অনুপম রায়। ছবি: সংগৃহীত।
প্রশ্ন: ১৪ বছর কাটিয়ে ফেলেছেন ইন্ডাস্ট্রিতে। নিজের মধ্যে ও ইন্ডাস্ট্রিতে কী কী বদল দেখলেন?
অনুপম: নিজের মধ্যে কিছু বদল এসেছে। আগের থেকে পরিণত হয়েছি। বিশেষ করে গান লেখার ক্ষেত্রে আগের থেকে পরিণতিবোধ বেড়েছে। লেখা, সুর ও গান গাওয়া— এই তিনটি নিয়েই তৈরি আমার কর্মক্ষেত্র। এর মধ্যে গান গাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি উন্নত হয়েছে। আমার কাছে মূল লক্ষ্যই হচ্ছে নিজেকে উন্নততর করে তোলা। সফট্ওয়্যার আপডেটের মতোই নিজেকে উন্নত করতে চাই।
দ্বিতীয়ত, ইন্ডাস্ট্রিতে তো বহু বদল এসেছে বটেই। আগেকার ছবিতে গানের সংখ্যা অনেক বেশি থাকত। এখন অনেকটা কমে গিয়েছে। একটা সময় যে গানগুলিকে ব্যতিক্রমী হিসাবে মনে করা হত, সেগুলিও কিন্তু মূলধারার গান হিসাবে আজ গণ্য করা হয়।
প্রশ্ন: আপনি তো স্বাধীন ভাবেও বহু গান তৈরি করেছেন। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা কি ছবিতে ব্যবহৃত গানের থেকে অনেকটাই কম?
অনুপম: একদমই তাই। আমি নিজেও সেটাই বিশ্বাস করি। আমার পাঁচটা ‘সোলো অ্যালবাম’ রয়েছে। কিন্তু সেই গানগুলি জনপ্রিয় নয়। তবে দেখা গিয়েছে, সেই অ্যালবাম থেকেই কোনও গান ছবিতে ব্যবহার করার পরে তা জনপ্রিয় হয়েছে। যেমন— ‘আমি আজকাল ভাল আছি’, ‘ফাঁকা ফ্রেম’। আসলে মিউজ়িক ভিডিয়ো তৈরি করলেও ছবির মতো বাজেট থাকে না। তা ছাড়া ছবিতে দৃশ্যায়নের তো একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। গানের মধ্যে থাকা গল্প মানুষের বুঝতে সুবিধা হয়।
প্রশ্ন: আপনি তো মানুষ হিসাবে শান্ত, ধীর। মঞ্চে অনুপম রায় কী ভাবে শ্রোতাদের ধরে রাখেন?
অনুপম: আসলে মানুষের মধ্যে দুটো সত্তা থাকে। আমার মধ্যেও দু’রকম সত্তা রয়েছে। ক্ষেত্র বিশেষে আমি অন্তর্মুখী আবার বহির্মুখীও। যাকে বলে ‘অ্যাম্বিভার্ট’। মঞ্চে আমি বহির্মুখী। আমি খেলাধুলো করতে ভালবাসি। খেলার মাঠে শান্ত থাকলে তো চলবে না। সেখানে যথেষ্ট চেঁচামেচি, ছোটাছুটি করি। মঞ্চেও এই রূপটাই প্রকাশ পায়।
প্রশ্ন: ৩ নভেম্বর আপনার কনসার্ট ‘তারার মতো জ্বলব’। যন্ত্রানুসঙ্গ শিল্পীদের সঙ্গে মঞ্চে বোঝাপড়া কেমন থাকে?
অনুপম: মঞ্চে আমার মোট পাঁচজন থাকি। আমি, নবারুণ, ঋষভ, কৌস্তুভ, সন্দীপন। ওদের সঙ্গে আমার ১৪ বছরের সম্পর্ক। আমরা এখন পরিবারের মতো হয়ে গিয়েছি। সেই সমীকরণের প্রতিফলন মঞ্চেও থাকে। আমি ডানদিকে গেলে কী করব ওরা জানে, বাঁদিকে গেলে কী করব সেটাও জানে। এই অনুষ্ঠানে যদিও আরও তিন জন— রাতুল শঙ্কর, প্রত্যুষদা ও সৌপ্তিক থাকবেন। এ ছাড়া বৈদেহীর তত্ত্বাবাধনে তিন জন মহিলা কণ্ঠশিল্পী থাকছেন।
প্রশ্ন: অনেকেই মনে করেন প্রতিভাই যথেষ্ট নয়। গানের জগতে এগিয়ে যেতে তা হলে কিসের প্রয়োজন?
অনুপম: প্রতিভা থাকলে অবশ্যই ভাল শিল্পী হয়ে ওঠা যায়। তবে ভাল শিল্পী ও জনপ্রিয় শিল্পীর মধ্যে তফাৎ রয়েছে। ভাল হলেও কেউ জনপ্রিয় না-ই হতে পারেন। আবার উল্টোটাও হয়। তবে হ্যাঁ, গান গাওয়ার প্রতিভার সঙ্গেও আরও বেশ কিছু বিষয় দরকার পড়ে। যেমন, একজন গুণী শিল্পী কিন্তু, তাঁর সময় জ্ঞান নেই। তা হলে সে ক্ষেত্রে কিন্তু তাঁর পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রশ্ন: অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রায়ই স্বজনপোষণের প্রসঙ্গ উঠে আসে। বাংলা গানের জগতেও কি এ সব হয়?
অনুপম: স্বজনপোষণ সর্বত্র রয়েছে। বহু পরিচালক নির্দিষ্ট সঙ্গীত পরিচালকের সঙ্গেই কাজ করে থাকেন। তাঁদের কাজ হয়তো একের পর এক অসফল। কিন্তু তার পরেও পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বের জায়গা থেকে কাজ করছেন। এমন বহু সঙ্গীত পরিচালক-গায়ক জুটিও রয়েছেন। বছরের পর বছর ফ্লপ কাজ করলেও তাঁরা একসঙ্গে কাজ করছেন। আসলে বড় ইন্ডাস্ট্রিতে আবার এই ধরনের কাজ হয় না। বম্বেতে এটা কেউ করে উঠতে পারবে না। বাংলায় এগুলো হয়। আসলে এখানে কোনও বিনিয়োগ নেই। তাই আর একটা ফ্লপ হলেও কিচ্ছু যায় আসে না।
প্রশ্ন: অনেকেই বলেন, কলকাতায় সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে পরিচিতি পেতে গেলে জোট বেঁধে আড্ডা মারতে হয়। তথাকথিত ‘সার্কিট’-এ নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করতে হয়। অন্য দিকে মুম্বইতে গুণের ভিত্তিতেই কাজ পাওয়া যায়। আপনি কী মনে করেন?
অনুপম: এটা আমি বিশ্বাস করি না। ব্যক্তিগত উদাহরণ দিচ্ছি। ইমনের সঙ্গে কিন্তু কোনও দিন তেমন আড্ডা দিইনি। সোমলতার সঙ্গে অনেক বেশি কথা হয়। কিন্তু ইমনই আমার সঙ্গে বেশি কাজ করেছে। অনিন্দ্যদার সঙ্গে বহু আড্ডা দিয়েছি। কিন্তু আমার সুরে ওঁর মাত্র একটা গান। অন্য দিকে রূপমদার সঙ্গে আড্ডা তেমন দিইনি। কিন্তু বহু কাজ করেছি। আড্ডা দেওয়ার সঙ্গে কাজের যোগ থাকলে, তা খুবই অপেশাদার। আমি এমন অপেশাদার কাজ করি না।
প্রশ্ন: আপনি একাধারে, গায়ক, গীতিকার ও সুরকার। নিজেকে কোন ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দক্ষ মনে হয়?
অনুপম: আসলে নিজের বিচার নিজে করা খুব কঠিন কাজ। আমি কোন কাজটা করতে সবচেয়ে ভালবাসি, সেটা বলতে পারি। আমি সবচেয়ে ভালবাসি গান বাঁধতে। গান বাঁধা মানে লেখা ও সুর একসঙ্গে। লেখা ও সুর একসঙ্গে তৈরি করার পদ্ধতিটা আমাকে আনন্দ দেয়। তবে মাথায় ডেডলাইন-এর চাপ থাকলে অতটাও আনন্দ পাই না (হেসে)।
প্রশ্ন: পুজোতে দুটো সফল ছবি ‘বহুরূপী’ ও ‘টেক্কা’য় একসঙ্গে কাজ করলেন। ‘বহুরূপী’তে আপনার পরিচালনায় শ্রেয়া ঘোষাল গাইলেন। ‘টেক্কা’য় রণজয় ভট্টাচার্যের পরিচালনায় আপনি প্লেব্যাক করলেন। কোন ছবিতে নিজেকে একটু এগিয়ে রাখছেন?
অনুপম: প্লেব্যাক আমি করি ঠিকই। তবে, আমার সত্তাটা কিন্তু একজন গীতিকার ও সুরকারের। আমার কাছে গান মানে শুধু কণ্ঠ নয়। সুর, কথা, আয়োজন সবটা মিলে গান। একটা গানের পুরো নিয়ন্ত্রণ আমার হাতে থাকলে আমি সবচেয়ে আনন্দ ও তৃপ্তি পাই। সেই দিক থেকে দেখলে আমি ‘বহুরূপী’র সঙ্গে আমি বেশি যুক্ত। কারণ ওই গানটার পিতা-মাতা আমিই। কিন্তু প্লেব্যাকের ক্ষেত্রে আমার গানটার সঙ্গে হয়তো যোগ কম। হয়তো সেই গানটার কথা আমি নিজেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমি পেশাদার। সেই হিসাবে আমার ১০০ শতাংশ দিয়েই প্লেব্যাকটাও করেছি।
প্রশ্ন: আচ্ছা, বর্তমানে কি সঙ্গীতশিল্পী হিসাবে পরিচিতি পাওয়ার অন্যতম মঞ্চ সমাজমাধ্যম?
অনুপম: আমি তেমন মনে করি না। পরিচিতি পাওয়ার জন্য সঙ্গীতই সবচেয়ে বড় মূলধন।
প্রশ্ন: আপনি রিয়্যালিটি শো-এর পদ্ধতিতে বিশ্বাস করেন?
অনুপম: গানের প্রতিযোগিতা বহু যুগ ধরে চলে আসছে। পাড়া, স্কুল, রাজ্যে নানা প্রতিযোগিতা হয়েছে। তবে আগে প্রতিযোগিতার মূল লক্ষ্য ছিল, প্রতিভা খুঁজে বার করা। কিন্তু এখন এর সঙ্গে বিনোদন জড়িয়ে গিয়েছে ও বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। এই অনুষ্ঠানগুলি থেকে অর্থ উপার্জন করাও একটা বিশেষ উদ্দেশ্য। একটা গোটা ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে প্রতিযোগিতার উপর নির্ভর করে।
প্রশ্ন: এই মুহূর্তে বহু স্বাধীন ব্যান্ড ও শিল্পী রয়েছেন কলকাতায়। কিন্তু সেই ভাবে কেন পরিচিতি তৈরি করতে পারছেন তাঁরা?
অনুপম: আসলে প্রত্যেককে স্বতন্ত্র হতে হয়। প্রচুর শিল্পী ছিলেন বাংলায়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মান্না দে, মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়— প্রত্যেকের নিজস্বতা রয়েছে গায়কিতে। আবার সুধীন দাশগুপ্ত, নচিকেতা ঘোষ, শচীন দেব বর্মন, রাহুল দেব বর্মন— এঁদের সুরেও নিজস্বতা রয়েছে। নব্বইয়ের দশকেও সুমন-নচিকেতা-অঞ্জন-শিলাজিৎ এঁরা প্রত্যেকে একে অপরের থেকে আলাদা। ব্যান্ডের জগতেও চন্দ্রবিন্দু, ভূমি, ক্যাকটাস ও ফসিলস্ নিজেদের জায়গায় স্বতন্ত্র। ইমন, লগ্নজিতা ও সোমলতার কণ্ঠেও নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
প্রশ্ন: এ বার একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। বিয়ের পরে প্রথম পুজো আপনার ও প্রস্মিতার। কেমন কাটালেন?
অনুপম: পুজো ভালই কেটেছে। তবে আমি ছিলাম বম্বেতে। প্রস্মিতা ছিল আমেরিকায়। তাই একসঙ্গে সময় কাটানো হয়নি।
প্রশ্ন: আপনার পরিচালনায় প্রস্মিতাকে সেই ভাবে গাইতে শোনা যায় না। ভবিষ্যতে পরিকল্পনা রয়েছে?
অনুপম: প্রথম থেকেই বলছি পেশাদার হওয়া জরুরি। আমরা স্বামী-স্ত্রী হিসাবে একসঙ্গে থাকি। একসঙ্গে গান বাঁধব বলে ঘর বাঁধিনি। ব্যক্তিগত জায়গায় আমরা পরস্পরকে পছন্দ করি। এর সঙ্গে পেশাকে গুলিয়ে ফেললে সমস্যা আছে। আমি পরিচালক। যদি মনে হয়, কোনও গানে ওর কণ্ঠ মানানসই হবে, তবে অবশ্যই একসঙ্গে কাজ করব।
প্রশ্ন: প্রস্মিতা ও আপনি দু’জনই শান্ত। দু’জনের অধিকাংশ সময়ই কি গানের মধ্যে কাটে?
অনুপম: গান বাজনা নিয়ে সারাদিন আলোচনা হয়। তবে এ ছাড়াও আমাদের আলোচনার নানা বিষয় রয়েছে। প্রস্মিতা কিন্তু মানুষের সঙ্গে মিশতে ও আনন্দ করতে খুব ভালবাসে। আমি খুবই ঠান্ডা প্রকৃতির। ও সেই তুলনায় অনেক প্রাণবন্ত। দু’জনে একসঙ্গে থাকতে ভালই লাগে।
প্রশ্ন: দু’জনকে একসঙ্গে মঞ্চে দেখা যাবে?
অনুপম: এটাও সময়ই বলবে।
প্রশ্ন: মুম্বইয়ে আবার কাজ করছেন?
অনুপম: সামনেই একটি ছবি মুক্তি পাচ্ছে। নাম ‘ঢাই অক্ষর’। সামনের সপ্তাহেই মুম্বই যাব। মূল ধারার ছবি নয়। ৮ নভেম্বর মিউজ়িক লঞ্চ। ছবিও নভেম্বরে মুক্তি পাবে।
প্রশ্ন: গানের জগতে আপনার অনুপ্রেরণা কারা?
অনুপম: গায়কির দিক থেকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে খুব পছন্দ করি। নব্বইয়ের দশকে নচিকেতার গান না শুনলে আমি কী ভাবে এগোতাম জানি না। পরবর্তী কালে বাংলা আধুনিক গান লেখার ক্ষেত্রে চন্দ্রবিন্দু আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। বাংলায় লেখা কথা বলে, পৃথিবীতে খ্যাতি পায়নি চন্দ্রবিন্দু। ঠিক করে অনুদিত হলে ভারতে সর্বশ্রেষ্ঠ গীতিকার জুটির খ্যাতি পাবেন অনিন্দ্য-চন্দ্রিল।
প্রশ্ন: নিজের কোন গান সবচেয়ে বেশি পছন্দ ও অপছন্দ?
অনুপম: নিজের সবচেয়ে পছন্দের গানটা এখনও লিখে উঠতে পারিনি। প্রত্যেক গানেই মনে হয় কিছু ত্রুটি রয়ে গিয়েছে। তবে আমার কাছে ‘বোবা টানেল’-এর পূর্ণতা রয়েছে। যদিও সেই গানেও ত্রুটি রয়েছে। আর অপছন্দের গানের তালিকা দীর্ঘ। এখন মনে হয়, গানগুলি মুক্তি না পেলেই ভাল হত। তাই উল্লেখ করতে চাই না আর। মানুষ ভুলে গিয়েছে। সাগরের তলায় তলিয়ে গিয়েছে। তাই থাক না!