মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।—ফাইল চিত্র।
কয়েক বছর আগের ‘সিনেমাওয়ালা’ ছবিটার শেষ দৃশ্যই এখন তাড়া করছে ছোট-বড় বহু সিনেমা হলমালিককে। করোনার ধাক্কায় বলিউড-হলিউডের রিলিজ় বন্ধ। রয়েছে হলে পাশাপাশি বসে, পারস্পরিক দূরত্ব ক্ষুণ্ণ হওয়ার আশঙ্কাও। এই পরিস্থিতি সিনেমা হল, বিশেষত সিঙ্গল স্ক্রিনগুলির কফিনে কার্যত আর একটি পেরেক হয়েই যেন ঘা মারছে। উদ্ধারের আশায় রাজ্যের সিনেমা হলগুলির তরফে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিঠি লেখা হয়েছে।
সিনেমার প্রযোজক-পরিবেশক-প্রদর্শকদের সংগঠন ইম্পা-র তরফে গত সোমবার মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে আর্জি, সিনেমা-শিল্পের গভীর সঙ্কটে ২০২০-২১ সালের জন্য স্থানীয় প্রশাসনের (পঞ্চায়েত-পুরসভা ইত্যাদি) কর মকুব করা হোক। তা ছাড়া ন্যূনতম প্রদেয় বিদ্যুৎ বিল দিতেও নাজেহাল বিভিন্ন হল মালিক। সাধারণত যে কোনও পরিস্থিতিতে সিনেমা হলগুলিতে লক্ষাধিক টাকার বিদ্যুৎ বিল মেটাতে হয়। হল মালিকদের আর্জি, বন্ধ থাকা সিনেমা হলগুলিতে শুধুমাত্র ব্যবহারের নিরিখে বিদ্যুৎ বিল নেওয়া হোক। ইম্পা-র সভাপতি পিয়া সেনগুপ্তের স্বাক্ষরিত চিঠিতে অতিমারির ধাক্কায় বাংলার সিনেমা-শিল্পের দুর্দশার কথাও তুলে ধরা হয়েছে। তাঁদের আশঙ্কা, লকডাউন উঠলেও সিনেমা হলগুলিতে ছবি দেখানোর পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
গত দু’-তিন দশকে ধাপে ধাপে ক্রমশ খাদে তলিয়ে গিয়েছে সিনেমা হলের কারবার। পরিবেশক তথা সিনেমা হল মালিক অরিজিৎ দত্তের মনে আছে, ১৯৯০-এর দশকের গোড়াতেও রাজ্যে খান ৮০০ সিনেমা হল ছিল। তার পরে ক্রমশ মাল্টিপ্লেক্স যুগ, আজকের নেটফ্লিক্স, অ্যামাজ়ন প্রাইমের সিরিজ়ের রমরমায় সাবেক সিনেমা হল পিছিয়ে পড়েছে। এখন টেনেটুনে ২০০টি সিঙ্গল স্ক্রিন। লকডাউনের অচলাবস্থায় গ্রামের মানুষেরও অনেকের স্মার্টফোনে মুঠোবন্দি সিনেমার পশরা। টালিগঞ্জ ইন্ডাস্ট্রিও জানে, রাজ্যে সিনেমা হলের কারবার টিকিয়ে রাখতে এখন ভীষণ ভাবেই বলিউড বা বিদেশি ছবির উপরে নির্ভর করতে হয়। কিন্তু যা অবস্থা, তাতে নতুন রিলিজ়ের নাম-গন্ধ কার্যত দেখা যাচ্ছে না। এর প্রভাব রাজ্যের সিনেমা হলের কারবারেও ছাপ ফেলতে চলেছে।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রকাশ জাভড়েকর, পীযূষ গোয়েলদের সঙ্গেও ভিডিয়ো কনফারেন্সে বসেছিলেন গোটা দেশ তথা এ রাজ্যেরও কোনও কোনও সিনেমা হল মালিক। কিন্তু ক্ষুধার্ত মানুষের দায়িত্ব নিতে হিমশিম সরকার এখনই কোনও আশ্বাস দিতে রাজি হয়নি। এর আগে রাজ্য সরকার ছবি প্রদর্শন থেকে প্রাপ্য করে অনেকটাই ছাড় দিয়েছিল সিনেমা হলগুলিকে। ফলে রাজ্য স্তরে কিছুটা হলেও ভার লাঘবের আশায় ফের মুখ্যমন্ত্রীরই দ্বারস্থ হল মালিকেরা। অরিজিৎ বললেন, ‘‘যা পরিস্থিতি তাতে বিভিন্ন সিনেমা হল মালিক টেনেটুনে কর্মচারীদের মার্চের মাইনে দিতে পারবে। কয়েকটি সিঙ্গল স্ক্রিন বাদ দিলে বেশির ভাগের পক্ষেই এপ্রিলে মাইনে মেটানো মুশকিল হবে।’’ সরকারের তরফে এই সঙ্কটে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থাকে কর্মচারীদের পাশে দাঁড়াতে বলা হলেও, যা পরিস্থিতি তাতে হল মালিকদের অনেকেরই ঘটিবাটি চাঁটি হওয়ার জোগাড় বলে ঠারেঠোরে জানাচ্ছেন প্রদর্শক-পরিবেশকেরা।
ফলে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সিনেমাওয়ালা’র শেষে হল মালিক পরান বন্দ্যোপাধ্যায়ের মর্মান্তিক পরিণতি মনে পড়ে যাচ্ছে অনেকেরই। করোনা হটস্পটে ঘেরা উত্তর ২৪ পরগনার বেড়াচাঁপার বাণীরূপা হলের মালিক সুভাষ সেন গত দেড় দু’দশকেও সিনেমা হলের অন্য ছবি দেখেছেন। ‘‘হলমালিক হয়েও ‘শ্বশুরবাড়ি জিন্দাবাদ’, ‘ফাটাকেষ্ট’র জন্য হলের দরজায় দাঁড়িয়ে পাবলিকের মার খেয়েছি। সিনেমা হলের দুর্দিনেও হলে আসার নেশাটা ছাড়তে পারিনি। এ বার সেটা ফুরোতে চলেছে।’’ ইম্পা-র কোষাধ্যক্ষ শান্তনু রায়চৌধুরীর ক্ষীণ আশা, ‘‘ইদে হয়তো ছবি রিলিজ় হবে।’’ তবু ছোঁয়াচে ভাইরাস ঠেকাতে জনজীবনে পারস্পরিক দূরত্বের শৃঙ্খল জারিই এখন সময়ের মন্ত্র। এই পটভূমিতে বন্ধ হলে পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখার অভ্যেসই কারও কারও কাছে অলীক বলে মনে হচ্ছে।
(অভূতপূর্ব পরিস্থিতি। স্বভাবতই আপনি নানান ঘটনার সাক্ষী। শেয়ার করুন আমাদের। ঘটনার বিবরণ, ছবি, ভিডিয়ো আমাদের ইমেলে পাঠিয়ে দিন, feedback@abpdigital.in ঠিকানায়। কোন এলাকা, কোন দিন, কোন সময়ের ঘটনা তা জানাতে ভুলবেন না। আপনার নাম এবং ফোন নম্বর অবশ্যই দেবেন। আপনার পাঠানো খবরটি বিবেচিত হলে তা প্রকাশ করা হবে আমাদের ওয়েবসাইটে।)