অতনু বিশ্বাস করেন যে কোনও হিট ছবি ইন্ডাস্ট্রিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দেয়। — ফাইল চিত্র।
ছবি মুক্তির আগে তাঁর দম ফেলার সময় নেই। কিন্তু তার মাঝেও সময় দিলেন অতনু ঘোষ। সম্প্রতি এক বিকেলে পরিচালকের দক্ষিণ কলকাতার ফ্ল্যাটের স্টাডি রুমে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শুরু হয়েছিল এক দীর্ঘ আড্ডা।
প্রশ্ন:এই ছবির ভাবনাটা কী ভাবে আসে?
অতনু: ট্যামসেন কোর্টনির লেখা ‘ফোর ফিট আন্ডার’ বইতে ৩০ জন গৃহহীন মানুষের সাক্ষাৎকার রয়েছে। গৃহহীন মানুষের চিত্রটা সারা পৃথিবীতেই কমবেশি এক। বইটা পড়ে এই ছবির ভাবনাটা মাথায় আসে।
প্রশ্ন: তার মানে ‘আরো এক পৃথিবী’র চার জন চরিত্র গৃহহীন?
অতনু: না। আমার ছবির চরিত্ররা জীবনের এমন এক মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছে, যার পরের ধাপ গৃহহীন হয়ে যাওয়া।
প্রশ্ন:‘ময়ূরাক্ষী’, ‘রবিবার’, ‘বিনিসুতোয়’— এই ট্রিলজি আপনার থেকে দর্শক পেয়েছেন। নতুন ছবিও কি কোনও ট্রিলজির অংশ?
অতনু: এটা একেবারেই স্বতন্ত্র ছবি। ট্রিলজির বিষয় ছিল নাগরিক নিঃসঙ্গতা। তার পর অন্য গল্প নিয়ে ‘শেষ পাতা’ করেছি। এই ছবিটাও আলাদা।
‘আরো এক পৃথিবী’ ছবির সেটে তাসনিয়া ফারিন এবং কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে অতনু। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: এক জন পরিচালক হিসাবে কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পরিচালককে পরিচালনা করা কতটা কঠিন?
অতনু: বাইরে থেকে কঠিন মনে হতে পারে। ফ্লোরে ও কিন্তু পূর্ণাঙ্গ অভিনেতা। সেখানে ওর পরিচালক সত্তা একদমই কাজ করে না। কৌশিকের একটা জীবনবোধ রয়েছে। তাই ছবিতে ও চরিত্রকে চূড়ান্ত বিশ্বাসযোগ্যতায় পৌঁছে দিতে পারে। পাশাপাশি খুবই স্বতঃস্ফূর্ত অভিনেতা।
প্রশ্ন: কৌশিক কি আপনাকে পরিচালনার ক্ষেত্রে কোনও ইনপুট দিয়েছিলেন?
অতনু: একটা ঘটনা মনে পড়ছে। সাধারণত ওয়াইড লেন্সে কাজ করার আমার একটা প্রবণতা আছে। এক দিন রাতে ফোন করে বলল, ‘‘আগামী কালের দৃশ্যে একটু ক্লোজ়ে গেলে ভাল হয় না?’’ সে একদম কাতর অনুরোধ (হাসি)।
প্রশ্ন: সম্প্রতি কেরল আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে ‘শেষ পাতা’ দেখানো হল। উৎসবে হাঙ্গেরির পরিচালক বেলা টারের সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল।
অতনু: সাংঘাতিক অভিজ্ঞতা! বলা যেতে পারে আমার জীবনের অন্যতম প্রাপ্তি।
প্রশ্ন: ওঁর সঙ্গে কী নিয়ে কথা হল?
অতনু: সাধারণত এই ধরনের কিংবদন্তি মানুষদের কাছে আমি সচরাচর গিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি না। কিন্তু এবার দেখলাম দূরে এক কোণে মানুষটা একা বসে রয়েছেন। স্যারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, রোজ যে এত আকারে আমরা ছবি দেখি, তা হলে ইমেজের প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ, সেটা বজায় থাকবে কী ভাবে। ইমেজের সৌন্দর্যবোধ থাকবে কী ভাবে? উত্তরে বললেন, ‘‘দূরত্ব বাড়াও। তোমার আমার প্রত্যেকের মধ্যেই এই ক্ষমতা লুকিয়ে রয়েছে। সেটাকে কাজে লাগাও।’’
‘বিনিসুতোয়’ ছবির একটি দৃশ্যে ঋত্বিক চক্রবর্তী এবং জয়া আহসান। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: অতিমারির পর বাংলা ছবি এক দিনে কোটি টাকার ব্যবসাও করেছে। তাহলে কি বাংলা ছবি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে মনে হচ্ছে?
অতনু: আমার মতে, একটা হিট ছবি মানে ইন্ডাস্ট্রি আরও এক ধাপ এগোল। বিনোদন মানে আমার কাছে এনগেজমেন্ট। এটা ছবিভেদে আলাদা। ইন্ডাস্ট্রিকে বাঁচিয়ে রাখতে মূলধারার ছবি ভীষণ দরকার। কারণ আমাদের ছবি ওই ছবিগুলোর একটা প্রতিক্রিয়া।
প্রশ্ন: বাণিজ্যসফল ছবি তৈরির ইচ্ছা নেই?
অতনু: দুটো ধারার মধ্যে তফাতটা আগে বুঝতে হবে। ধরা যাক দুটো ছবির বিষয় একই— একাকিত্ব। একটি ছবির ক্ষেত্রে আমি ফর্মুলার সাহায্যে সেখানে পৌঁছতে পারি। আবার জীবনের সহজাত যে প্রতিক্রিয়া, তার অবলম্বনেও একাকিত্বকে ফুটিয়ে তোলা যায়। আমি এই দ্বিতীয় পথের পথিক। হয়তো সেটা খুব কম সংখ্যক সংবেদনশীল মানুষকেই নাড়া দেবে।
প্রশ্ন: বলা হয় আপনি বক্স অফিস নিয়ে ভাবেন না। এর পিছনে কি বিশেষ কোনও কারণ আছে?
অতনু: আমি ছবি নিয়ে ভাবি। চেষ্টা করি ভুল-ত্রুটি শুধরে নিতে। যাতে ছবির প্রতি মানুষের আরও বেশি আগ্রহ তৈরি হয়। প্রেক্ষাগৃহের পর ‘বিনিসুতোয়’ যখন ওটিটিতে মুক্তি পেল, তখন দিনে প্রায় ২০-৩০টা করে মেসেজ পেয়েছি। ছবিটা নিয়ে প্রতিক্রিয়া আমাকে অবাক করেছিল।
প্রশ্ন: ‘বিনিসুতোয়’ প্রথমে শুধু নন্দনে মুক্তি পেয়েছিল। আরও বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছতে তো আরও বেশি হল প্রয়োজন...।
অতনু: আরও বেশি সংখ্যক মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার যে ফর্মুলা, পরিচালক হিসেবে তা কোনওদিনই আমাকে আকর্ষণ করেনি। ওই ফাঁদে কোনওদিন পা দিতেও চাই না। সিনেমা মূলত মানুষের জীবনের কথা বলে। দর্শককে আকর্ষণ করতে সেটাকে বিকৃত করতে হলে হয়তো আমি উৎসাহ হারাব।
প্রশ্ন: তাহলে কি ছবি পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনার কাছে পুরস্কার প্রাধান্য পায়?
অতনু: একদমই তা নয়। উল্টে, আমার বেশ কিছু ছবি পুরস্কৃত হওয়ার পর বেশ অবাকই হয়েছিলাম (হাসি)। কারণ চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাকে বহু আঙ্গিকে বিশ্লেষণ করে পুরস্কৃত করা হয়। আমি তো কোনও দিন সিনেমার ভাষা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ছবি তৈরি করিনি। জীবনের নিটোল গল্প বলেছি।
প্রশ্ন: পুরস্কারের লোভ নেই, কিন্তু সমালোচকদের প্রশংসার?
অতনু: আগে সমালোচকরা সিনেমা এবং দর্শকের মধ্যে একটা সেতু তৈরি করে দিতেন। এখন দর্শককে পথ দেখানোর চেষ্টা করা হয়। আমার ছবির ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে, ছবি ভাল, কিন্তু সাধারণ মানুষের ভাল লাগবে কি? এটা বলায় কোথাও যেন দর্শককেও অসম্মান করা হচ্ছে। এই ছবিটা তোমার জন্য নয়, ওই ছবিটা তোমার জন্য— এই বলার মধ্যে দিয়ে যে দর্শক হয়তো একটু পরিণত হয়ে উঠতে পারতেন, তিনি কিন্তু সুযোগ হারাচ্ছেন।
প্রশ্ন: বলিউডের মতো টালিগঞ্জেও এখন বক্স অফিস পরিসংখ্যানকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বলে কি এই পরিস্থিতি?
অতনু: হতে পারে। এই যে বলা হয়, ওই ছবিটা আপনি মশাই দেখতে যাবেন না, মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে! আমাকে গত ১০ বছরে এরকম ১০টা ছবি যদি কেউ দেখাতে পারে, যেটা নাকি মাথার উপর দিয়ে বেরিয়ে যাবে, তাহলে আমি মেনে নেব। ভুলে গেলে চলবে না, বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে কিন্তু দর্শকের কথা মাথায় রেখে ছবি তৈরি হয়, কোনও বিমূর্ত ধারণাকে মাথায় রেখে নয়। যে কোনও ইন্ডাস্ট্রিতে প্রেক্ষাগৃহ ভরানোর মতো ছবিও থাকবে, আবার মানুষকে নাড়া দেওয়ার মতো ছবিও থাকবে। দর্শক নিজে ছবি বেছে নেবেন। দর্শককে ছবি বেছে দেওয়ার প্রবণতায় আমার আপত্তি আছে।
প্রশ্ন: সমসাময়িক বাংলা ছবি দেখেন?
অতনু:আমি প্রত্যেকের ছবি দেখি। এমনকি, যে ছবিগুলো হয়তো খুব বেশি দেখার সুযোগ থাকে না সেগুলো পর্যন্ত দেখার চেষ্টা করি। যেমন ‘অনন্ত’, ‘আকাশ অংশত মেঘলা’, ‘প্রিয় চিনার পাতা ইতি সেগুন’, ‘ঝিল্লি’ দেখেছি।
প্রশ্ন: ওয়েব সিরিজ় নিয়ে কোনও ভাবনা নেই?
অতনু:সত্যি বলতে এখনও সেরকম কোনও প্রস্তাব নেই। দু-একটা ক্ষেত্রে ভাবনার আদানপ্রদান হয়েছিল। কিন্তু তার পর তাঁরা খুব একটা উৎসাহ দেখালেন না।