উৎসবের বাঙালি। বাঙালির উৎসব। আর এই দুইয়ের মিলমিশে জন্ম নেয় সেলুলয়েডে দেবীবোধন। টলিউডে তো বটেই, বলিউডেও বাঙালি পরিচালকদের ছবিতে বারবার উঠে এসেছে দুর্গাপুজো। ‘পথের পাঁচালী’ থেকে শুরু করে হালফিলে ‘দুর্গা সহায়’, পুজোর এই বহুল প্রচলিত ‘ট্রোপ’ ব্যবহারের লোভ ছাড়তে পারেননি অনেক নির্দেশকই। বাঙালি মননে পুজো তো শুধু চার দিনের উৎসব নয়। রোজনামচার গ্লানি ভুলিয়ে পুজো বেঁধে দেয় বেঁচে থাকার নতুন গান। পরিচালকদের সৃজনীবোধের ছোঁয়ায় পরদার পুজো হয়ে ওঠে বাঙালি জীবনযাত্রার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ।
পুজোর খুব পরিচিত অনুষঙ্গ ঘরে ফেরা। দেশ-বিদেশ থেকে ছেলে-মেয়েরা এই সময়ে ঘরে ফেরে। আর তাকে কেন্দ্র করে তৈরি হয় ঘরে-বাইরের দ্বন্দ্ব। এই ট্রোপটাই দেখা গিয়েছিল ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘উৎসব’ ছবিতে। দেবীর বিসর্জনের পরে চরিত্রগুলো নিজের কর্মস্থলে ফিরে যায়। তবে জীবনযাপনের নতুন বোধকে সঙ্গী করে। শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও নন্দিতা রায়ের ‘বেলাশেষে’তেও পুজোয় ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করেই নাটকীয়তা চড়তে থাকে।
আবার পুজোকে ঘিরে সাসপেন্সের গল্পও বোনা হয়েছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘হিরের আংটি’তে। শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের গল্প অবলম্বনে তৈরি ছবিতে পুজোর প্রেক্ষাপটে দেখানো হয়েছিল গন্ধর্ব কুমারের গোপন কাহিনি। আবার ডাকাতির মতলবে আসা এক পরিচারিকার হৃদয় পরিবর্তনের গল্প ‘দুর্গা সহায়’-এর প্রেক্ষাপটে। নারীশক্তি, নারী-ক্ষমতায়ন আর নারী-নির্যাতন, এই তিনটি বিষয়কে পুজোর ছকে বেঁধেছিলেন পরিচালক রাজা সেন। ছবির নাম ‘দেবীপক্ষ’। আবার অবসেসিভ প্রেমিকের ইতিবৃত্ত নিয়ে ‘দশমী’ করেছিলেন পরিচালক সুমন মৈত্র।
পুজো শুধু টলিপাড়ার একার নয়। প্রদীপ সরকার, সুজিত সরকার, সুজয় ঘোষের মুনশিয়ানায় হিন্দি ছবিতেও দুর্গাপুজো স্বমহিমায় বিরাজমান। আর সে ক্ষেত্রে বাঙালি-অবাঙালি দর্শকের বিভাজনও মুছে যায়। শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গির বিচারে, হালফিলে হিন্দি ছবিতে দুর্গাপুজোর সবচেয়ে সফল রূপকার সুজয়। তাঁর ‘কহানি’ ছবির ক্লাইম্যাক্স অসুরবিনাশের সমসাময়িক রূপক হিসেবে গণ্য হতে পারে। পুজোর সাবেকিয়ানা ধরা পড়েছিল প্রদীপের ‘পরিণীতা’ ছবিতেও।
তবে বলিউডে দুর্গাপুজোর প্রদর্শন স্টিরিওটাইপও বটে। লালপাড় সাদা আটপৌরে শাড়ি, ধুনুচি নাচ, মহিলাদের উলুধ্বনি আর শাঁখের হর্ষধ্বনি। ছোট পরদায় প্রায় এক দশক ধরে একতা কপূর পুজোর এই রমরমা দেখিয়েছেন। সঞ্জয় লীলা ভংসালীর ‘দেবদাস’ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। ঐশ্বর্যা রাই বচ্চন আর মাধুরী দীক্ষিতের বিখ্যাত ‘ডোলা রে’ নাচের প্রেক্ষাপট ছিল দুর্গাপুজো। যদিও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের উপন্যাসে এমন কোনও প্রসঙ্গ ছিল না। সুজিত সরকারের ‘ভিকি ডোনার’-এ গানের ফাঁকে পুজোর একটা দৃশ্য ছিল। ঋভু দাশগুপ্তের ‘তিন’ ছবিতেও পুজোর আভাস মেলে।
হোলি নিয়ে হিন্দি ছবির ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হলেও, দীপাবলি কিন্তু বলিউড ছবিতে সে ভাবে জায়গা পায় না। সে দিক দিয়ে দেখলে, মা দুর্গা কাউকে নিরাশ করেন না!