গানের প্রথম দু’লাইন শুনেই মান্নাদা বললেন,—‘‘এ কী গান লিখেছেন পুলকবাবু? ‘দশ বছরের বংশীমুচির ছেলে....’। ও সব মুচিটুচি নিয়ে লেখা গান আমি গাইব না।’’ পুলকবাবু একটু আমতা-আমতা করছিলেন। মান্নাদা বললেন, ‘‘আপনার কী হয়েছে বলুন তো? এত সুন্দর লেখেন আপনি, হঠাৎ এই ‘মুচি’ নিয়ে পড়লেন কেন? জানেন তো, আমি একটু অন্য ধরনের গান গাইতে ভালবাসি।’’
আসলে একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে পুলকবাবু এই গানটা লিখেছিলেন। সেই সময় জাত-পাত, মণ্ডল কমিশন...এ সব নিয়ে সারা দেশ উত্তাল, সর্বত্র অশান্তি। পুলকবাবু তখন কোদাইকানালে। গানটা লিখেছিলেন সেই পরিস্থিতি নিয়ে। লিখে পুলকবাবুর একটা তৃপ্তি হয়েছিল। অপ্রিয় হলেও এ কথা তো সত্যি, পুলকবাবু তাঁর প্রিয় লেখাগুলি মান্নাদাকেই দিতেন। ভেবেছিলেন, অন্যান্য গানের মতো এই লেখাটাও মান্নাদার খুব পছন্দ হবে। কিন্তু গানের কথা শুনে মান্নাদা এমন রে রে করে উঠলেন যে পুলকদা একদম মুষড়ে পড়লেন।
কিছু দিন বাদে পুলকবাবুর দেখা সুপর্ণকান্তির সঙ্গে। তাঁকে ঘটনাটা বললেন। জানালেন নিজের দুঃখের কথাও। সুপর্ণদা বললেন, ‘‘গানের কথাগুলো একবার শোনাও তো পুলককাকা।’’ কাহিনিমূলক বেশ বড় গান। গানের প্রথম চার লাইন শুনেই সুপর্ণদার ভাল লেগে গেল। তারপর বাড়িতে একটা বাচ্চা কাজের ছেলে রাখা হল—মুচির ছেলে। শ্রীমতীকে অনেক কষ্টে রাজি করানো গেল। কিন্তু একটা শর্তে। ছেলেটি যেন ঠাকুরঘরে না ঢোকে। ওদিকে সুপর্ণদা গানটা নিজের কাছে রেখে দিলেন।
মান্নাদার পুজোর গানের তোড়জোড় চলছে। সুপর্ণকান্তি তাঁর অত্যন্ত পছন্দের সুরকার। তত দিনে দু’জনের যুগলবন্দিতে তৈরি হয়ে গিয়েছে বহু কালজয়ী গান— সে আমার ছোট বোন, কফিহাউস, সারাজীবনের গান ইত্যাদি। মান্নাদা বললেন, ‘‘নতুন কী গান তৈরি করলে খোকা?’’ (এ নামেই সুপর্ণকান্তিকে ডাকতেন)। সুপর্ণদা বললেন, ‘‘আপনার কথা ভেবে গান তৈরি করেছি।’’ শুনে মান্নাদা খুশি হলেন। কিন্তু তার পরেই বললেন, ‘‘বুঝলে খোকা! পুলকবাবু কী রকম এক অদ্ভুত গান লিখেছে—ওই মুচি নিয়ে গান। বলো তো মুচি নিয়ে আবার গান হয় নাকি? কী যে হচ্ছে আজকাল!
এবার সময় এল মান্নাদাকে গান শোনানোর। খোকা কী গান তৈরি করেছে, তা শোনার জন্য মান্নাদাও উদ্গ্রীব—গানের কথাটা আগে শুনি। সুপর্ণদা পড়তে আরম্ভ করলেন : ‘‘দশবছরের বংশীমুচির ছেলে....’’। শুনে মান্নাদা তো আঁতকে উঠলেন—‘‘এই গানটা তুমি সুর করেছ? তোমারও কি মাথাখারাপ হয়ে গেছে?’’ সুপর্ণদা বললেন, ‘‘একবার অন্তত গানটা শুনুন।’’ অনিচ্ছা নিয়েই মান্নাদা গানটা শুনলেন। একটু যেন বরফ গলল। বললেন, ‘‘আর একবার শোনাও তো!’’ এবার মান্নাদা সিরিয়াস—‘‘দারুণ বেঁধেছ গানটা। এবার শুনতে খারাপ লাগছে না। আই মাস্ট সিঙ্ দিস সং।’’
ম্যাডাম (মান্নাদার স্ত্রী) বলতেন, ‘‘ডেফিনিটলি ইট উইল বি ‘ইয়েস’, হোয়েন হি স্টার্টস উইথ ‘নো’। এমনটা বারবার হয়েছে। যেমন, ‘কফি হাউসে’র দ্বিতীয় পর্বে। কফি হাউসের সেই সব চরিত্র এখন কেমন আছে, কী করছে তারা? মূলত সাংবাদিক শমীন্দ্র রায়চৌধুরী এই বিষয়টি নিয়ে গানটি লিখলেন। কয়েক মাস ধরে শমীন্দ্র-সুপর্ণকান্তি মিলে গানটির ঘষা-মাজা করলেন। অনেক চিন্তাভাবনা, পরিবর্তনের পরে দু’জনের মনে হল এবার মান্নাদাকে গানটা শোনানো যায়। সময়-সুযোগ বুঝে একদিন শোনানোও হল। কিন্তু গানটা শুনে মান্নাদার প্রথম রিঅ্যাকশন—‘‘কফি হাউসের ক্যারেক্টাররা এখন কী করছে, তাতে শ্রোতাদের কী ইন্টারেস্ট? এ গান তারা শুনতে চাইবে কেন?’’ সুপর্ণকান্তি শুধু বললেন, ‘‘ঠিক আছে, আপনার যদি ভাল না লাগে, তাহলে গান গাইবেন না।’’
এ গেল এ গানের প্রথম পর্ব। কিন্তু কথা-সুর তো মাথায় ঢুকে গেছে। কিছু দিন পরেই দ্যাট ‘নো’ বিকেম ‘ইয়েস’। তখন গানটি সাগ্রহে গাইলেন মান্নাদা। ২০০২ সালে প্রকাশিত হল ‘স্বপ্নের কফি হাউস’। কথা-সুর-গায়কিতে অপূর্ব হয়েছিল সেই গান। প্রচারের অভাবে সে-গানের কথা অনেকে জানতেই পারেনি। যে-গান মান্নাদা প্রথমে গাইতে চাননি, পরবর্তীকালে সে-গান সম্পর্কে কী বলছেন মান্নাদা? ২০১৩-র ১ মে। মান্নাদার জন্মদিন। এবারের জন্মদিনটা বড়ই বেদনার। এই প্রথম জন্মদিনে ম্যাডাম নেই। সূপর্ণকান্তি পৌঁছে গেলেন মান্নাদার বেঙ্গালুরুর বাড়িতে। প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে মান্নাদাও খুব খুশি। দুপুরে একসঙ্গে খাওয়া হল। ডিনার সেরে সূপর্ণকান্তি যখন হোটেলে ফিরবেন, সে সময় মান্নাদা তাঁকে দিলেন এক দুর্মূল্য উপহার। নিজের থেকেই বললেন, ‘‘খোকা, তোমার স্বপ্নের কফি হাউসের কোনও জবাব নেই। জীবনে অনেক গান তো গাইলাম। এই গানটা আমার অত্যন্ত ভাললাগা একটা গান। ওয়ান অব দ্য বেস্ট সঙস দ্যাট আই হ্যাভ সাঙ ফর ইউ।’’
সঙ্গীতজীবনের শেষ দিকে মান্নাদার প্রচলিত কথায় একটি অসাধারণ ভক্তিগীতির অ্যালবাম করেছিলেন। ‘করুণাসিন্ধু’ (অডিয়ো), ‘জুড়াইতে চাই’ (অডিয়ো)। সঙ্গে গেয়েছিলেন সুদেব দে। এই অ্যালবামটি তৈরির সময় এক অন্য মান্না দে-কে চেনা। কমলাকান্তের বিখ্যাত রচনা ‘সদানন্দময়ী কালী’ সুর করলেন সুদেব। খুব ইচ্ছে মান্নাদাকে দিয়ে গানটি গাওয়ানো। সুর বাঁধলেন মান্নাদার প্রিয় রাগ ভৈরবীতে (মান্নাদা বলতেন ভৈরবী আর ইমন— এই দু’টো রাগ ভাল করে শিখলে গান-বাজনার অনেক কিছু শেখা যায়। ঝাঁপতালে সুর করলেন আরও একটি বিখ্যাত গান— ‘তুমসে হমনে দিল কো লগায়া।’ স্বামী বিবেকানন্দর অত্যন্ত পছন্দের গান। ইমনকল্যাণের ছায়ায় গানটি নতুন সুরে বাঁধলেন সুদেব। অতি ভয়ে ভয়ে কাকা মান্না দে-কে একদিন ফোনে জানালেন মনের কথা। কী বললেন মান্নাদা? প্রথমেই একটি বিষয় পরিস্কার করে দিলেন, সুর দু’টো পছন্দ হলেই গাইবেন, এখানে আত্মীয়তার কোনও ব্যাপার নেই। অতএব ফোনে যা শোনালে শোনালে, গানগুলো পাঠাও। গান শুনে পছন্দ হল। এবার বললেন একটি অসাধারণ কথা। সুদেবকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘কী ভাবে তুমি সুর করলে?’ সুদেব বলল, ‘জানি না’। মান্নাদা খুশি হয়ে বললেন, ‘দ্যাটস রাইট। অত জেনেশুনে সুর করা যায় না। ‘সদানন্দময়ী কালী’ গানে এক জায়গায় ‘মা’। কথাটাতে আপার অকটেভে বিস্তার করে মধ্যমে অনেকটা দাঁড়ানো ছিল। মান্নাদার তখন পঁচাশির বেশি বয়স। অবাক হওয়ার ব্যাপার। রেকর্ডিংয়ের সময় সবাই অবাক হয়ে দেখল কী অসাধারণ ইম্প্রোভাইজেশনে মান্নাদা ওই কঠিন জায়গাটা সহজ করে নিলেন।
সুদেব টিপস চাইলেন মান্নাদার কাছে। মান্নাদা বললেন, ‘‘ঠিক আছে। অ্যালবামে যে-গানগুলো গাইবে, তা-ই শোনাও। সুদেব প্রথমে গাইলেন— ‘গয়া-গঙ্গা-প্রভাসাদি’। মান্নাদা শুনলেন। তার পর বললেন, ‘‘‘জোয়ারি’ গানের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ঠিক। কিন্তু গানের ভাব, সুর অনুযায়ী কতটা জোয়ারি প্রয়োজন, দ্যাট সিলেকশন ইজ মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট।’’ তার পর একটি অত্যন্ত মূল্যবান কথা বললেন, ‘‘ভাল করে গান গাইবার জন্য রাগটা শেখা দরকার, জানা দরকার। কিন্তু গায়কির ভিতরে রাগটিকে দেখানোর চেষ্টা কোরো না। রাগটিকে ব্যবহার করো গানে মিষ্টতা আনার জন্য, গানকে আরও মিনিংফুল করার জন্য।’’
যেটা বলার, মান্নাদা এ-ভাবেই বলবেন। মান্নাদাকে একটা গান দিয়েছিলাম— ‘যে গানে আমি অমর হব/ হয়নি সে-গান গাওয়া।’ মান্নাদা গানটা পড়ে বললেন, ‘‘অমরত্বের কথা জানি না। তবে বেশ কিছু ভাল গান আমি গেয়েছি, যা মানুষ মনে রাখবে। আই ডোন্ট লাইক কনটেন্টস অব দিজ লিরিক। তবে আপনার অন্য লেখাটি আমার ভাল লেগেছে। মান্নাদা পাতাটা বের করে পড়লেন— ‘যত দিন গোলাপের গন্ধ আছে/ যত দিন নুপূরের ছন্দ আছে/ তত দিন আমি যেন গাইতে পারি/ কণ্ঠে যেন সুর চাইতে পারি।’
হ্যাঁ, মান্নাদা এইটুকুই চেয়েছিলেন। গানই তাঁর জীবন। গান শেষ হয়ে গেলে জীবনের আর কিছু থাকে না।