অমলের নতুন বৌঠান।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস ঘাঁটলে এই কিছু দিন আগে পর্যন্ত একটাই নাম উঠে আসত এই প্রসঙ্গে।
‘চারুলতা’র মাধবী মুখোপাধ্যায়।
হালফিল অবশ্য ওই কিংবদন্তি নায়িকার নামের পাশে আরও একজনের নামও উঁকি দিচ্ছে।
‘বুনো হাঁস’য়ের সুদীপ্তা চক্রবর্তী। অমলের বৌঠান, থুড়ি অমলের বৌদি।
কয়েক মাস আগে যিনি চর্চায় ছিলেন ‘বিগ বস’য়ে গিয়ে অনেক বিতর্কিত মন্তব্য করে। সেই সুদীপ্তা এখন ফের শিরোনামে। কেউ প্রশংসা করছেন তাঁর সাবলীল অভিনয়ের। কেউ বলছেন অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরীর ‘বুনো হাঁস’য়ের মঞ্জু তাঁদের মনে করিয়ে দিচ্ছে ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘বাড়িওয়ালি’র মালতীকে। যে চরিত্রে অভিনয় করে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন সুদীপ্তা।
সেটা ছিল ২০০১। আজ ১৩ বছর পর আবার একই ধরনের এক চরিত্রে সুদীপ্তা। দর্শক অভিভূত। ফেসবুক, ফোন ইনবক্সে ভর্তি ভর্তি মেসেজ। কিন্তু সুদীপ্তা নিজে নাকি বুঝতেই পারছেন না কেন তাঁর এই অভিনয় নিয়ে এত মাতামাতি হচ্ছে!
‘বাড়িওয়ালি’ করার পর থেকে বহু বার একটা প্রস্তাব তাঁর কাছে এসেছে। ‘এক চরিত্র আছে, করবেন? ছোট কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট চরিত্র!’ দ্বিতীয় লাইনটা তো যেন মাধ্যমিকে কমন প্রশ্নের মতো লাগছিল। কাঁকুলিয়া রোডের পাঁচ তলার ফ্ল্যাটে বসে সুদীপ্তা বলছিলেন, “আরে, কাজের লোকের চরিত্র হলেই আমার কাছে আসত। সাবঅল্টার্ন চরিত্র মানেই যেন সেগুলো আমি ভাল পারব। কিন্তু আমি যে একটা রেডিয়ো জকি কিংবা সাংবাদিকের চরিত্রও ঠিক ততটাই স্বাভাবিক ভাবে করতে পারি, সেটা কারও মাথায় ছিল না।”
তখন শুরু হল দু’টো কাজ। এক, নিজে থেকে ইচ্ছে করে ইমেজ পাল্টে ফেলা। শাড়ি, বড় টিপ, ডোকরার গয়না বাদ দিয়ে অন্য ভাবে সাজা। দুই, ‘ছোট কিন্তু ইম্পর্ট্যান্ট চরিত্র’গুলো ‘না’ করে দেওয়া। এবং সে তালিকায় স্বয়ং ঋতুপর্ণ ঘোষও ছিলেন। “ঋতুদা ‘সানগ্লাস’য়ের জন্য আবার আমাকে একটা কাজের লোকের চরিত্র দিয়েছিলেন। আমি করিনি। ঋতুদা আমার সব জানতেন। তবু বলেছিলাম তুমি নিশ্চয়ই বুঝবে কেন আমি ওই ধরনের চরিত্রে টাইপকাস্ট হতে চাই না। ঋতুদার চলে যাওয়াটা আজও মেনে নিতে পারি না...,” বলেন সুদীপ্তা।
গলা ধরে আসে। মনে পড়ে যায় কী ভাবে ঋতুপর্ণর সত্কারের সময় হাপুসনয়নে কেঁদেছিলেন তিনি। আচ্ছা, জামাইবাবু বীরসা দাশগুপ্তর ‘অভিশপ্ত নাইটি’তে ঋতুপর্ণর আদলে লেখা একটা চরিত্র দেখে তাঁর কী মনে হয়েছিল? রাগ? অভিমান? এটা কী করল বীরসা এগুলো মনে হয়নি একবারও? “না, সিনেমাতে দেবালয় ভট্টাচার্যকে দেখে আমার ঋতুদা বলে মনে হয়নি। যদি বীরসা সেটা করার কথা ভেবেও থাকত, তা হলে ও ফাইনালি তা করে উঠতে পারেনি...,” উত্তর ছুড়ে দেন তিনি।
কিন্তু এ জবাব শুনে যদি পাঠকরা বলেন... প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই সুদীপ্তা বলেন, “জামাইবাবু বলে এমন বলছি? না, তা বলছি না। যদি ও চেষ্টা করেও থাকত, সেটা ফাইনালি হয়নি।” পারা না-পারার বিচার না-হয় তোলা থাক। এই সুপ্ত চেষ্টা যদি সত্যিই থেকে থাকত, সে ব্যাপারে তাঁর কী মত? “যখন প্রথম প্রথম ঋতুদাকে ‘মক’ করা হত, তখন খুব খারাপ লাগত। তার পর সিজনড্ হয়ে গিয়েছিলাম... ঋতুদার ‘স্পিরিট’-টা কেউ নকল করতে পারবে না। ঋতুদার মতো একটা চিত্রনাট্য লিখে দেখাক না কেউ... হাসি পায় ভেবে যে কেন লোকে বাহ্যিক ব্যাপারটা নকল করে এত মজা পায়। এক পাতা বাংলা লিখুক ঋতুদাকে নকল করে। তা হলে বুঝব এলেম আছে...।”
খানিকটা রাগ, খানিকটা অভিমান আজও ফুটে ওঠে তাঁর গলায়। আবারও মনে পড়ে যায় ঋতুপর্ণর লেখা মালতী চরিত্রটার কথা। যার হ্যাংওভার আজও রয়ে গিয়েছে সুদীপ্তার কেরিয়ারগ্রাফে। “সত্যি, নাইটির ওপর ওড়না আমার পিছন ছাড়ল না। টোনিদা (অনিরুদ্ধ) আমাকে বলেছিল যে এটা আরেকটা ‘বাড়িওয়ালি’ হতে চলেছে আমার কেরিয়ারে। তবে ভাবিনি ‘বুনো হাঁস’ করে এই রকম একটা ফিডব্যাক পাব। চিত্রনাট্যকার শ্যামলদা ছবির ফার্স্ট কাট-টা দেখে আমার দিদি (বিদীপ্তা চক্রবর্তী)-কে ফোন করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘সুদীপ্তাকে দেখে আমি বিশ্বাস করতে পারছি না যে কোনও অভিনেত্রী আমার লেখা চরিত্রকে এ রকম ভাবে পর্দায় আনতে পারে!’” বলেন সুদীপ্তা।
তবে কমপ্লিমেন্ট দূরে থাক, প্রথমে মূল উপন্যাসটা পড়ে সুদীপ্তা নাকি এই চরিত্রটা করতেই চাননি! কারণ? সমরেশ মজুমদারের মূল উপন্যাসে তো অমলের বৌদির জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র এক লাইন। তবে চিত্রনাট্যে সেই লাইন থেকেই তৈরি হয় পুরোদস্তুর এক চরিত্র। কোনও না-বলা সম্পর্কের ভার নেই তার কাঁধে। পার্শ্বচরিত্র হলেও তার মুখে হাততালি দেওয়ার মতো সংলাপ (পেছনে বাঁশ আর বগলে ইতিহাস নিয়ে আদিগঙ্গায় ঝাঁপ দিতে হবে!) দেওর তার ভাইয়ের মতো। বন্ধুও বটেই। স্বামীর শয্যাসঙ্গিনী হওয়ার পরেও যে রোজ সকালে তাকে গর্ভনিরোধক বড়ি খেতে হয়, সেটাও সে নির্দ্বিধায় দেওরকে বলে ফেলে।
সুদীপ্তা না-হয় এ ধরনের চরিত্রে আগেও অভিনয় করেছেন। কিন্তু সহ-অভিনেতা দেব? যিনি তারকার ইমেজটা ভাঙার প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এ ছবিতে। তা দেখে কী শিখলেন সুদীপ্তা? “দেব সেটে খুব মজা করে। খুব কিউট। কোনও হ্যাং-আপস নেই...।”
এ ধরনের মন্তব্য তো দেবের অভিনীত রিমেক ছবির সহ-অভিনেত্রীরা করেই থাকেন। সুদীপ্তার চোখে অন্য কিছু ধরা পড়েছে কি? একটু থেমে বলেন, “দেব নিজের লিমিটেশনটা জানে। ও সেগুলোর ওপর ওয়ার্ক করছে। এক সময় অনেকগুলো ছবিতে একই ধরনের চরিত্র করেছে বলে ও কিছু সেট রই্যাকশন দিতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ওর ছবির দর্শক সেগুলো পছন্দ করে। কিন্তু ‘বুনো হাঁস’ তো অন্য ধারার ছবি। সেখানে ওই একই রই্যাকশন দিলে চলবে না। অভ্যেসের কারণে সেই রই্যাকশন দিয়ে ফেললেও ওকে দেখেছি নিজে থেকেই বলতে যে এটা হয়নি। আবার টেক করতে হবে। দেব যে জায়গায় এখন রয়েছে, সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে এ ভাবে ভাঙাটা বেশ কঠিন,” বোঝান সুদীপ্তা।
অভিনেত্রী হিসেবে এত প্রশংসা পাচ্ছেন। কিন্তু এমন দিন কি দেখতে পাচ্ছেন যেখানে সুদীপ্তার অভিনয়ের জন্য বক্স-অফিসে ঝন্ঝন্ শব্দ হবে? “দিন পাল্টাচ্ছে। আজ ঋত্বিক, শাশ্বতকে মুখ্য চরিত্র করে ছবি তৈরি হচ্ছে এখানে। আমি আশাবাদী। কনটেন্ট রুল করবেই। নভেম্বরে মুক্তি পাবে অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়ের ‘ওপেন টি বায়োস্কোপ’। এ ছাড়াও আছে ‘শব্দকল্পদ্রুম’ আর ‘ভীতু’,” বলেন তিনি। মানে টলিউডের মহিলা ইরফান হতে চান তিনি? “এই রে! একদিন আসবে যখন টলিউডেও আমি রিচা চাড্ডার ‘গ্যাংস্ অব ওয়াসিপুর’য়ের মতো চরিত্র পাব...”
তিন মাস হল বিয়ে করেছেন। নতুন বৌয়ের গন্ধটা এখনও গা থেকে যায়নি। স্বামী তাঁর এই অভিনয় দেখে কী বললেন? “বিয়ের পর ‘চার’য়েও আমার অভিনয় দেখেছিল অভিষেক। তবে ‘চার’য়ের তুলনায় এটা তো অনেক বড় রোল। ওর খুব ভাল লেগেছে। বিয়ের আগে অভিষেক আমার সম্পর্কে কিছুই জানত না। শুধু জানত সোমা (বিদীপ্তা)র বোন টুম্পা (সুদীপ্তা)। অ্যাক্টিং করে। ১৮ বছর মুম্বইয়ে বিজ্ঞাপনের কাজ করেছে। অভিষেক হ্যাজ বিন লাকি ফর মি,” বলে কান এঁটো করে হেসে ফেলেন সুদীপ্তা।
তা হঠাত্ করে ‘উঠলো বাই তো কটক যাই’ করে চুপিচুপি বিয়েটা সেরে ফেললেন কেন তিনি? “ন’বছর একা থাকতাম একটা ফ্ল্যাটে। ওটা আমার জীবনের সবথেকে বড় স্ট্রাগল। ‘বিগ বস’য়ে একদিন সম্পূর্ণাকে বলেছিলাম যে, কলকাতায় সেই একা ফ্ল্যাটে ফিরে যাওয়াটা আমার কাছে খুব কষ্টকর। তাই যখন অভিষেক বলল, ‘লেটস্ সেটল ডাউন’, আমি রাজি হয়ে গিয়েছিলাম। এক মাসের মধ্যে বিয়ে। ‘লেটস্ সেটল ডাউন’ কথাগুলো শোনার জন্যই ব্যাকুল হয়ে ছিলাম...,” বলে চলেন তিনি।
কিন্তু এত একাকীত্বে ভুগতেন কেন তিনি? রাজেশ শর্মার সঙ্গে প্রথম বিয়ে ভেঙে যাওয়ার পরেও তো তিনি একটা দীর্ঘদিনের সম্পর্কে ছিলেন... “হ্যাঁ... ‘বুনো হাঁস’য়ে ছোট রোল বলে আমি প্রথমে একটু দ্বিধার মধ্যে ছিলাম। ও আমাকে এই কাজটা করার জন্য ফোর্স করেছিল... হি হ্যাজ বিন মাই সাপোর্ট সিস্টেম। শুরুর দিকে আমি কারও কথা শুনিনি। আই ওয়াজ আ রেবেল। সম্পর্কটা চালিয়ে যাওয়ার খুব চেষ্টা করেছিলাম। এক সময় ভেবেছিলাম কোনও একটা পরিণতি হবে। কত লোকে আমায় বুঝিয়েছিল সম্পর্কটা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য। কিন্তু আমি শুনিনি। এমনকী এই রকম কিছু বললে তাঁদের সঙ্গে কথা বলাই বন্ধ করে দিতাম। কারণ সম্পর্কটার ভবিষ্যত্ নিয়ে খুব আশাবাদী ছিলাম। যে কোনও কারণে সেটা হওয়া সম্ভবপর হয়নি। থাক সে কথা...অভিষেক আমার জীবনের সব কিছু জানে। আমিও ওর প্রথম প্রেম থেকে শুরু করে লং ডিসট্যান্স রিলেশনশিপ সব কিছু জানি। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।” রাজেশকে জানিয়েছেন বিয়ের কথা? “হ্যাঁ, বিয়ের পরেই।”
সংসারও পেতেছেন। আর এ দিকে কেরিয়ারেও বেশ হইচই হচ্ছে। এখন প্রায়োরিটিটা কোন দিকে? রানি মুখোপাধ্যায়ের মতো তিনিও কি বিয়ে করেই বলছেন যে মা হওয়ার জন্য তিনি উদগ্রীব? “অভিষেক বলে, ‘টেক লাইফ অ্যাজ ইট কামস’। কাজ এলে কাজ করব। মাতৃত্ব এলেও সেটা নিয়েই এগোব। প্ল্যানিং নেই আমার জীবনে।”
‘বিগবস’য়ের রুমমেট রুদ্রনীল ঘোষের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে তাঁর? বিয়ে, ‘বুনো হাঁস’ এই সব নিয়ে কথা হয়েছে? “আমরা তো ‘পতি পরমেশ্বর’ বলে একটা ছবি করলাম একসঙ্গে। আমরা ছিলাম অতিথি শিল্পী। ঝগড়ার দৃশ্য। তেড়ে ঝগড়া করলাম শু্যটিংয়ের সময়....” ‘বিগবস’য়ে গিয়ে ও ভাবে ঝগড়া করে কত রকমের অভিযোগ এনে তার পর সব মুছে সাফ করে আবার পেশাদার ভাবে কাজ করলেন? সিগারেট চুরি থেকে শুরু করে আরও কত কিছুই না অভিযোগ ছিল তাঁর রুদ্রনীলের বিরুদ্ধে....“আরে ও সব নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করে লাভ নেই। দু’ জনের বয়স হয়েছে। চারিত্রিক গঠনটা আর পাল্টাবে না। তা ছাড়া শো-টা তো শেষ হয়ে গিয়েছে,” বলেন তিনি।
প্রবাদে আছে ‘রাত গয়ি, বাত গয়ি’। ফিল্মি দুনিয়ায় শাশ্বত বলে কিছু নেই। না বন্ধুত্ব, না শত্রুতা। যদি কিছু শাশ্বত হয়ে রয়ে যায়, তা হল পর্দার কাজটা। অভিনয় করা কিছু চরিত্র। যেমন রয়ে গিয়েছে অমলের নতুন বৌঠান।
কে জানে? হয়তো থেকে যাবে এই অমলের বৌদিও।