টিম ইন্ডিয়ার নমো

বিরাট কোহলি তিনি নিছক নামেই। টিমের অন্তরাত্মা তাঁকে চেনে নরেন্দ্র মোদী হিসেবে। নয়াদিল্লি থেকে ক্রিকেট লিখিয়ে জি এস বিবেক-এর বিশ্লেষণবিরাট কোহলি তিনি নিছক নামেই। টিমের অন্তরাত্মা তাঁকে চেনে নরেন্দ্র মোদী হিসেবে। নয়াদিল্লি থেকে ক্রিকেট লিখিয়ে জি এস বিবেক-এর বিশ্লেষণ

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৫
Share:

পয়লা সেপ্টেম্বর সন্ধে সাড়ে আটটা।

Advertisement

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে সিরিজ জয়ের সাত ঘণ্টা ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। ধীরে ধীরে টিম ইন্ডিয়ার সবাই তাজ সমুদ্র-র বলরুমে একে একে হাজির হচ্ছেন।

একে সিরিজ জয়, তার পর ফিফ্থ ডে-তে ও রকম রোমহর্ষক খেলা—প্রায় সবাই শিওর সে দিন রাতের পার্টি ভোর পাঁচটা অবধি গড়াবে। তার পর পুরো টিমটাই ‘পার্টি অ্যানিম্যাল’। প্রায় সবাই— রোহিত, ইশান্ত, রাহানে এবং সর্বোপরি টিমের ক্যাপ্টেন বিরাট কোহলি।

Advertisement

একে একে সবাই টেবিলে এসে বসলেন। চাইনিজ, ইন্ডিয়ান আর কন্টিনেন্টাল মেনু কার্ড রাখা সবার সামনে। কিন্তু ওয়াইন কই? শ্যাম্পেন ? রাম ?

ও সব কিছুরই ধার ধারলেন না বিরাটের টিম। সবাই মিলে সোজা ডিনার অর্ডার করলেন। আর ডিনার টেবিলে আলোচনা কী নিয়ে হল? আলোচনা হল, সাউথ আফ্রিকা সিরিজে নতুন কী কী করা যেতে পারে। কী স্ট্র্যাটেজি নিলে ওই সিরিজটাও জেতা যায়। ডিনার শেষে বিরাটের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে একটাই গুরুত্বপূর্ণ কোট পেলাম। ‘‘দ্য ফ্যামিলি দ্যাট ইটস টুগেদার, স্টেস টুগেদার।’’ বুঝতে পারলাম ধীরে ধীরে টিম ইন্ডিয়াকে নিজের পরিবার বানিয়ে ফেলেছেন।

কাট টু ২০০৮। ওটা ছিল বিরাটের প্রথম শ্রীলঙ্কা সফর। সে বার ভারত বহু বছর পর শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে ওয়ান ডে সিরিজ জিতেছে। সে বারও পার্টি সেই তাজ সমুদ্র-তেই। প্রচুর খাওয়াদাওয়া, ড্রিঙ্কস। এবং সেই পার্টির মধ্যমণি বিরাট কোহলি।

কাট টু ২০১২। এজবাস্টনে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির পার্টি। সেই পার্টিতে ‘গাংনাম স্টাইল’‌য়ে নাচ একজনই নেচেছিলেন— বিরাট কোহলি।

আজ এই পার্টিগুলোর কথা এই কারণেই লিখলাম, কারণ, এই তিনটে পার্টি আমার কাছে নতুন বিরাটকে চেনার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি।

কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে বিরাট তিনশো শতাংশ এগিয়ে ধোনির থেকে

আগের বিরাটের মধ্যে যেনতেন প্রকারেণ লাইমলাইটে থাকার একটা প্রবণতা ছিল। সেই বিরাট আজকে অতীত।

আজকের বিরাট ম্যাচ জেতার পর টিম ফোটোতে আর মাঝখানে দাঁড়ান না। দাঁড়ান এক পাশে।

আজকে চেতেশ্বর পুজারার পাশাপাশি নমন ওঝার প্রশংসা করেন বিরাট।

আজকের বিরাট দরাজ কণ্ঠে ড্রেসিং রুমে বলেন, অমিত মিশ্র-র ব্যাটিংয়ের উনি ফ্যান।

এই খোলা মনে কথা বলাটাই ইন্ডিয়ার ড্রেসিং রুমে বিরাট তফাত করে দিয়েছে। টিমের অনেকের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছি, কমিউনিকেশনের ব্যাপারে বিরাট তিনশো শতাংশ এগিয়ে এমএস ধোনির থেকে। এ ছাড়াও ধোনির সঙ্গে বিরাটের একটা বিরাট পার্থক্য আছে।

ধোনির ক্যাপ্টেন্সির কালচার ছিল, সিরিজের প্রথম টেস্ট কিছুতেই হারা চলবে না। জিততে না পারলে ড্র করতে হবে। এ ছাড়া ধোনি বিশ্বাস করতেন ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশনে। ধোনির টিমে ধোনি ছিলেন শেষ কথা। বাকি কারও কথা উনি কানেই দিতেন না। বিরাট ঘাড় ধরে এই কালচারটা ইন্ডিয়ান ড্রেসিং রুম থেকে বার করে দিয়েছেন।

টিম ইন্ডিয়ার নরেন্দ্র মোদী

শ্রীলঙ্কাতে পাঁচ বোলার নিয়ে প্রথম টেস্টে নামা বিপজ্জনক ছিল, সেটা বিরাট জানতেন। হেরে গিয়ে সমালোচনাও কম হয়নি। বিরাট কিন্তু টেস্ট ম্যাচটা জিততে চেয়েছিলেন। ওঁর কাছে টেস্ট ম্যাচের দু’টো রেজাল্ট গ্রহণযোগ্য— জেতা বা হারা।

দ্বিতীয়ত, অশ্বিনের সঙ্গে প্রচুর ব্যাপারে বিরাটের বিশাল মতপার্থক্য হয়। কিন্তু ধোনির টিমে যেমন কেউ ধোনির সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে পারতেন না, বিরাটের টিমে সবার সামনে অশ্বিন সেটা পারেন।

পারেন, কারণ বিরাট অনেক বেশি ওপেন টু সাজেশনস। আর বিরাটের সঙ্গে প্লেয়াররা তর্ক করার সময় এই ভয় পান না যে, ক্যাপ্টেন রেগে তাঁদের পরের ম্যাচ থেকে বাদ দিয়ে দিতে পারেন।

অনেকে বিরাটকে টিমের ‘নরেন্দ্র মোদী’ বলে থাকেন। তার কারণ, মোদীর মতোই বিরাট ওয়ার্কোহলিক এবং মোদীর মন্ত্রীরা যেমন সব সময় মোদীকে ফোন করে কথা বলতে পারেন, বিরাটের ক্ষেত্রেও তাই। সকাল ছ’টা হোক কী রাত বারোটা। বিরাটের দরজা সবার জন্য খোলা।

সৌরভের প্রভাব সর্বত্র

টিম ইন্ডিয়ার অনেকেই বলা শুরু করেছেন ক্যাপ্টেন বিরাটের মধ্যে তাঁরা ‘ক্যাপ্টেন গাঙ্গুলি’র ছায়া দেখতে পাচ্ছেন।

দু’জনেই অসম্ভব আক্রমণাত্মক এবং দু’জনেই অসম্ভব খোলামেলা।

অনেকে প্লেয়ার বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও দাদার সঙ্গে বিরাটের মিল পাচ্ছেন।

কী রকম?

মুরলী কার্তিককে দাদা স্পিনার হিসেবে কোনও নম্বর দেননি। তার কারণ দাদা অনায়াসে মুরলী কার্তিককে খেলতেন।

একই ভাবে, অমিত মিশ্রকে নাকি খেলার সময় ব্যাটসম্যান বিরাটের প্রচুর সমস্যা হয় নেটে। তার জন্যই অমিতের প্রতি ক্যাপ্টেন বিরাটের এই দুর্বলতা।

এই পদ্ধতিতে প্লেয়ার পছন্দ করার মধ্যে সবাই দাদার প্রভাব দেখতে পাচ্ছেন বিরাটের ওপর।

আজকে বিরাটকে যাঁরাই দেখছেন তাঁরাই বলছেন, অনেক শান্ত হয়ে গেছেন তিনি।

দিল্লির বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে পার্টি করছেন ঠিকই, কিন্তু সেটার সংখ্যা অনেক কম।

নিজে অসম্ভব টেনিস ভালবাসেন বলে টেনিসের টিম কিনলেন। এই সিদ্ধান্তের পিছনে স্পনসর নাইকি-র প্রভাব প্রচুর। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজের ব্র্যান্ড তৈরির ক্ষেত্রেও এই কেরিয়ার মুভটা খুব ইন্টারেস্টিং।

বিরাটের এই ম্যাচিওরিটির পিছনে একজনের হাত বিরাট— তিনি রবি শাস্ত্রী। ভারতীয় ড্রেসিং রুমে যদি বিরাট হন নরেন্দ্র মোদী, রবি শাস্ত্রী অবশ্যই অমিত শাহ।

বিরাটকে যে পরিমাণ প্যাম্পার করেন রবি শাস্ত্রী, তা না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবেন না। একেবারে বাচ্চার মতো বিরাটকে আগলে রাখেন রবি। যা আমার ধারণা বিরাট পছন্দ করেন।

সে দিন বিরাটের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সাউথ আফ্রিকা সিরিজ নিয়ে। এর মধ্যেই পুরো সাউথ আফ্রিকা টিমের সব প্লেয়ারের ভিডিয়ো বেঙ্গালুরু ক্যাম্পে পৌঁছে গিয়েছে বিরাটের তৎপরতায়। সাপোর্ট স্টাফদেরও টিমের ফিটনেস নিয়ে কথা বলে রেখেছেন ক্যাপ্টেন কোহলি।

আজ ফিরে তাকালে মনে হয়, পুরো সেই পঞ্জাবি উদ্দামতায় নাচা বিরাটের আর মদের হ্যাংওভার চাই না, চাই সাফল্যের হ্যাংওভার।

ক্যাপ্টেন কোহলির নতুন রূপ এটাই!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement