Exclusive celebrity interview

‘হাতোড়া ত্যাগীর নেপথ্যের মানুষটাকেও এ বার চিনুক সকলে’, খড়্গপুর থেকে বলিউড, অকপট অভিষেক

‘পাতাললোক’ ওয়েব সিরিজ়ে ‘হাতোড়া ত্যাগী’র চরিত্রে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। কিন্তু, কোথাও গিয়ে কি চরিত্রের পিছনে ঢাকা পড়ে গিয়েছেন তিনি? আনন্দবাজার অনলাইনকে জানালেন অভিষেক।

Advertisement

স্বরলিপি দাশগুপ্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৩ অগস্ট ২০২৪ ১২:১৯
Share:

অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। ছবি: সংগৃহীত।

সামনেই মুক্তি পাচ্ছে তাঁর দু’টি ছবি। ‘স্ত্রী ২’ ছবিতে মজার চরিত্রে আর অন্য দিকে ‘বেদা’তে খলনায়কের চরিত্রে দেখা যাবে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। এই ব্যস্ততার মধ্যেই, খড়্গপুরের সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে বলিউডের সফর নিয়ে কথা বললেন অভিনেতা। শুনল আনন্দবাজার অনলাইন।

Advertisement

প্রশ্ন: একই দিনে মুক্তি পাচ্ছে ‘স্ত্রী ২’ ও ‘বেদা’। দুটো ছবিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের চরিত্রে অভিনয় করেছেন। কেমন কাটছে এই সময়টা?

অভিষেক: কালকেই আমার বাবা আমাকে বললেন, ‘‘তোমার জন্য আমি গর্বিত।’’ দুটো ছবি একসঙ্গে মুক্তি পাচ্ছে, এমন তো সচরাচর হয় না! বাবা খুব কড়া ছিলেন। তিনি কিন্তু আগে এমন কখনও বলেননি। পেশার দিক থেকে শুধু নয়, এটা ব্যক্তিগত স্তরেই বড় সাফল্য আমার কাছে। কোন ছবি কেমন ফলাফল করবে, সেটা তো পরের কথা। কিন্তু, ১৫ অগস্টের মতো দিনে দু’টি ছবি বড় পর্দায় মুক্তি পাচ্ছে — এই জায়গায় যে আমি পৌঁছতে পেরেছি, এটাই আমার কাছে অনেক। খড়্গপুরে জন্ম নিয়েছিল একটা ছেলে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে মুম্বই এসেছিল। তাই এই সময়টা আমার ও আমার পরিবারের কাছে সত্যিই উপভোগ করার মতো। ঈশ্বরের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।

Advertisement

প্রশ্ন: খড়্গপুরের মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম। অভিনয়টাই করতে চান। কী ভাবে সিদ্ধান্ত নিলেন?

অভিষেক: শৈশব থেকেই আমি মানুষকে খুব নকল করতে ভালবাসতাম। বাড়িতে অতিথি এলে, তাঁদের কথা বলার বা হাসির ধরন নকল করতাম। বাড়িতে সকলে বলতেন, গোলা (অভিষেকের ডাকনাম) খুব ভাল নকল করতে পারে। তখন বুঝতাম না, এটাও অভিনয়ের একটা অংশ। স্কুলেও রবিন হুড বা অন্য কোনও নাটক হলে অভিনয় করতাম। এক বার মনে আছে, বনবাসী রামের চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। তখন থেকে উপলব্ধি করি, আমি অভিনয় করতে ভালবাসি। কিন্তু কী ভাবে এগোব, সেটা জানতাম না। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম। কিন্তু দেখলাম, একাদশ শ্রেণিতে পদার্থবিদ্যা আর রসায়ন আমি বুঝতে পারছি না। নম্বরও কম আসছিল। কিন্তু, মঞ্চে সঞ্চালনা বা নাটকে অভিনয় — এই সবে আমার আগ্রহ ছিল। ইংরেজির শিক্ষিকা এক দিন কড়া ভাবে আমায় বললেন, “তোমার দ্বারা অভিনয়টাই হবে। তুমি ওটাই করো।” আমিও বুঝলাম, অভিনয়টাই আমার করা উচিত।

প্রশ্ন: তার পর?

অভিষেক: তার পরে থিয়েট্রিকাল কলেজে অভিনয় প্রশিক্ষণ নেওয়া শুরু করলাম। দূর থেকে আমি অমিতাভ বচ্চনকে গুরু মানতাম। তিনি আমার দ্রোণাচার্য। ঠিক করলাম ওঁর কলেজেই ভর্তি হব। জানতে পারলাম, ওখানে থিয়েটার কোটা রয়েছে। আমি অডিশন দিলাম। থিয়েটার শুরু করার পরে ঠিক করে নিলাম, মুম্বই আমাকে যেতেই হবে। তার পর থেকে তো ১৪-১৫ বছর কেটে গেল।

প্রশ্ন: অভিনেতা হতে পারবেন, এই আত্মবিশ্বাস ছিল?

অভিষেক: আমি আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু কী ভাবে ছিলাম, তা আমি বলে বোঝাতে পারব না। কলেজ পাশ করার এক বছর পরে আমি মুম্বই আসি। তখন আমার ২২ বছর বয়স। তখনও ভয়েস ওভার দেওয়া ও আরও কিছু কাজ করেছিলাম। তখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি। বাবার বদলির চাকরি ছিল। তাই আমিও নিজেকে বলতাম, একটা আলাদা শহরে গিয়ে থাকব, নতুন বন্ধুবান্ধব হবে, মানুষ চিনব... দেখব, কী হয়। অভিনয়ের জন্যই যাচ্ছি, এটা মনে করতাম না। বহু মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যান পেয়েছি সেই সময়ে। কষ্টও হয়েছে। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান আমি। ওঁদের থেকে দূরে থাকতে কষ্টও হত। ওঁরা খুবই চিন্তা করতেন। খুব সাধারণ সরকারি চাকরিজীবী ঘরের ছেলে আমি। এমন নয় যে, ওঁরা অনেক টাকা পাঠাতে পারতেন আমাকে। তবে যেটুকু পাঠাতেন আর আমি যেটুকু রোজগার করতাম, তাতেই কষ্ট করে মুম্বইয়ে থেকেছি। জানতাম, এক দিন আমি অভিনেতা হবই। যদিও সেই এক দিনটা কবে আসবে, আমি জানতাম না। আসলে, শুধু স্বপ্ন দেখলে চলবে না। তার সঙ্গে কঠোর পরিশ্রমও করতে হবে।

প্রশ্ন: অভিনেতা, না কি তারকা? ভবিষ্যতে নিজের নামের আগে কোনটা চাইবেন?

অভিষেক: যে কোনও বড় তারকাকেই আগে ভাল অভিনেতা হতে হয়। স্টারডম তো গোটা জীবন জুড়ে থাকে না। কিন্তু অভিনেতার তকমা কিন্তু সারা জীবন থেকে যায়। অভিনেতাকে যে পরিমাণ সম্মান দেয় মানুষ, তা কি এক জন তারকাকে দেয়? বলা ভাল, এক জন অভিনেতাকেই কিন্তু পরে তারকার সম্মান দেওয়া হয়। দিলীপ কুমার, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান বা সলমন খান, এঁদের প্রত্যেককেই কিন্তু অভিনয়টা করতে হয়েছে। না হলে ওঁরা তারকা হতে পারতেন না। ‘আনন্দ’-এ তো বচ্চনজি মূল অভিনেতা ছিলেন না। ‘ডর’-এ নায়ক ছিলেন সানি দেওল, শাহরুখ নন। অভিনেতাদের তারকা বানিয়ে তোলেন দর্শকই। তবে, অভিনেতা তকমার মেয়াদ অনেক বেশি।

প্রশ্ন: কাস্টিং পরিচালকের কাজ করতে করতে অভিনয়...

অভিষেক: মুম্বই আসার পরে ভাবলাম, কী করব? এমন কিছু করব, যাতে বাবা-মায়ের থেকে আর টাকা চাইতে না হয়। গৌতম কিশান চন্দানি তখন ‘দেব ডি’ ছবির কাস্টিং করছিলেন। আমাকে ওঁর সঙ্গে কাজ করতে বললেন। মুম্বইতে চাকরি পাচ্ছি, এর থেকে ভাল আর কী হয়! এই কাজ করতে করতেই অভিনেতা হয়ে গেলাম। তবে ওই যে বললাম, পরিশ্রম করে যেতে হবে।

প্রশ্ন: নতুনদের মধ্যেও কাদের কাস্টিং করলেন?

অভিষেক: অনেকে রয়েছেন। সিদ্ধান্ত চতুর্বেদী, ভামিকা গাব্বি, সিদ্ধান্ত গুপ্ত, অবিনাশ তিওয়ারি, মিথিলা পালকর, জ়িশান আয়ুব। তৃপ্তি ডিমরিকেও ‘বুলবুল’, ‘কলা’তে কাস্টিং করেছিলাম। বহু বার বলেছিলাম, মেয়েটা খুব ভাল অভিনয় করে। আমি নিজে অভিনয় করি বলেই ভাল অভিনেতাদের সব সময় এগিয়ে নিয়ে যেতে পছন্দ করি।

প্রশ্ন: মনে হয়, আপনার কাছে আরও ভাল কাজের প্রস্তাব আসা উচিত?

অভিষেক: ‘স্ত্রী ২’ বা ‘ভেদা’র মতো ছবিতে কাজ করছি। এই পরিস্থিতিতে তো ভালই করছি। এই ছবিগুলো সফল হলে, পরিচালকেরা এমন অথবা এর চেয়েও বড় কাজের প্রস্তাব দেবেন বলে আমি নিশ্চিত। ‘স্ত্রী’ ছবিতে আমার অভিনয় দেখেই অন্য কাজে পরিচালকেরা আমাকে নিয়েছেন। আমি আমার কাজ করে যাচ্ছি। এ বার তাঁদের পালা। তবে আমার তরফে কোনও অভিযোগ বা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার ব্যাপার নেই।

প্রশ্ন: অভিনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের থেকে মানুষ ‘হাতোড়া ত্যাগী’কে বেশি চেনেন। আক্ষেপ হয়?

অভিষেক: হ্যাঁ, কখনও আক্ষেপ হয়। সেই জন্যই জনসংযোগের দরকার (হাসি)। ‘হাতোড়া ত্যাগী’র পিছনে কোন অভিনেতা রয়েছেন, সেটা মানুষের জানা উচিত। এর জন্য সংবাদমাধ্যমকে আমাদের প্রয়োজন। আমি আগে সাক্ষাৎকার বেশি দিতাম না। কিন্তু এক জন বললেন, এটা শো-বিজ়। তাই চরিত্রের সঙ্গে মানুষ যাতে এ বার আমাকেও চেনেন, সেই চেষ্টাই করছি। তবে এমন অভিনেতাও তো রয়েছেন, যাঁদের কোনও চরিত্রের নামই মানুষের মনে নেই। তাই ‘পাতাললোক’-এর ‘হাতোড়া ত্যাগী’ বলে যখন মানুষ ডাকেন, সেটা কিন্তু আমি প্রবল ভাবে উপভোগও করি।

প্রশ্ন: বলিউডে এসে নিজেকে বহিরাগত বলে মনে হয়নি?

অভিষেক: হ্যাঁ। বাইরে থেকে এলে তো সেই অর্থে কোনও সাপোর্ট সিস্টেম থাকে না। একটু সাবধানি থাকতে হত। সতর্ক থাকতে হত, যাতে আমার কথায় কেউ চটে না যায়। বাইরে থেকে আসার পরে আমার কথায় কারও ‘ইগো’য় আঘাত লাগুক, এমন চাইনি। এমন কিছু ঘটে গেলে কিন্তু আমি পরে সামাল দিতে পারতাম না। যাঁরা এই জগতেরই ছেলেমেয়ে, তাঁদের কাছে সেই সুযোগ থাকে। কিন্তু বহিরাগত হিসেবে আমি এক বার ভুল করলে কি দ্বিতীয় সুযোগ পাব? এটা মাথায় থাকত। তাই আমাদের আরও একটু বেশি সচেতন থাকতে হয়, কারণ, ভুল করার কোনও সুযোগ নেই।

প্রশ্ন: কলকাতায় তো বেশ কিছু দিন থেকেছেন। এখন বাংলা ছবির ইন্ডাস্ট্রিকে দেখে কী মনে হয়?

অভিষেক: সত্যি কথা বলতে, জানি না বাংলা ইন্ডাস্ট্রি কী ভাবে চলছে। আমি বাংলা ছবি থেকে তেমন কোনও প্রস্তাবও পাইনি। আমি নিজেও কিন্তু বাংলা ছবি করতে চাই। আমি হিন্দি ছবি করি বলেই কি বাংলার পরিচালকেরা আমাকে প্রস্তাব দেন না? হয়তো বহু পরিচালক ভাবেন, বাজেট কম বলে করব না। কিন্তু অভিনেতারা তো শুধুই টাকার জন্য কাজ করেন, এমন নয়। তাঁরা চরিত্র ও গল্প দেখে কাজ করেন। আমি একজন বাঙালি হিসেবে আশা করছি, বাংলায় কাজ নিশ্চয়ই করব।

প্রশ্ন: আপনি তো অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষায় ছবি করছেন..

অভিষেক: হ্যাঁ আমি তো তামিল, তেলুগু ছবিতে কাজের প্রস্তাব পাই। কিন্তু বাংলায় এখনও পর্যন্ত তেমন কোনও প্রস্তাব পাইনি। একমাত্র সৃজিতদা (সৃজিত মুখোপাধ্যায়) আমাকে বলেছিলেন একটা ছবির কথা। দুর্ভাগ্যবশত আমি সময়ের জন্য কাজটা করতে পারিনি। কিন্তু সত্যিই আমি সৃজিতদা, কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো পরিচালকদের জন্য কাজ করতে চাই। বাংলা ছবিতে কাজ না করলে আমার অভিনয়ের সফর অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।

প্রশ্ন: কাজের মধ্যে স্ত্রী ও পরিবারকে সময় দেন কী ভাবে?

অভিষেক: কাজ ও পরিবারের মধ্যে সমতা বজায় রাখা সত্যিই কঠিন। আমি তা-ও রোজ পরিবারের সঙ্গে কিছুটা সময় কাটানোর চেষ্টা করি। খারাপ লাগে, পরিবার আমাকে বেশি পায় না। ‘রং দে বসন্তী’ ছবিতে আমার একটা সংলাপ ছিল—‘মেরি দুলহন তো আজ়াদি হ্যায়’। পরিবারকে তাই বলি, এখন আমার ‘দুলহন’ হল অভিনয়। কয়েক বছর অভিনয়েই মনোযোগ দিতে চাই। এর মধ্যেই স্ত্রীর সঙ্গে সময় কাটাই। ওর সঙ্গে বেড়াতে যেতে খুব ভাল লাগে। বাবা-মাও প্রতি বছর আসেন। দু’-তিন মাস থেকে যান। ওঁরা বলেছিলেন, মুম্বইয়ে এসে থাকবেন। সেই মতো একটা বাড়ি কিনলাম। কিন্তু শেষে ওঁরা এলেন না (হেসে)। ওঁরা খড়্গপুরেই আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে থাকতে চান। আসলে কায়দা করে আমাকে দিয়ে ওঁরা বাড়িটা কেনালেন। তবে পরিবারের সমর্থন ছাড়া আমি কিছুই করতে পারতাম না। আর এত ভালবাসা আমি আর কোথাও পাব না। এটা আমার কাছে অমূল্য সম্পদের মতো।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement