সেমন্তী মৈত্র। বয়স তেইশ। ‘হাতে আঠা দিয়ে ফোন সাঁটা’ বদনাম অনেক দিনের। তবে মাসকয়েক আগের ঘটনা তার থেকেও ভয়ানক। রাত একটায় বাবা-মায়ের ঘরের দরজায় ধাক্কা। বাবা উঠে দেখেন, মেয়ে পাগলের মতো ছটফট করছে। কারণ, ফোনে নেটওয়ার্ক নেই। নেটওয়ার্ক না আসা পর্যন্ত কোনও কথায় শান্ত করা যায়নি সেমন্তীকে।
এতটুকু পড়ে যদি মনে করেন এ শুধু জেনওয়াইয়ের ব্যামো, তবে ভুল করবেন।
শান্তনু ঘোষ। বছর বিয়াল্লিশের কর্পোরেট চাকুরে। ছুটিতে পরিবার নিয়ে উত্তরাখণ্ডে ওয়াটার র্যাফটিংয়ের প্ল্যান ছকেছিলেন। নাহ্, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হয়নি শান্তনুর। কারণ, অফিসে একজনের থেকে জানতে পারেন, যেখানে থাকবেন ঠিক করেছিলেন, সেখানে ফোনের নেটওয়ার্ক থাকলেও ডেটা কানেকশন থাকে না। ফলে বাতিল ছুটির পরিকল্পনা।
কী, খবরের কাগজটা পড়তে পড়তে আপনিও মোবাইলটা দেখলেন তো? সাবধান! এটাই কিন্তু নেশার প্রথম ধাপ। মনোবিদদের পরিভাষায় ‘ফিয়ার অব বিয়িং লেফট আউট’। দলছুট হয়ে যাওয়ার ভয়!
পাগলামির শুরু
‘‘বন্ধুবান্ধবের চাপ একটা বড় কারণ। সবাই যা করছে সেটা করার চাপ একটা থাকেই। আর তা ছাড়া চারপাশে যে ভাবে ‘ডেটা কানেকশন’কে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের মতো বেসিক নেসেসিটি বলে প্রচার করা হচ্ছে, তাতে মাথা ঘুরে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। লোকে তো খাওয়ার আগে সেই খাবারের ছবি ইন্সটাগ্রামে দেওয়ায় বেশি আগ্রহী। আসলে ভাল ভাবে বাঁচা নয়, ভাল ভাবে বাঁচার ছবিকে সবাই প্রোমোট করতে চায়,’’ বলছিলেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. জয়রঞ্জন রাম।
কিন্তু জেন ওয়াইয়ের যুক্তি হল, চাকরি-আড্ডা-কেনাকাটা সবই যখন ভার্চুয়াল জগতে, তখন অফলাইন হব কোন সাহসে! মাসখানেক আগের সে রাতের কথা বলতে গিয়ে হেসে ফেলেন সেমন্তী। তাঁর যুক্তি, ‘‘আরে, মিড নাইট সেল চলছিল এক শপিং সাইটে। বেশ কয়েকটা স্কার্ট আর স্কার্ফ শপিং কার্টে রাখা ছিল। চেক আউট করতে যাব, ঠিক সে সময় নেটওয়ার্ক চলে যায়। ভাবতে পারবেন না, সিক্সটি পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট ছিল ওগুলোয়!’’
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা কিন্তু অন্য কথা বলছেন। নাম দিয়েছেন: ডিজিটাল হেরোইন। সব সময় অনলাইন থাকার এই নেশা থেকে মুক্তির জন্য বিশেষ কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থাও শুরু হয়েছে।
ক্লিক ম্যানিয়া
অনলাইন দুনিয়ায় চব্বিশ ঘণ্টা থাকায় বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে যদি সম্পর্ক হারিয়ে যায়, তবে সেটা সমস্যার হিমশৈলের উপরের অংশ শুধু। সমস্যার এখানেই শেষ নয়। কিছু দিন আগে প্যারিসের হোটেলে হাত-পা বেঁধে ডাকাতি হয় কিম কার্দেশিয়ানের রুমে। সাইবার বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন কিমের স্ন্যাপচ্যাট থেকেই তাঁর ঠিকানা জানতে পেরেছিল দুষ্কৃতীরা। একই রকম ঘটনা ঘটেছে এখানেও। এক সপ্তাহের জন্য ব্যাঙ্কক যাওয়ার কথা ফেসবুকে জানিয়ে একই রকম বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন কলকাতার একজন। ডাকাতরা কোপ মেরেছিল ফেসবুক বুঝে।
নেশা কাটাতে
• ফোনের ইন্সট্যান্ট নোটিফিকেশন বন্ধ করে দিন
• অফিস থেকে বেরিয়ে গেলে আর অফিস ইমেল দেখবেন না
• দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ছাড়া ফেসবুক-ইন্সটাগ্রামে লগ ইন করবেন না
• বাড়ি ফিরে যে সময়টা সোশ্যাল মিডিয়ায় দিতেন সে সময়ে ছবি আঁকুন বা কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজানো শেখা শুরু করুন
• কোনও একটা বিষয় নিয়ে ভাবা প্র্যাকটিস করুন
পরামর্শ: ডা. রিমা মুখোপাধ্যায়
‘‘আমাদের অসুবিধা হয়েছে, আমরা সস্তায় ডেটা তো পেয়ে গেছি, কিন্তু ডেটা কালচার তৈরি করিনি। বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় যেমন বাড়িতে ভাল করে তালা লাগিয়ে, গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লকারে রেখে যাই, সেটা অনলাইনের ক্ষেত্রে করি না। আমি তো বলব ৯৯ শতাংশ লোক না-বুঝে অপরাধের শিকার হন। ক্লিক ম্যানিয়া বা যে কোনও লিঙ্ক পেলেই সেখানে ক্লিক করা — সাইবার নিরাপত্তার সব থেকে বড় বাধা। মনে রাখবেন, অ্যাকসেসিবিলিটি যত বাড়বে নিরাপত্তা কিন্তু তত কমবে,’’ সতর্ক করে বলছিলেন রাজ্যের সাইবার অপরাধ বিষয়ের সরকারি আইনজীবী বিভাস চট্টোপাধ্যায়।
ডিজিটাল ডিটক্স
অনলাইনে থাকার প্রবণতা যে নেশার আকার নিয়েছে সেটা মানছেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রিমা মুখোপাধ্যায়ও। বলছিলেন, ‘‘নেশা তো বটেই। আমাদের পরিভাষায় সমস্যাটাকে বলি ইন্সট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন। অর্থাৎ, যা চাইছি সঙ্গে সঙ্গে সেটাকে পেতে হবে, না হলেই সমস্যা। খাবার চাইছি তো পেয়ে যাচ্ছি সুইগি-জোমাটোতে, পোশাক চাইছি পেয়ে যাচ্ছি ফ্লিপকার্ট-অ্যামাজনে। আর সেটা না হলেই ব্যাপারটা অ্যাংজাইটিতে পরিণত হয়ে যাচ্ছে।’’
একটা রিপোর্টে বলা হয়েছিল এখন লোকে গড়ে দু’ঘণ্টা মোবাইল স্ক্রিনে তাকিয়ে থাকে, গড়ে পাঁচ ঘন্টা কম্পিউটারের সামনে। কিন্তু এ নেশা কাটানোর উপায়ও তো সহজ নয়। অনলাইনের নেশা কাটাতে গিয়ে বছর আঠাশের মৈনাক চৌধুরী যেমন আটকে গেছেন টেলিভিশন সিরিজে। টুইটার-ফেসবুক ছাড়তে গিয়ে তাঁর নতুন প্রেম এখন ‘গেম অব থ্রোনস’!
‘‘ডিজিটাল ডিটক্সের দরকারটা সবাই বুঝছেন, এটা ভাল দিক। তবে সমস্যা হল অনলাইনের নেশা ছাড়াতে গিয়ে যেন অন্য আরেকটা নেশা না পেয়ে বসে,’’ বলেন ডা. রিমা মুখোপাধ্যায়।
তাই, পরের বার ফোনটা ‘আনলক’ করার অগে দু’মিনিট ভেবে দেখতে পারেন।