আমরা অপদস্থ।
অপমানিতও।
তাই আমরা অ্যাকাডেমি ছেড়ে দিচ্ছি।
কথাগুলো সমস্বরে বললেন কৌশিক সেন, সুমন মুখোপাধ্যায়, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়।
ত্রয়ী: জ্ঞানমঞ্চে কৌশিক সেন, বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমন মুখোপাধ্যায়। ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল।
শুক্রবার দুপুরে জ্ঞানমঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে। কেন অ্যাকাডেমি-মুখো হবেন না বলছেন এই তিন নাট্যকর্মী?
শুধুই অভিমান? সস্তার প্রচার? চমক? পাবলিসিটি গিমিক? নাকি অ্যাকাডেমিতে এ বছর আর শো না করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা বিদ্রোহ ঘোষণারই প্রতিফলন ।
৭ অগস্ট অ্যাকাডেমিতে শেষ বার নাটক করেছিলেন কৌশিক, সুমন। সেদিনই শো-য়ের মাঝখানে আগুন লাগে মঞ্চে।
কৌশিক-সুমন-বিপ্লবের দাবি যে অ্যাকাডেমিতে আগুন লাগার একদিন বাদে প্রকাশ ভট্টাচার্য এবং তপনজ্যোতি দাশ একটা মিটিং ডাকেন।
আর সেখান থেকেই শুরু হয় নাটকের নতুন এক অধ্যায়।
কী হল সেই মিটিংয়ের?
উদ্দেশ্য নাকি ছিল সবাই মিলে বসে অ্যাকাডেমির কল্যাণ ও উন্নয়ন নিয়ে কথা বলা।
কৌশিক: ওদের বক্তব্য হল আগুন লাগার ঘটনাটা সবার চোখ খুলে দিয়েছিল। তাই অ্যাকাডেমির ভালর জন্য ওরা একটা মিটিং ডাকতে চেয়েছিল। যেদিন সেই মিটিং ডাকা হয়, সেদিন সকালবেলা আমরা জানতে পারলাম যে বিভাস চক্রবর্তীরা নাটক করছেন অ্যাকাডেমিতে। সেটা আমাদের বেশ আশ্চর্য লাগে। কারণ একদিনের মধ্যে কোনও নিরাপত্তা ব্যবস্থা না নিয়ে কী ভাবে সেখানে আবার নাটক করা হচ্ছে তা ভেবে পাই না! তবু আমরা মিটিংয়ে যাই। মিটিংয়ের সভাপতি ছিলেন বিভাসবাবু। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রকাশ ভট্টাচার্য, মণীশ মিত্র, তপনজ্যোতি দাশ, অনীশ ঘোষ, সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, অরুণ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনেক নাট্যকর্মী সেখানে ছিলেন। আবার অনেকে ছিলেনও না।
বিভাস চক্রবর্তী কেন সেদিন নাটক করলেন?
মিটিংয়ে নানা কথার মধ্যে এই প্রশ্নটাও ওঠে যে বিভাস চক্রবর্তী কোনও নিরাপত্তার বন্দোবস্ত না নিয়ে কেন শো-টা সেদিন করেছিলেন?
বিপ্লব: অ্যাকাডেমি স্টাফদের একটা নিজস্ব যুক্তি ছিল। ওঁরা চেয়েছিলেন বিভাসদা শো-টা করুন। যদি আগুন লাগাটাকে একটা দুর্ঘটনা হিসেবে দেখা হয়, সেখানে স্টাফদের ভূমিকা খুব পজিটিভ। তবু প্রশ্ন ওঠে অ্যাকাডেমির যে চারটে প্রবেশ-দ্বার আছে, সেখানে তিনটে সেদিন কেন লক করা ছিল? ওঁরা তখন ক্ষমা চান। কৌশিক প্রশ্ন করে শুধু দরজাগুলো খুলে দিলেই কি অ্যাকাডেমি নিরাপদ হয়ে যাবে? তখন প্রশ্ন উঠল প্রশাসন ব্যবস্থা নিয়ে। দীর্ঘদিন ধরে যে অচলাবস্থা চলছে, ট্রাস্টি নেই, এক্সিকিউটিভ কমিটি নেই সব নিয়ে কথা হয়। কিন্তু এর মধ্যেও স্টাফদের কথা শুনে মনে হয় তাঁরা দলমতের উর্ধ্বে উঠে কিছু করতে চাইছেন।
ওঁরা কারা?
কথা চালাচালির মধ্যে একটা আশ্চর্য ঘটনা হয় সেদিন। মিটিংয়ে উপস্থিত দুই ব্যক্তিকে কৌশিকের চোখে পড়ে। প্রথমে মনে হয়েছিল তাঁরা নাট্যকর্মী। তার পর ভাবা হয়েছিল ওঁরা বোধহয় অ্যাকাডেমির স্টাফ।
কৌশিক: পরে বুঝতে পারি ওঁরা স্পেশাল ব্রাঞ্চের লোক। ওঁদের একজনের মুখটা চেনা লাগে। কারণ আমি যখন নন্দীগ্রাম আর কামদুনিতে গিয়েছিলাম, তখন উনি এসে কী সব নোটডাউন করতেন। তাই মুখটা চেনা লেগেছিল। রবীন্দ্রসদনে আমার শো থাকলে উনি গিয়ে দেখতেন আমার কোন শো হচ্ছে। আমি প্রশ্ন করি উনি এই মিটিংয়ে কী করছেন। ওঁরা পরিচয় দেওয়ার পর সবাই তখন বলেন, এই মিটিংয়ে ওঁদের থাকার কথা নয়। ওঁদের চলে যেতে হয়। কিন্তু মিটিং শেষে দেখলাম যে ওঁরা গিয়ে অ্যাকাডেমির একটা কাউন্টারে বসেছেন। ওটা এখন তৃণমূল নিয়ে নিয়েছে। মিটিং শেষে দেখলাম কেউ কেউ মিটিংয়ের সব ডিটেলস ওঁদের জানিয়ে আসছে!
নতুন কমিটি
মিটিং শেষে একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একটা অস্থায়ী কমিটি তৈরি হবে অ্যাকাডেমির উন্নয়নের জন্য। তাতে শুধু নাট্যকর্মীই নয়, চিত্রশিল্পী, ভাস্কর সবাই থাকবেন। কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে থাকবেন প্রকাশ ভট্টাচার্য আর তপনজ্যোতি দাশ।
সুমন: সেদিন সন্ধেবেলায় প্রকাশ ভট্টাচার্য আমাকে মেসেজ করেছিলেন যে অর্পিতা ব্যাপারটা জানতে পেরেছে, আর ও বলেছে আমরা এটা নিয়ে পলিটিক্স করেছি। ঘটনাটা কৌশিককে জানাই। তার পর যৌথ ভাবে অর্পিতাকে একটা মেসেজ করি। আমাদের শো-এর দিনে অ্যাকাডেমিতে আগুন লাগে। তাই আমরা এই কমিটিতে আছি। যাতে আমরা আমাদের অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে পারি। সঙ্গে এটাও বলি যে ও এই কমিটির সদস্য হতে পারে। অন্যান্য সদস্যদের নির্বাচনও করতে পারে। শিল্পের স্বার্থে আমরা ভেদাভেদ ভুলে যেন সবাই এগিয়ে আসি। কিন্তু আমাদের এসএমএস-এর কোনও জবাব মেলে না।
কৌশিক অপমান করেছে!
এর পর শুরু হয় আরও নাটকীয় ঘটনা। সুমন, কৌশিক আর বিপ্লবের দাবি, পরের দিন ‘অন্য থিয়েটার’ থেকে অ্যাকাডেমি কর্তৃপক্ষ, স্টাফ আর ইউনিয়ন মেম্বারদের চিঠি পাঠিয়ে জানানো হয়, কৌশিক নাকি বিভাস চক্রবর্তীকে সেই মিটিংয়ে অপমান করেছেন!
কৌশিক: আমি নাকি অফেন্সিভ প্রশ্ন করেছি বিভাসবাবুকে। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, সেই মিটিংয়ে কেউ এই অভিযোগ করেনি। বিভাসবাবু নিজে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দলের সেক্রেটারি উপস্থিত। যে নাটকটা (‘নিজের খোঁজে’) অ্যাকাডেমিতে সেদিন মঞ্চস্থ হয়েছিল, তার পরিচালক সনত্ চন্দ্র মিটিংয়ে ছিলেন। মিটিং শেষে উনি আমার হাত ধরে বলেছিলেন ইতিমধ্যে নাটকের সাত-আটটা শো হয়ে গিয়েছে। জানতে চেয়েছিলেন আমি কবে দেখব! আমার প্রশ্ন, যদি আমি বিভাসবাবুকে এত অপমান করে থাকি, তা হলে কেন সনত্বাবু আমাকে তাঁর নাটক দেখার অনুরোধ করেছিলেন?
ইস্তাহার দিলাম
দু’দিন বাদে জানা গেল একটা লিফলেটের কথা যেটা দিয়ে দুটো হোর্ডিংও করা হয়েছিল। একটা রাখা হয়েছিল অ্যাকাডেমির সামনে। অন্যটা রবীন্দ্রসদনের সামনে। অন্যান্য কথার সঙ্গে লিফলেটে এটাও বলা হয়, ‘এই অগ্নিকাণ্ড যেমন আমাদের এই প্রেক্ষাগৃহের পরিকাঠামো, অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, ইত্যাদি বিষয়ে নতুন করে ভাবাচ্ছে, সেই রকমই আমাদের বিচলিত করছে এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে কিছু মানুষের দোষারোপ এবং অপব্যাখ্যা করার প্রবণতা। এই প্রবণতা হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত তা ভেবে নেওয়ার অবকাশ থাকছে সাধারণ মানুষের। এই ধরনের দুর্ঘটনাকে তার যথাযথ তাত্পর্যে বিশ্লেষণ না করে, ভবিষ্যত্ কালের দর্শক ও নাট্যশিল্পীদের স্বাচ্ছন্দ্য ও সুরক্ষার কথা না ভেবে, এই রকম একটা ঘটনা থেকেও আত্মপ্রচারের অভিসন্ধিতে এই ঘটনার পেছনে চক্রান্ত খুঁজে আসলে তারা এই সুস্থ নাট্যচর্চার পরিবেশকে গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। আসুন আমরা মিলিত হই, আলোচনা করি, পরামর্শ করি, কী করে হীন ব্যক্তিস্বার্থের উর্ধ্বে দাঁড়িয়ে নাট্যচর্চার পীঠস্থানকে আগুনের হাত থেকে আর আগুন জ্বালানোর হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারি।’ লিফলেটে সই করেছিলেন রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, মনোজ মিত্র, বিভাস চক্রবর্তী, দেবেশ চট্টোপাধ্যায়, মণীশ মিত্র, অনীশ ঘোষ, শেখর সমাদ্দার, বিজয় মুখোপাধ্যায়, সোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, অনির্বাণ ভট্টাচার্য, সৌমিত্র মিত্র, প্রকাশ ভট্টাচার্য, তপনজ্যোতি দাশ ও আরও অনেকে।
অ্যাকাডেমির সামনে সেই ইস্তাহার...
সুমন: ইস্তাহারটা পড়ে আমি প্রকাশকে ফোন করে জিজ্ঞেস করলাম কেন এমন লেখা হয়েছিল। উনি বলেন: ‘আমি জানি না। আমাকে বলা হয়েছিল অ্যাকাডেমির ভালর জন্য একটা ইস্তাহার বিলি করতে চাই। তাতে তোমার নামটা দিচ্ছি।’ আমি বলেছিলাম, ‘তুমি পঞ্চাশোর্ধ্ব। ইস্তাহারে সই আছে অনীশের। তুমি জানো অনীশ ‘নাট্যস্বজন’-এর সঙ্গে যুক্ত। ও একটা বয়ান লিখছে। তাতে কী আছে তা না জেনে কি সই দেওয়া যায়?’ দ্বিতীয় ফোনটা আমি করলাম রুদ্রবাবুকে। বলেছিলাম: ‘প্রথম নামটা আপনার দেখলাম। বাকিদের না-হয় অ্যালাইনমেন্ট রয়েছে। কিন্তু আপনি তো দাবি করেন আপনি এই সবের উর্ধ্বে। তা হলে আপনি কী ভাবে এই রকম একটা ইস্তাহারে সই করলেন?’ রুদ্রবাবুর যথারীতি পিছলে যাওয়া উত্তর। ইলাসট্রেটিভ উত্তর। আমি বললাম লেটস টক স্ট্রেট। উনি বললেন: ‘জেনে ফোন করছি।’ জানার পরেও ঘোলাটে উত্তর দিলেন। একবার বললেন: ‘আমাকে যা বলা হয়েছিল তা ঠিকমতো ছাপা হয়নি।’ তার পর বললেন কিছু লোকের মনে প্রশ্ন জেগেছে আগুন আমাদের জন্য লেগেছে। দুটো দিক বজায় রেখে কথা বললেন উনি। এমনটাও বললেন, আমাদের কাজের খুব ভক্ত একজন ওঁকে বলেছে শোয়ের সময় আমাদের আরও দায়িত্ববান থাকা উচিত ছিল। আমি বললাম আমরা তো দায় এড়িয়ে যাইনি। আগেই বলেছিলাম আমরা ফায়ার এসকেপের ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিইনি। কর্তৃপক্ষরও কিছু দায়িত্ব ছিল। আমি সেই ডায়লগটা শুরু করতে চেয়েছিলাম যেখান থেকে ত্রুটিগুলো বোঝা যেত। জাতপাত ভুলে সেই ডায়লগটাই শুরু করতে চেয়েছিলাম।
একটানা শো করা যাবে না
ইস্তাহার বিলি সংক্রান্ত ঘোলাটে উত্তরে ধাক্কা লেগেছিল ঠিকই। তবে শেষ পেরেকটা পোঁতা হয় ডেট নিয়ে।
কৌশিক: ২ সেপ্টেম্বর আমরা একটা গোটা দিন শো করতে চেয়েছিলাম। ঠিক যে ভাবে ‘রাষ্ট্রের কোনও ছবি নেই’ করেছিলাম, সে রকম একটা ফেজ-২ করতে চেয়েছিলাম। তিনটে নাটক করার ইচ্ছে ছিল। ‘যারা আগুন লাগায়’, ‘ক্যালিগুলা’ আর ‘সমুদ্রের মৌন’ (যাতে কবীর সুমন অভিনয় করবেন)। বলা হল তা করা যাবে না। কারণ মেন্টেনেন্স চলছে। অ্যাকাডেমির বুকিং ক্লার্ক আমাদের বলেন ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলবে। যেহেতু ৮ সেপ্টেম্বর আমার একটা ডেট নেওয়া ছিল, আমি তখন সেদিন ওটা করতে চাইলাম। বুকিং ক্লার্ক রাজি হলেন। শুধু বললেন আমাকে একটা লিখিত দরখাস্ত দিতে। আর ঠিক হল ২ সেপ্টেম্বর সন্ধের শো-টা সুমন আর আমি ভাগ করে অভিনয় করব। তার জন্য সুমনকে একটা লিখিত দরখাস্ত দিতে বলা হল। পরের দিন (১৩ অগস্ট) গিয়ে আমার লিখিত দরখাস্ত দিয়ে এলাম। কিন্তু ১৯ অগস্ট আমাদের দলের ছেলেদের বলা হল ২ সেপ্টেম্বর সন্ধেয় সুমন আর আমি দু’জনে শো করতে পারবে না। আলাদা আলাদা শো করা যাবে। ভাগ করে শো করা যাবে না। কারণ জিজ্ঞেস করাতে কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না।
সুমন: কিন্তু এ রকম শো-তো আমরা আগেও করেছি। কোনও দিন এ রকম নিয়মের কথা শুনিনি। ১২-১৩টা এ রকম শো আমি করেছি। নিয়ম যদি থাকে, কোনও দিন তা আমাদের জানানোই হয়নি।
চূড়ান্ত অপমান করা হল
দলের ছেলেদের সঙ্গে এ রকম ব্যবহারের পর কৌশিকের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের কথা হয়। এবং সে কথোপকথন যে মোটেও সুবিধেজনক হয়নি, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বিপ্লব: অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ অফিসার তো চলেই গেলেন।
কৌশিক: টেলিফোনে আমি লোকটির সঙ্গে কথা বললাম। আমার সঙ্গে অসম্ভব খারাপ ভাবে কথা বলা হল। বলা হল: ‘এত কৈফিয়ত দিতে পারব না।’ আমি বললাম যে শো করতে চেয়ে আমরা লিখিত একটা দরখাস্ত দিয়েছিলাম। সেটা যে করা যাবে না তার উত্তরটাও লিখিত ভাবে দেওয়া উচিত। কিন্তু তাতেও এঁরা রাজি নন। ওঁদের ব্যবহার দেখে বুঝলাম এখানে অন্য কোনও অ্যাজেন্ডা রয়েছে।
সরকারি মঞ্চের বাইরে
তার পর শুরু হল অল্টারনেটিভ স্পেস খোঁজার চেষ্টা। ঠিক হল এ বার থেকে সুমন, কৌশিক আর বিপ্লব শো করবে জ্ঞানমঞ্চে। কিন্তু অ্যাকাডেমিতে ২ সেপ্টেম্বর তা হলে কোন নাটক হবে?
সুমন: ওই দিনের শো-টা আমি করছি। এখন ক্যান্সেল করা ডিফিকাল্ট।
কৌশিক: আমি ৮ সেপ্টেম্বর ডেটটা ছেড়ে দিয়েছি।
বিপ্লব: আমি ৬ সেপ্টেম্বর ডেট ছেড়ে দিয়েছি। শুধু অ্যাকাডেমি নয়। কোনও সরকারি হলে আমরা শো করছি না।
কৌশিক: শুধু মধুসূদন মঞ্চতে ১২ সেপ্টেম্বর একটা শো করছি। ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’য়ের। ওটার ডেট নেওয়া আছে বলে আমরা সেটাকে অনার করছি।
বিপ্লব: জ্ঞানমঞ্চে শো-য়ের ডেট ঠিক হয়ে গিয়েছে। ৯ সেপ্টেম্বর সুমন করছে ‘যারা আগুন লাগায়’। ১০ সেপ্টেম্বর কৌশিকরা করছে ‘ম্যাকবেথ’। ১১ তারিখ আমরা করছি ‘ক্যালিগুলা’।
সুমন কেন নাট্যস্বজন-এর প্রোগ্রামে?
এত বিতর্কের মধ্যেও তো সুমনকে দেখা গিয়েছিল নাট্যস্বজন-এর অনুষ্ঠানে। কই কৌশিক বা বিপ্লব তো সেটা করেনি? থিয়েটারের একাংশ তো দাবি করছেন সুমন এক দিকে বিরোধিতা করেন আবার অন্য দিকে নাট্যস্বজন-এর অনুষ্ঠানেও যান।
সুমন: ব্রাত্য আমার পেছনে পড়েছিল ওদের সেমিনারে যেতে। তাই গিয়েছিলাম। আমি জানতাম ভুল সিগনালটা পাঠানোর চেষ্টা হবে যে আমি নাট্যস্বজন-এ জয়েন করেছি। যদিও সেমিনারের আগেই অর্পিতা বলে দিয়েছিল যে আমি স্বজনে নেই। তবে এটাও জানি যে প্রচ্ছন্ন একটা প্রক্রিয়া কাজ করছে এটা বোঝানোর জন্য যে আমি নাট্যস্বজন-এর সঙ্গে রয়েছি। মনে হয় যে কয়েক মাসের মধ্যে ব্যাপারটা ক্ল্যারিফাই হয়ে যাবে। ইতিমধ্যে আমরা চেষ্টা করছি যে আমাদের কারও শো থাকলে সেটার পরে ওখানে যেতে। এতে একটা সিগনাল যাচ্ছে মানুষের কাছে।
বিপ্লব: আমরা বোঝাতে চাইছি আমাদের একটা প্ল্যাটফর্ম রয়েছে। এ কোনও যুদ্ধ ঘোষণা নয়। তবে এটাও ঠিক যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন নাটকের দল আমার সঙ্গে আছে।
নামে কী আসে যায়
নাট্যস্বজন-য়ে তাঁরা নাম লেখাননি। সরকারি কোনও মঞ্চে তাঁরা নাটক করবেন না এ বছর। নতুন এই প্ল্যাটফর্মের নাম কী হবে?
সুমন: নাম দেব না। সমমনস্ক কিছু মানুষ একসঙ্গে এসেছি। আমরা খুব অপমানিত, অপদস্থ হয়েছি।
কৌশিক: মনে হল একটা বিকল্প জায়গা দরকার। তৃতীয় সূত্র, স্বপ্নসন্ধানী আর প্রাচ্য আমরা তিনটে দল নাট্যচর্চাটা শুরু করেছি। সেটা পরীক্ষামূলক জায়গায়। অ্যাকাডেমিতে একটা নাটক পাঁচটায় শুরু হলে পরের শো সাড়ে ছ’টায়। এতে সাঙ্ঘাতিক প্রেশার তৈরি হয়। কেন এমন করে নাটক করব আমরা? এই স্পেসটাকে যদি এই ভাবে জনপ্রিয় করা যায়, তা হলে আমাদের কোনও নাটক ভাল লাগলে আমরা সেই দলকে ইনভাইট করতে পারি জ্ঞানমঞ্চে।
সুমন: বহরমপুরের একটা দল খবর পেয়ে আমাদের বলেছে, যে তারিখে আমরা নাটক করতে পারছি না সে তারিখে ওরা নাটক করতে পারে কি না? অলরেডি একটা মেসেজ চলে যাচ্ছে।
এটা কি নাট্যস্বজন-এর বিকল্প
অ্যাকাডেমি বিদায়ের পরে কি একটা নাট্যস্বজন বিরোধী সেন্টিমেন্ট উস্কে দিচ্ছেন তাঁরা?
কৌশিক: আমরা সেটা পারব না। কারণ নাট্যস্বজন-এর একটা পলিটিকাল ব্যাকিং রয়েছে। পঞ্চাশ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে এক একটা দলকে। লোকসভা নির্বাচনের আগে তিনটে বাচ্চা ছেলের একটা
দল আমার কাছে এসেছিল পরামর্শ নিতে। এর আগে কোনও কাজ করেনি তারা। একদম নতুন দল কিন্তু। পঞ্চাশ হাজার টাকা গ্র্যান্ট পেয়েছিল নাট্যস্বজন থেকে। আমরা এ ভাবে টাকা ছড়াতে পারব না। আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
সুমন: আমি তো ব্রাত্যকে বলেছি যে নাট্যস্বজন অরাজনৈতিক সংগঠন হতে পারে না যেখানে ব্রাত্য নিজেই একজন তৃণমূলমন্ত্রী।
নিরপেক্ষ হওয়া যায় কি
ব্রাত্য বসুর ‘আলতাফ গোমস’ নাটকের একটা সংলাপ হল ‘নিরপেক্ষদের ক্যালাও’। এই বিদ্রোহ ঘোষণার পর কি তাঁদের নিরপেক্ষতার অবস্থানটা আরও বেশি মিসলিডিং হয়ে যাবে?
কৌশিক: এই প্রশ্নটা করে ওরা আমাদের স্ট্যান্ড-টা গুলিয়ে দিতে চায়। নন্দীগ্রামের জন্য যখন আমরা পথে নেমেছিলাম, তখন তো আমরা নিরপেক্ষ ছিলাম না। পরিবর্তনের পক্ষে ছিলাম।
বিপ্লব: কামদুনির সময় যখন ওই পরিবারের বাড়িতে গিয়েছিলাম, তখনও তো আমরা নিরপেক্ষ ছিলাম না।
কৌশিক: এখানে সবাইকে বেছে নিতে হবে তারা তৃণমূল না বিজেপি না সিপিএম। এটা কেন নিরপেক্ষতা বা পক্ষ নেওয়ার মাপকাঠি হবে? অসংখ্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে আমাদের কথা হয়। তাঁদের তো আমাদের এই অবস্থানটা বুঝতে অসুবিধে হয় না। তা হলে ওঁদের এত সমস্যা কেন হয়? কারণ ওঁরা প্রমাণ করতে চায় যে কৌশিক সেন সিপিএম।
বিরোধিতা নয়, কাজ করতে চাই
বিভাজন হয়েছে সেটা অস্বীকার করছেন না তাঁরা। কিন্তু নাট্যস্বজন-এর বিরোধী তকমাটা যদি গায়ে লাগে?
বিপ্লব: ভাল থিয়েটার করা ছাড়া কোনও অ্যাজেন্ডা নেই আমাদের।
কৌশিক: জ্ঞানমঞ্চটা ভাল বিকল্প জায়গা হয়ে দাঁড়ালে যে কোনও বিশ্বাসী থিয়েটার কর্মী কাজ করতে পারবে। আতঙ্কের পরিবেশটা পাল্টানো দরকার।
ফেরার পথ
এত দিনের সখ্য এত সহজে কি ভোলা যায়? ঘরের ছেলের ঘরে ফেরার কোনও পথ কি থাকল না? আমরা-ওরা কি হয়েই গেল?
কৌশিক: হ্যাঁ, মঞ্চের আমরা-ওরাটা হয়েই গেল। থিয়েটারের একাংশ অ্যাকাডেমির স্টাফেদের বোঝাল আমরা ওদের অ্যাকিউজ করছি। তা আদৌ সত্যি নয়। আমাদের বন্ধুরা অ্যাকাডেমিতে থিয়েটার করলে দেখতে যাব। কোনও সংস্থা তাদের ফেস্টিভ্যাল অ্যাকাডেমিতে করলে যদি ইনভাইট করে, তা হলে যাব। কিন্তু নিজে থেকে ওখানে এ বছর শো করব না।