মির্জ়াপুর টু
সুষ্ঠু ভাবে পরিচালনার জন্য যে কোনও সিস্টেমের উপরে নজরদারি প্রয়োজন। তবে নজরদারির নামে বা আড়ালে যখন ক্ষমতার শক্ত হাত নিষেধের জালে বেঁধে ফেলতে চায়, তখন নাভিশ্বাস ওঠে শিল্পশৈলীর। কেন্দ্রীয় সরকার সম্প্রতি জানিয়েছে যে, ওয়েব সিরিজ়-ছবির উপরে নজর থাকবে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের। এর পর থেকেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন, ওয়েব কনটেন্টের উপরে সেন্সরের কাঁচি কতটা চলবে?
অতিমারি-পীড়িত দর্শকের বৃহত্তর অংশের বিনোদন ছিল ওটিটি-নির্ভর। যার জেরে উল্লেখযোগ্য হারে ব্যবসা বাড়িয়েছে নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়ন প্রাইম, হটস্টারের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি। দৌড়ে পিছিয়ে নেই দেশজ পোর্টালগুলিও। টেলিভিশনের প্রভাবমুক্ত হয়ে কনটেন্টের জোরে স্বকীয়তা তৈরি করেছে তারা। সেন্সরের কাঁচি না থাকায় সুযোগ পেয়েছে অবাধ যৌনতা ও হিংসা প্রদর্শনের। বিতর্কিত রাজনৈতিক বিষয়গুলিও ফুটে উঠেছে পর্দায়। সরকারি নির্দেশনামা না আসা অবধি দোলাচল সব স্তরেই। তবে টলিউডের কারও মনে আশঙ্কার মেঘ, কেউ বা এই সিদ্ধান্তে খুশি।
‘‘টেলিভিশন বা বড় পর্দায় দেখানোর জন্য যদি এত বিধিনিষেধ, ওটিটিতে থাকবে না কেন?’’ প্রশ্ন প্রযোজক অতনু রায়চৌধুরীর। ‘লালবাজার’ ক্রাইম-সিরিজ়ের পরিচালক সায়ন্তন ঘোষালের মতে, ‘‘ওটিটিতে সেন্সরশিপ চাই না। কিন্তু নজরদারি না থাকায় কয়েকটি ক্ষেত্রে সুবিধেগুলোর অপব্যবহার হচ্ছে। প্রযোজক-পরিচালকদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।’’
ওয়েবের জন্য ছবি ‘সত্যমেব জয়তে’ বানিয়েছিলেন অরিন্দম শীল। ‘‘আমাদের দেশের সেন্সর বোর্ডে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সকলেই সিনেমার সমঝদার নন। সেই প্রশিক্ষণও তাঁদের দেওয়া হয় না। ফলে কোন পরিপ্রেক্ষিতে ছবিতে নগ্নতা দেখানো হচ্ছে, হিংসার উদ্রেক হচ্ছে, তার ঠিক বিচার না হলে ভাল কাজ নষ্ট হতে পারে।’’ মেনে নিলেন, স্বাধীনতার অপব্যবহার করে অনেকেই ব্যবসা বাড়িয়েছে। এই প্রসঙ্গে পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ের মত, ‘‘গণতন্ত্রের বিরুদ্ধ মতের কণ্ঠরোধ করে শুধুমাত্র ‘স্যানিটাইজ়ড’ কনটেন্ট দেখানোর জন্য এই প্রচেষ্টা কি না, গাইডলাইন না আসা অবধি সে ভয় থাকবে। যৌনতার বাড়াবাড়ির পাশাপাশি পরিণত কাজও অনেক হয়েছে, যা কখনও সম্পর্কভিত্তিক, কখনও বা রাজনৈতিক। অশ্লীলতা নিয়ন্ত্রণের নামে সেই ভাল মাপের কাজে কোপ পড়বে না তো?’’ বিরসা দাশগুপ্ত জানালেন, কী ভাবে নিয়ম কার্যকর হচ্ছে, তার ভিত্তিতে প্রতিক্রিয়া দিলে ভাল। বাংলার নামী প্রযোজনা সংস্থা ভেঙ্কটেশ ফিল্মসের ওয়েব পোর্টাল হইচই-এর বিরুদ্ধেও অকারণ যৌনতা প্রদর্শনের অভিযোগ উঠেছে। সেই প্রবণতা খানিক কমলেও, প্রযোজনা সংস্থা এখনই এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি নয়। সাহসী কনটেন্ট প্রদর্শনের জন্যই জনপ্রিয় সাইটগুলির ক্ষেত্রে সেন্সরের আলাদা মাপকাঠি থাকবে কি না, প্রশ্ন সেখানেও। এখনও অবধি নেটফ্লিক্স বা অ্যামাজ়ন বিবৃতি দেয়নি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আর্থিক সমীকরণও। আন্তর্জাতিক পোর্টালের উপরেও সরকারের রাশ কতটা শক্ত হবে, তা নিয়ে ঘুরছে প্রশ্ন।
সুরিন্দর ফিল্মসের কর্ণধার নিসপাল সিংহের মতে, ‘‘যেমন নির্দেশ আসবে, তেমনই কাজ হবে। যদি কোনও কিছু দেখাতে সরকারের আপত্তি থাকে, তা ভালর জন্যই।’’
ভারতের মতো বহুমাত্রিক দেশে সকলের জন্য এক নিয়ম খাটে না। সেন্সর ও শৈল্পিক স্বাধীনতার আপাত বিরোধ তাই প্রকট। যার জেরে পাল্টানো হয় ছবির নাম, বিতর্কিত অংশ। ভিন্ন ধারার দর্শকের জন্যই স্বতন্ত্র ওটিটি। কোপ পড়লে স্বকীয়তার ভাষা হারাবে তা-ও। চিন্তা সেখানেই।