমার হরিবাবুর দশা হয়েছে... না, আউট। অসীমবাবু জিতলেন!”
কাট টু নাগরদোলার দৃশ্য। শর্মিলা-সৌমিত্র নাগরদোলায়।
২০১৪র ‘বেলাশেষে’র সৌমিত্রর হাতে সিগারেট নেই। শার্টপ্যান্ট বদলে পাজামা পঞ্জাবি। শতরঞ্চি নয়। মোড়াতে বসা। ‘রবীন্দ্রনাথ, কার্ল মার্ক্স, ক্লিওপেট্রা...’র বদলে তিনি অন্য সংলাপ বলছেন, স্বপ্ন দেখছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি ছাপানোর। দেখা করতে চান নোবেল লরিয়েট কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে....
স্কোরটা কত হল
ব্রেকের সময় মোড়া ছেড়ে উঠে এলেন সৌমিত্র। তার পর জানতে চাইলেন স্কোরটা কত? শ্যুটিংয়ের মাঝেও অস্ট্রেলিয়াতে টেস্টম্যাচের খবরটা নিতে ভুললেন না তিনি!
প্রশ্ন করি, ক্রিকেট নিয়ে এই রকম আগ্রহ? হেসে বলেন, “এখন আর অত দেখি না। দেয়ার ইজ টু মাচ অব ক্রিকেট। তা ছাড়া এখন আর অত বর্ণময় ক্রিকেটারই বা কই?”
এ নিয়ে প্রশ্ন করার আগেই তিনি চলে যান মুস্তাক আলির গল্পে। বলেন, “কী অ্যাগ্রেসিভ ক্রিকেটার ছিলেন উনি। নাইনটি পারসেন্ট শিওর যে স্যার ফ্রাঙ্ক ওরেল রিটায়ার করার পরে উনি বলেছিলেন, ‘আই ক্যান ওয়াক আ হানড্রেড মাইলস টু ওয়াচ হিম প্লে!’”
স্মৃতির ঝুলি থেকে একের পর এক ক্রিকেট নিয়ে গল্প। কখনও ভিভ রিচার্ড, কখনও গ্যারি সোবার্স। “একটা কাল্পনিক তালিকা তৈরি করতে বলা হয়েছিল গ্যারি সোবার্সকে। বিশ্বের দশ জন সেরা ব্যাটসম্যানকে নিয়ে। যাঁদের বিপরীতে তিনি বল করতে চান। সোবার্স তালিকার শেষ থেকে শুরু করে ছিলেন বলতে। সেখানে প্রথম নামটা ছিল ভিভ রিচার্ডস-য়ের। বলেছিলেন, ‘আই ক্যান বল ইন পারফেক্ট লাইন অ্যান্ড লেংথ বাট স্টিল ওনলি প্রে দ্যাট হি মেকস আ মিসটেক!’ কী অসাধারণ একটা ব্যাখ্যা! আসল ব্যাপার হল অন্য সব দেশেই যেটা আছে সেটা আমাদের দেশে নেই। সেটা হল দ্য রেসপেক্ট ফর ট্রুথ!”
তার পর নিজের জীবন থেকে একটা অভিজ্ঞতার কথা বললেন। “এক অভিনেত্রীর (নাম বলব না) সঙ্গে আমার সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। কোনও একটা কারণে টিভি চ্যানেল থেকে ওর সম্পর্কে আমার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল। আমি বলেছিলাম। উনি সেটা টিভিতে দেখে আমাকে ফোন করে ধন্যবাদ দিয়ে বলেন, ‘ইট ইজ সো গ্রেশাস অব ইউ, পুলুদা...’ কিন্তু আমি বলি এতে গ্রেশাস হওয়ার কিছু নেই। আপনার সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক যাই হোক না কেন, অভিনয় নিয়ে তো আমি সত্যিটা বলবই!”
উত্তমকুমারের সঙ্গে দেখা করতে চাই
এ দিকে আবার শট রেডি। গোপী ভগতের ক্যামেরার সামনে স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত। এ সিনেমায় তিনি সৌমিত্রর স্ত্রী। ‘আই ওয়ান্ট টু মিট...’ প্রশ্নের উত্তরে তিনি সামান্য লজ্জা পেয়ে বলেন ‘উত্তমকুমার’! ঠিক উল্টো দিকে সৌমিত্র বসে। শুনেছেন সব কিছু।
কাট বলার সঙ্গে সঙ্গে শিবুকে আমাদের প্রশ্ন, এ সংলাপটা কি ইচ্ছে করেই ছবিতে রাখা?
শিবুর মুখে হাসি। বললেন, “এর পরের দৃশ্যটা ঘরে। সৌমিত্রদা এ নিয়েই স্বাতীদিকে প্রশ্ন করছেন। জিজ্ঞেস করছেন, ‘উত্তমকুমারকে ভাল লাগে আর সৌমিত্রকে?’”
প্রথম সংলাপটা শুনে, স্বাতীলেখাও খুব মজা পেয়েছিলেন।
বলছিলেন, “শিবুর লেখার হাত তো খুব ভাল। চিত্রনাট্যে এই দৃশ্যটা শুনে সবাই হাসছিল। আমি আবার একটু অভিনয় করে দেখিয়েছিলাম। শ্যুটিংয়ের সময় সৌমিত্রদাও হেসেছিলেন। মনে পড়ে যাচ্ছিল ‘ঘরে বাইরে’র কথা। আমার দিদি তখন বেঁচে। উনি সৌমিত্রদার খুব ফ্যান। আমি ওঁর সঙ্গে অভিনয় করছি শুনে বলেছিলেন, ‘আমি ওঁর এত ফ্যান, আর তুই ওঁর সঙ্গে অভিনয় করতে যাচ্ছিস!’
কথা বলতে বলতে সন্ধে নেমে আসে। এর পর সব শ্যুটিং বাড়ির মধ্যে। সুজয়প্রসাদ এস্রাজ বাজাচ্ছেন, পাশে ঋতুপর্ণা। শ্যুটিং শেষ হতে রাত ৮-টা। মেক আপ তুলতে তুলতে ঋতুপর্ণা বললেন, “একবার শিলাজিত্দার সঙ্গে শ্যুটিং করতে শান্তিনিকেতন এসেছিলাম। ও আমাকে একটা চপ খাইয়েছিল। নাম ছিল বোমা। দারুণ খেতে। ওটা যদি পাওয়া যেত...”। কিন্তু না, বোমার সন্ধান পাওয়া যায়নি সে রাতে। তবে তার বদলে অন্য একটা বিষয় নিয়ে ঋতুপর্ণার উত্তেজনা শুরু। পরদিন সকালে ঠিক হল সৌমিত্রর সঙ্গে তিনি যাবেন আশ্রম প্রাঙ্গণে। শ্যুটিংয়ের আগে ঘুরে দেখবেন ছাতিমতলা, উত্তরায়ণ...
মোবাইল কারে কয়
প্ল্যান ঠিক হলেও সকাল থেকে অন্য ঝামেলা। সেটে সৌমিত্রর সঙ্গে দেখা করে গুডমর্নিং বলতেই উত্তর এল, “আই ডোন্ট নো হোয়াট ইজ গুড অ্যাবাউট দ্য মর্নিং!” মুখে অশান্তির ছাপ। তার পর নিজেই বললেন মোবাইল ফোনটা হারিয়েছেন। তন্নতন্ন করে খুঁজেও সেটা পাওয়া যায়নি। খানিকটা মানসিক উত্কণ্ঠা নিয়েই গাড়িতে উঠলেন অন্য শ্যুটিং স্পটে যাওয়ার জন্য। খাদের ধারে শ্যুটিং। নীচ দিয়ে বয়ে চলেছে খোয়াই। বর্ষাকালে এখানে হাঁটুজল থাকে। কিন্তু এখন শুধু লাল মাটি। পাবদা মাছ নিয়ে অভিমানের দৃশ্য। স্বাতীলেখার সঙ্গে। কবে নাকি তিনি স্পেশাল পাবদা মাছ নিয়ে এসেছিলেন নিজে খাবেন বলে, আর ঠিক সেগুলোই স্বাতীলেখা রান্না করে কোন আত্মীয়কে খাইয়ে দিয়েছেন এ নিয়েই মান-অভিমানের দৃশ্য। সকালের কাঁচা রোদ এসে পড়ছে গায়ে। সৌমিত্র হেঁটে চলেন সোনাঝুরির জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। ততক্ষণে চারপাশ থেকে কিছু ট্যুরিস্ট তাঁকে শ্যুটিং করতে দেখে মোবাইল ক্যামেরা বের করে ছবি তুলতে শুরু করে দিয়েছে। তা দেখে সৌমিত্র হেসে বলেন, “বলো তো মোবাইল ফোন কারে কয়? এই শতাব্দীতে ক্যামেরা নিয়ে যে বিপ্লব হচ্ছে, তার নাম মোবাইল ফোন!”
দেশিকোত্তমটা দারুণ লেগেছিল
এই দৃশ্য শ্যুট করতে করতে প্রায় দুপুর। লাঞ্চব্রেকে ঠিক হল এ সময় আশ্রমপ্রাঙ্গণটা ঘুরে দেখে আসা হবে। কিন্তু ঋতুপর্ণা কোথায়? তিনি নাকি সকালবেলা শট দিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়েছেন। শিবুর কথা মতো ঠিক হল সৌমিত্রকে নিয়ে উনি আর নন্দিতা চলে আসবেন আশ্রমপ্রাঙ্গণে। আর অন্য দিক থেকে ঋতুপর্ণা চলে আসবেন সেখানে। কিন্তু মিনিট কুড়ি অপেক্ষা করার পরেও ঋতুপর্ণার পাত্তা নেই। কাচঘরের সামনে দাঁড়িয়ে সৌমিত্র বললেন, “বহু বার শান্তিনিকেতনে এসেছি। শ্যুটিংয়ের জন্য। বা বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে। তবে এ নাগাদ আর আশ্রমপ্রাঙ্গণে আসা হয়নি। প্রায় বছর চারেক পর এলাম এখানে।” স্মৃতিচারণ করতে করতে এগিয়ে গেলেন বকুলবীথির দিকে। ততক্ষণে এসে পৌঁছেছেন ঋতুপর্ণাও। কৌতূহলবশত জিজ্ঞেস করলেন, “এই আশ্রমপ্রাঙ্গণকে কেন্দ্র করে তো আপনার অনেক স্মৃতি রয়েছে, তাই না?” চোখ চকচক করে ওঠে সৌমিত্রর। বলেন, “জীবনে অনেক সম্মান পেয়েছি। বোধহয় ৬-৭টা ডি.লিট রয়েছে। তবে দেশিকোত্তম পাওয়াটা আজও আমার কাছে খুব স্মরণীয় একটা ঘটনা। খুব ভাল লেগেছিল পেয়ে...”
হাতে সময় থাকলে আরও কিছুক্ষণ হয়তো ঘোরা যেত। কিন্তু আলো পড়ে যাবে। পরের শট যে রেডি!
গভীরে যাও
এ দিকে ঋতুপর্ণার সঙ্গে শিবপ্রসাদের একটু মান-অভিমান শুরু হয়েছে। হাসতে হাসতে ঋতুপর্ণা বললেন, “শিবু বোধহয় ভাবছে শান্তিনিকেতনে এসে এই বুঝি ঋতু কোনও ইভেন্টে চলে যাবে। কেউ হয়তো বলল নক্শিকাঁথার প্রদর্শনীটা উদ্বোধন করে দিন। অমনি ঋতুর মনটা গলে যাবে আর ও শ্যুটিং ছেড়ে ওখানেই চলে যাবে। শিবু ভয় পেয়ে তাই বলছে সারাক্ষণ নাকি আমাকে সেট-য়ে দরকার।”
আপনি কি বলছেন পরিচালক চোখে হারাচ্ছেন আপনাকে? “সিন না থাকলেও বলছে এই তো নতুন একটা দৃশ্য অ্যাড করলাম। ওর ভয় আমাকে নিয়ে। ভাবছে একবার যদি ঋতু বেরিয়ে যায়, তা হলে হয়তো সব শিডিউল হ্যাম্পার হয়ে যাবে! কিন্তু আমিও কম যাই না। শিবু ঠিক যেটা করতে চাইবে না, আমি সেটাই করব। অবশ্য শ্যুটিংয়ের ক্ষতি না করে। চলুন তো একটু খাদটায় ঘুরে আসি!” বলে এক লাফে গাড়ি থেকে নেমে পড়লেন। তার পর এবড়োখেবড়ো নুড়িপাথরের রাস্তা দিয়ে সোজা নেমে গেলেন খোয়াইয়ের ধারে। অন্তত ২৫ ফুট নীচে। পরনে জাফরানি রঙের সালোয়ার কামিজ, মিশে গিয়েছে লাল মাটির সঙ্গে।
এই শ্যুটিং করতে আসার আগেই শিরোনামে এসেছে যে পরপর বেশ কিছু সেলিব্রিটি সিলভার সেপারেশনের পথ বেছে নিচ্ছেন। অর্থাত্ বয়সকালে এসে ডিভোর্স। সেটাই তো আবার ‘বেলাশেষে’র থিম। “হ্যাঁ, পরিচালক প্রিয়দর্শনের বিয়ে ভাঙার খবরটা পড়লাম। ওঁর সঙ্গে তো আমি কাজ করেছি। ২৪ বছর পর ওঁদের ডিভোর্স হল,” বললেন ঋতুপর্ণা। আরও বলেন, “দিজ ইজ আওয়ার ফিফটিনথ্ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি। একদিনের জন্য ব্যাঙ্কক যাব বরের সঙ্গে সময় কাটাতে।”
কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটার দিকে খেয়াল ছিল না। শিবুর ফোন আসায় সম্বিত্ ফিরল।
শনিবারের হাট
পরের দৃশ্যের শ্যুটিং হবে একটা হাটে। শুধুমাত্র ছবির জন্যই যেটা বসেছে। নাগরদোলা থেকে বেতের টুল, আমপানা থেকে পাটিসাপটা, কাঁথাস্টিচের র্যাপ অ্যারাউন্ড থেকে টেরাকোটার গয়না কী নেই সেখানে? সঙ্গে বাউল গান আর পাশের গ্রাম থেকে আসা সাঁওতাল ছেলে-মেয়েদের নাচ। শ্যুটিংয়ের ফাঁকে-ফাঁকে কেনাকাটাও চলল প্রচুর। দরদাম করায় সব থেকে পটু ইন্দ্রাণী দত্ত। শ্যুটিং সেরে সন্ধে নামার আগে হাতে দু’টো কায়দা করা লন্ঠন ঝুলিয়ে হাসতে হাসতে এগিয়ে এসে বললেন, “কেনাকাটিও করলাম বেশ। আমি ভাল দরদাম করতে পারি। কাঁথাস্টিচের কাজ করা জিনিস বেশ ভাল বার্গেন করে কিনলাম!”
রাতে যখন ঠান্ডা জাঁকিয়ে পড়বে বলে ভয় দেখাচ্ছে তখন ইন্দ্রাণীর সঙ্গে আবার দেখা। এ বার শ্যুটিং নয়। নির্ভেজাল আড্ডা। উপলক্ষ সুজয়ের জন্মদিন। বারবার এসে সুজয় অনুরোধ করলেন কেকের ক্রিম যেন কেউ তাঁর গালে লাগিয়ে না দেন। যদিও কে ওই সাঙ্ঘাতিক কাজটা করবেন বলে ভয় দেখাচ্ছিলেন সেটা জানা যায়নি। খোলা ছাদে পার্টি। মিঠুন চক্রবর্তী আর ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘নকশাল’ ছবিতে অভিনয় করার অভিজ্ঞতা থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবেশ সে সব নিয়ে মজাদার অভিজ্ঞতার ঝাঁপি খুলে বসেন শঙ্কর। পার্টিতে নতুন অতিথি ঋতু-র পুত্র অঙ্কন। সে রাতের আন-অফিশিয়াল ডিজে। নিজের ওয়াকম্যান থেকে গান চালিয়ে স্পিকার শোনানোর দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। আর সে গানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আনন্দে মাতলেন ঋতুপর্ণা, শিবু, নন্দিতা, ইন্দ্রাণী, অনিন্দ্য আর মনামি-রা।
মানিকদার সেই অভিযান
পার্টি রাত ১টা অবধি গড়িয়ে চললেও পরের দিন সেই সকাল ৮টাতেই কল টাইম। সুখবর হল সৌমিত্রর মোবাইলের হদিস মিলেছে। ব্রেকফাস্ট করতে করতে মোবাইল খুঁজে পাওয়ার গল্প বললেন। আরও কত কথা। “এ বছরে বেশ কয়েকটা ভাল কাজ হয়েছে। এই ছবিটা হল। ‘দ্য ব্রিজ’ বলে একটা ছবি করলাম। তার পর ‘সেলফি’। এর পর সুজয় ঘোষের পরিচালনায় একটা শর্ট ফিল্মে অভিনয় করব...”
শারীরিক অসুস্থতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কী করে সামলান এত কিছু? এই রোববার তো ক্যান্সার সচেতনতা অনুষ্ঠানে ‘কালমৃগয়া’ নাটকে অভিনয় করবেন তিনি। নাটক, লেখালিখি, শ্যুটিং সব একসঙ্গে চালিয়ে যান কী করে? “২০০৮য়ে প্রস্টেট ক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রথম যখন খবরটা পাই শকটা দুম করে এসে লেগেছিল। তবে এখন আমার ডাক্তার বন্ধুদের কাছে শুনি যে ক্যান্সারের মধ্যে প্রস্টেট ক্যান্সারের আক্রমণ করার ক্ষমতা সবথেকে কম। এখনও শ্যুটিং করে যাচ্ছি। তবে দিনে পাঁচ ঘণ্টার বেশি নয়। যাতে এনার্জিটা ফুরিয়ে না যায়...”
ততক্ষণে ঋতুপর্ণা এসে অনুরোধ করেন সামনের জঙ্গলে হেঁটে গেলে কেমন হয়। রাজি হন সৌমিত্র।
এগিয়ে যান। গুনগুন করে গানও ধরেন বোধহয়...
কথার ভিড়ে উঠে আসে রবীন্দ্রনাথ-গাঁধী প্রসঙ্গ। এত বার যে শ্যুটিং করেছেন শান্তিনিকেতনে, কখনও সত্যজিত্ রায়কে নিয়ে এসেছেন আশ্রম প্রাঙ্গণে? “এসেছিলাম ‘অভিযান’য়ের শ্যুটিংয়ের সময়। মানিকদা ছিলেন।” ‘অভিযান’ মানে ওয়াহিদা রহমানের সঙ্গে সেই ছবি। যেখানে সৌমিত্র এক ড্রাইভারের ভূমিকায়। যা দেখে পরবর্তী কালে মার্টিন স্করসেসে নাকি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তার পর বানিয়েছিলেন ‘ট্যাক্সি ড্রাইভার’! “তারাশঙ্করের লেখা গল্প। আনফরগেটেবল। ওটা আমার একটা মেমোরেবল কাজ। অভিনেতা হিসেবে ওই ছবিতে আমি নিজেকে অনেক ডেভেলপ করেছিলাম,” বলেন সৌমিত্র।
পাশ থেকে অঙ্কন জিজ্ঞেস করে, “আমি একটা প্রশ্ন করতে পারি? বলো তো হোয়ার ওয়াজ রবীন্দ্রনাথ টেগোর বর্ন?”
হেসে উত্তর দেন সৌমিত্র, “কলকাতা। হি ওয়াজ বর্ন দেয়ার। হি ডায়েড দেয়ার টু।”
সব শেষে মনে হল কেমন হয় যদি ‘বেলাশেষে’র ‘আই ওয়ান্ট টু...’ ক্যুইজটা ব্যক্তি সৌমিত্রকেও করা হয়?
উনি রাজি।
প্রথম প্রশ্ন। কার সঙ্গে দেখা করতে চান?
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অনেকেই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। আপনি কী হতে চান?
আমি সে অর্থে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় হতে চাই না। তবে আমি তাকিয়ে থাকি এমন একটা দিনের দিকে যে দিন আমার পূর্ণ মনুষ্যত্বের বিকাশ হবে।
কোথায় যেতে চান?
আমার দেশের ভেতর এমন কোনও জায়গা যেখানে দেশ সম্বন্ধে মোহমুক্ত দৃষ্টি পাব।
এই আশি বছরের দোরগোড়ায় এসে জীবনে আর কী চান?
খুব কাছের জনআমার ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী, নাতি, নাতনিএই পাঁচজনকে সুখী দেখতে চাই। নিজের জন্য আলাদা করে কিছু চাই না। ওরা ভাল থাকলেই আমার ভাল থাকা।
ঋতু-আলাপ
• জীবনে কী চান?
আমার বাবাকে ফিরে পেতে চাই।
• কী হতে চান?
হতে চাই মেরিল স্ট্রিপের মতো অভিনেত্রী। অথবা ওপরা উইনফ্রে কিংবা হিলারি ক্লিন্টনের মতো নারী, যাঁরা সমাজে কত ভাবে নিজেদের প্রভাব ফেলছেন।
• কার সঙ্গে দেখা করতে চান?
নেতাজি এবং হিউ গ্রান্ট!
• ২০১৪-র কোন ভারতীয় রাজনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করতে চান?
নরেন্দ্র মোদী না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তো অনেকবার দেখা হয়েছে।
• তা হলে বলুন নরেন্দ্র মোদী না রাহুল গাঁধী?
মোদীজি আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী। ওঁকে আমি নিশ্চয়ই মিট করতে চাইব। তবে রাহুল গাঁধীকেও মিট করতে চাই। সেটা ওঁর পিছনের হিস্ট্রির জন্য।
• আর নিজের ভবিষ্যতের জন্য?
আমি আনপ্রেডিক্টেবল। দেখি (হাসি)।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।