Sudipa Chatterjee

আমার রক্ত মিশিয়ে প্রতিমার মুখে রং করা হয়, নয়তো ফ্যাকাসে লাগে

দুর্গাপুজো উপলক্ষে শুরু হয়েছে আনন্দবাজার অনলাইনের বিশেষ বিভাগ ‘তারকার পুজো’। উদ্‌যাপনের স্মৃতি এবং পরিকল্পনা জানাচ্ছেন আপনাদের পরিচিত মুখেরা।

Advertisement

সুদীপা চট্টোপাধ্যায়

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ১০:৩২
Share:

সুদীপা চট্টোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোর অজানা ঘটনা। গ্রাফিক : শৌভিক দেবনাথ।

বাড়িতে এখন তুমুল ব্যস্ততা। আমাদের বাড়ির মা দুর্গা খুব জাগ্রত। না জাগ্রত নয়, জীবন্ত আসলে। সেই প্রমাণ অনেক সময় আমাদের বাড়িতে আসা অতিথিরাও টের পেয়েছেন। অগ্নিদেবের পরিবার ঢাকা বিক্রমপুরের লোক। ওখানে ওঁদের বাড়িতে পুজো হত। তার পর কলকাতার বাড়িতে আমি বিয়ে হয়ে আসার পর ফের শুরু হল পুজো। ১৪ বছর হয়ে গেল মায়ের পুজো করছি। আমাদের বাড়ির পুজোর অনেক নিয়মকানুন রয়েছে। সব রীতি মেনেই আমরা পুজোটা করি। এই সময় মা আমার মেয়ে হয়ে যায়, অগ্নিদেব হয়ে যায় বাবা। আমাদের বাড়িতে অবশ্য এই পুজো নিয়ে বেশ কিছু অলৌকিক ঘটনাও ঘটেছে। আমাদের প্রতিমার একটা অন্যতম বিশেষত্ব হল মাকে রক্ত দিতে হয়। আমার রক্তের সঙ্গে রং মিশিয়ে মায়ের মুখ রং করা হয় নয়তো ফ্যাকাসে লাগে মাকে।

Advertisement

আমাদের বাড়িতে ত্রিবেণী মতে পুজো হয়। অর্থাৎ, তিনটে মতে পুজো হয়। ষষ্ঠী থেকে সপ্তমী পুজোটা হয় বৈষ্ণব মতে। সপ্তমীতে শিব আসেন। ওই দিন থেকে অষ্টমীর আগে পর্যন্ত শৈব মতে পুজো হয়। অষ্টমী পুরোটাই শৈব ও বৈষ্ণব মতে পুজো হয়। কিন্তু যেই বলিদান হয়ে যায় সন্ধিপুজোয় তার পর থেকেই তন্ত্র মতে পুজোটা হয়। নবমীর পর নারায়ণ তুলে নেওয়া হয়। তার পর মাকে মাছ-মুখ করানো হয়। মা তো সধবা, তাই মাছ না খাইয়ে শ্বশুরবাড়ি পাঠানো হয় না। এ তো গেল আনুষ্ঠানিকতার প্রসঙ্গ।

আমাদের বাড়িতে ভোগ রান্না করার সময় কিন্তু মায়ের নাম জপতে জপতে রান্না করতে হয়। মুখটা সে সময় বাঁধা থাকে। কোভিডে লোকে মাস্ক পরা শুরু করেছেন, আমাদের কাছে কিন্তু নতুন ছিল না বিষয়টা। কারণ খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ মায়ের আগে কেউ গ্রহণ করবে না। আজ এত বছর হয়েছে মায়ের অন্ন ভোগ রান্না করছি কখনও ভোগের স্বাদ ঈশ্বরের আশীর্বাদে খারাপ হয়নি। মায়ের নাম জপলেই সব পার হয়ে যায়। আমাদের মাখা পোলাও অপূর্ব হয়। প্রতি দিন অন্নভোগের রান্না আমাকে করতেই হয়। কারণ মা এখানে অন্নগ্রহণ করতে আসেন, তাই বাইরের লোক দিকে রান্না করাই না। করতে পারে আমার পরবর্তী প্রজন্ম কিংবা আমার পুত্রবধূ। আসলে আমাদের বাড়ির যে পুত্রবধূ হবে তাঁকে এই দায়িত্বটা নিতেই হবে। আকাশকেও (অগ্নিদেবের বড় ছেলে) বলা আছে। আমাদের কোনও চাহিদা নেই, শুধু সেই মেয়ে যেন একটু রান্নাবান্না করতে ভালবাসে, বাকিটা আমি শিখিয়ে নেব। আমার পরে তাঁকেই যে দায়িত্ব নিতে হবে। তবে, যিনি অন্নভোগ রাঁধবেন তাঁকে শুধু ব্রাহ্মণ হলে হবে না। কুলীন ব্রাহ্মণ হতেই হবে। আমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা দু’তরফে কুলীন ছিল। পুরনো দিনের মানুষ মনে করতেন, কুলীন ব্রাহ্মণের সঙ্গে বিয়ে দিলে নাকি মোক্ষলাভ হয়।

Advertisement

তবে, এই ক’টা দিন মা আমার মেয়ে হয়ে যান। আমি তখন ‘তুইতোকারি’ করি। যখন বরণ করে হাত-পা মুছিয়ে পাটে তুলে দিই, তখন আমি মা হয়ে যাই। মা যাওয়ার সময় অগ্নিদেব মায়ের হাঁটুতে মাথা ঠেকিয়ে বলে, এ বার এসো মা, নয়তো শ্বশুরবাড়িতে নিন্দা হবে তোমার বাবার। আসলে প্রতিমাকে নড়ানো যায় না। যেতেই চায় না তো। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল। এক বার দশমীতে বরণডালায় রুপোর প্রদীপটা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। পিলসুজ ধরানো হয়। সেই শিখা থেকেই ধরে গেল আগুন, সিংহের কেশর থেকে দাউ দাউ করে মায়ের কোমর পর্যন্ত আগুন উঠে আসে। মনে হল গরম গরম লাগছে আমারও। দেখি শাড়িতে আগুন ধরে গিয়েছে। সকলে মিলে সেই আগুন নেভানো হল। ঘরে গিয়ে দেখি একটা দাগ নেই, শরীরের কোনও অংশেই পোড়ার চিহ্ন নেই। সবাই অবাক হয়ে যায় বাড়িতে। ওই ঘটনার পর থেকে আমাদের বাড়িতে নতুন শাড়ি পরিয়ে ফুলের গয়নায় সাজিয়ে মাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। আমাদের বাড়িতে এক অতিথি এসেছিলেন তিনি মূর্তিপুজোয় বিশ্বাস করেন না। উপরের ঘরে যেখানে পুজো হয় উনি একা ছিলেন হঠাৎ ফোন করে উপরে সকলকে ডাকতে শুরু করলেন। বললেন মায়ের বুকের কাছটা নড়ে উঠল যেন। আমি তখন বললাম তোমার সঙ্গে দুষ্টুমি করছে মা। উনি মায়ের সামনে বসেই বলছিলেন ঈশ্বর ও মূর্তিপুজো মানেন না। মা যেন সেই প্রমাণ দিলেন।

একটা বছর মা রাগ করেছিলেন আমাদের উপর। মুখে কিছুতেই রং আসছে না। তখন শিল্পী পশুপতি রুদ্র পালই বলেন, ‘‘আপনি একটু রক্ত দিতে পারেন?’’ সুচ পুড়িয়ে কয়েক ফোঁটা রক্ত দিই। সে দিন থেকে এই ধারা মেনে আসছি আমরা।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement