প্রথম পর্ব মুক্তি পেতেই দর্শকের ভিড়ে ধসে পড়ে এইচবিও-র অ্যাপ! এইচবিও-র পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক কোটি দর্শক প্রথম দিনেই পর্বটি দেখেছেন। ছবি: সংগৃহীত
সেই কাঁটার সিংহাসন, সেই ক্ষমতার লড়াই! সেই ষড়যন্ত্রের রক্তাক্ত ইতিহাস, সেই ড্রাগনের অগ্নিকাণ্ড! থিম সং বেজে উঠতেই নস্ট্যালজিয়ায় সুড়সুড়ি। ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর প্রিক্যুয়েল বলে কথা! দর্শকও পর্দার সামনে পপকর্ন-পিৎজা-ওয়াইন নিয়ে তৈরি।
প্রায় এক দশক ধরে ছোটপর্দার দুনিয়া কাঁপিয়েছে ‘গেম অফ থ্রোন্স’। মারামারি, বিশ্বাসঘাতকতা, যৌনতার উস্কানি, অবৈধ সম্পর্ক, ক্ষমতার লড়াই, ড্রাগন, মৃত মানুষের সেনা— কী-ই না ছিল সেই গল্পে। জর্জ আর আর মার্টিনের উপন্যাস ‘আ সং অফ আইস অ্যান্ড ফায়ার’ পর্দায় জীবন্ত হতে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে বসে থাকত এক গোটা প্রজন্ম। ২০১১ সাল থেকে ২০১৯ পর্যন্ত আটটি সিজন ধরে চলেছিল এই গল্প। ছোটপর্দায়ও যে ‘স্পেক্টাক্ল’ তৈরি করা যায়, তা দেখিয়ে দিয়েছিল এই সিরিজ। শেষটা অবশ্য দর্শকের মনোমতো হয়নি। তবে তাতে সিরিজের জনপ্রিয়তায় এক ফোঁটাও ভাটা পড়েনি। তাই এইচবিও রাতারাতি ঘোষণা করেছিল একগুচ্ছ স্পিন অফ-এর। সেই তালিকার অনেকগুলি অবশ্য বাতিলও হয়ে গিয়েছিল। শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে ‘হাউস অফ দ্য ড্রাগন’। এবং তার প্রথম পর্ব মুক্তি পেতেই দর্শকের ভিড়ে ধসে পড়ে এইচবিও-র অ্যাপ! এইচবিও-র পরিসংখ্যান বলছে, প্রায় এক কোটি দর্শক প্রথম দিনেই পর্বটি দেখেছেন। এর আগে নাকি কোনও সিরিজের প্রথম দিনে এত বেশি সংখ্যক দর্শক তারা পায়নি। প্রসঙ্গত, ২০১১ সালে ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর প্রথম পর্ব দেখেছিলেন ২২ লক্ষ দর্শক।
কে বসবে আসনে, কার বুদ্ধি বা গায়ের জোর কতটা এগোবে, কে কাকে মাত করে সিংহাসনে বসবে, মোটামুটি তা ঘিরেই গল্প। ছবি: সংগৃহীত
আসল সিরিজের শেষটা নিয়ে যতই হতাশা থাক দর্শকের মধ্যে, তার প্রিক্যুয়েল দেখার উৎসাহে যে কোনও রকম উদাসীনতা নেই, তা প্রমাণ হয়েই গিয়েছে ‘হাউস অফ দ্য ড্রাগন’এর প্রথম পর্বের সম্প্রচার বা স্ট্রিমিংয়ের সময়ে। কিন্তু বাকি পর্বেও দর্শক ধরে রাখার মতো তেমন রসদ নতুন সিরিজে আছে কি? গল্পের শুরু মন্দ নয়। ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর গল্পের প্রায় ১৭২ বছর আগের ঘটনা। পটভূমি সেই ওয়েস্টোরসই। গল্পের মূলেও রয়েছে সেই ক্ষমতার লড়াই। কে বসবে আসনে, কার বুদ্ধি বা গায়ের জোর কতটা এগোবে, কে কাকে মাত করে সিংহাসনে বসবে, মোটামুটি তা ঘিরেই গল্প। অনেকটা মূল সিরিজের মতোই। ১৭২ বছর আগে ওয়েস্টোরসে রাজ করত টার্গেরিয়ান বংশ। সে সময়ে যে তারা ক্ষমতার শীর্ষে ছিল, তা গল্পেই বলা আছে। একটা-দুটো নয়, প্রায় ১৬টা ড্রাগন ছিল তাদের অধীনে। রাজা ছিল ভালমানুষ গোছের। পুত্রসন্তানের জন্য হাপিত্যেশ করে বসে থাকত আর কন্যা যে সিংহাসনকেই পাখির চোখ করে বেড়ে উঠছে, সে দিকে তেমন নজর দিত না। তার ভাই ছিল বখাটে (আপাতত মনে হচ্ছে, সে-ই সিরিজের প্রধান খলনায়ক), রাজ্যের মন্ত্রীদের হাড় জ্বালিয়ে বেড়াত, নিষিদ্ধপল্লীই ছিল তার আসল রাজত্বের জায়গা। রানি তার কর্তব্য করে যেত, রাজার ঘর আলো করে রাজকুমার আনার দায়িত্ব যে ছিল তারই ঘাড়ে। তার পর কোথাকার জল কদ্দূর গড়ায়, মোটামুটি তাই নিয়েই যে গল্প, তা প্রথম পর্বেই টের পাবেন দর্শক।
কিন্তু জাঁকজমক যতটা, দম ততটা কি? ছবি: সংগৃহীত
নতুন সিরিজে রয়েছে সবই। ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর মতোই গল্প বলার ধরন। নির্মাতারা প্রোডাকশনের কোনও কিছু নিয়েই আপস করেননি। সিরিজ তৈরির বাজেটও যে গগনচুম্বী, তা এক ঝলক দেখেই বোঝা যাবে। প্রথম পর্বেই বমি-উঠে-আসা রক্তাক্ত দৃশ্য রয়েছে। পেট কেটে সন্তান বার করে আনা, বর্শা দিয়ে মাথার ঘিলু বার করা, গলা কেটে কাটা মুণ্ডু নাচানো— বাদ ছিল না কিছুই। মাখো-মাখো যৌনদৃশ্য থেকে মদ্যপ অবস্থায় ‘অর্জি’ দৃশ্য, এই সিরিজ যে ‘গেম অফ থ্রোন্স’এর যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।
কিন্তু জাঁকজমক যতটা, দম ততটা কি? এমনিতে দর্শকের মন্দ লাগেনি প্রথম পর্ব। তাঁদের বেশির ভাগেরই মত, ‘শুরুটা ভালই হয়েছে’। কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে নানা রকম প্রশ্ন মনে উঁকি মারবেই। ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর শুরুতেই লড়াইটা জমে গিয়েছিল। একাধিক বংশ যে ক্ষমতায় আসার জন্য ছক কষছে, তা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল প্রথম পর্ব থেকেই। সেখানে এই সিরিজের গল্প মূলত একটি বংশ নিয়েই। তাই টানটান উত্তেজনা একটু হলেও কম। গল্পে নস্ট্যালজিয়া প্রচুর। ‘অনন্ত শীতকাল’-এর উল্লেখ রয়েছে, থিম সং অনেকটাই এক রয়েছে, চরিত্রদের হাবেভাবে আগের মতোই ছল-চতুরতার আলোছায়া রয়েছে। এমনকি, রাজকুমারী রান্যায়রা যখন তার পোষা ড্রাগনকে আগুন জ্বালানোর জন্য ‘ড্র্যাকায়রিস’ বলে আদেশ করে, তখন দর্শকের ড্যানেরিস টার্গেরিয়ানের জন্য মনটা একটু হলেও কেঁদে ওঠে। কিন্তু ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর চাপা উত্তেজনা এখনও অনুভব করবেন না দর্শক। সেই প্রথম পর্বে ছোট্ট ব্র্যাডকে গম্বুজ থেকে ঠেলে ফেলা দেওয়ার হাড় হিম করা দৃশ্য মনে পড়লে দর্শকের বুক এখনও কেঁপে ওঠে। আরিয়া স্টার্কের দৃঢ়চেতনা এখনও অনুপ্রাণিত করে লক্ষ লক্ষ দর্শককে। পিসি-ভাইপো হলেও জন স্নো-ড্যানির প্রেমকাহিনি এখনও দর্শক মনে মনে সমর্থন করেন। ‘হাউস অফ দ্য ড্রাগন’এর চরিত্ররা প্রথম পর্বে ততটা যোগাযোগ তৈরি করতে পারল না দর্শকের সঙ্গে। রাজা ভিসেরিস (প্যাডি কনসিডিন অভিনীত) ভাল মানুষ। কিন্তু তার ভালমানুষি ফুরিয়ে যায় পুত্রসন্তানের আশায়। তাই তো অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর পেট কেটে মেরে ফেলতে তার অনুতাপ হয় না। তার মেয়ে রান্যায়রা (মিলি অ্যালকক) রানি হওয়ার জন্যই জন্মেছে। কিন্তু তার বাবাকে তার মন্ত্রীরা বুঝিয়েছে, রানি নয়, রাজাই চায় তাদের। মিলি অ্যালককের অভিনয় জোরালো, তবে তাঁর চরিত্রের সব দিক এখনও স্পষ্ট নয় দর্শকের কাছে। এক মাত্র মনে দাগ কাটবে রাজার ভাই ডেমনের চরিত্র। ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর খলচরিত্ররা বরাবরই গল্পের মূল আকর্ষণ ছিল। ‘ক্রাউন’-খ্যাত ম্যাট স্মিথের অভিনয় গুণে নতুন এক খলনায়ক পেলেন দর্শক। আগামী পর্বে ডেমন কী কী করে, তা দেখার জন্য অপেক্ষা করে থাকবেন সকলেই। তবে ‘গেম অফ থ্রোন্স’এর ঘটনার ১৭২ বছর আগের গল্প। কেন চরিত্ররা একই ভাবে কথা বলে বা একই রকম সাজপোশাক তাদের, তা ঠিক বোঝা গেল না।
‘ক্রাউন’-খ্যাত ম্যাট স্মিথের অভিনয় গুণে নতুন এক খলনায়ক পেলেন দর্শক। ছবি: সংগৃহীত
‘হাউস অফ দ্য ড্রাগন’ ভারতে ডিজনি প্লাস হটস্টারে স্ট্রিম করা হচ্ছে। এই নতুন সিরিজ ‘গেম অফ থ্রোন্স’এর হতাশাজনক শেষের জন্য পাপস্খালন করতে পারে কি না, এখন সেটাই দেখার।