কমেডি প্রসঙ্গে কী বললেন সৌরভ পালোধী, অঙ্কুশ হাজরা, ঝিলম গুপ্ত, কিরণ দত্ত। গ্রাফিক: আনন্দবাজার অনলাইন।
রণবীর ইলাহাবাদিয়া ও সময় রায়নাকে নিয়ে সমাজমাধ্যম সরগরম। প্রথম জন পরিচিত ইউটিউবার হিসেবে। দ্বিতীয় জন পেশায় কৌতুকশিল্পী। তবে সময় রায়নার অনুষ্ঠান ‘ইন্ডিয়া’জ় গট ল্যাটেন্ট’-এর কৌতুক অনেক সময়েই আমজনতার কাছে তথাকথিত শালীনতার সীমা ছাড়ায়। যদিও সেই অনুষ্ঠানেরও নির্দিষ্ট দর্শক রয়েছেন, যাঁরা এই অনুষ্ঠান করতালিতে ভরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ছিল যথেষ্ট। কিন্তু ছন্দপতন হয় অনুষ্ঠানে বিচারকের আসনে রণবীর ইলাহাবাদিয়া আসার পরে। এক প্রতিযোগীকে তিনি বলে বসেন, “বাবা-মাকে সঙ্গম করতে দেখবে, না কি নিজেও এক বার যোগ দিয়ে তাঁদের সঙ্গম স্থায়ী ভাবে বন্ধ করতে উদ্যত হবে?” সেই মন্তব্য শুনেও অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন। সাধারণ ‘রোস্টিং’ হিসেবেই ধরে নেওয়া হয়েছিল সেই মন্তব্যকে। কিন্তু সেই এপিসোড সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তেই রে রে করে উঠেছে মানুষ। প্রকাশ্যে ক্ষমাও চেয়েছেন রণবীর। স্পষ্ট জানিয়েছেন, তিনি ‘কমেডি’-তে একেবারেই আনাড়ি। এটা তাঁর বিষয়ই নয়। তা-ও উল্লিখিত এই অনুষ্ঠানের শালীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে বিভিন্ন মহলে। ‘রোস্টিং’ বা কাউকে তীব্র ব্যঙ্গ করার সময় শালীনতার সীমা কী ভাবে নির্ধারিত হবে, তা নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। কী ভাবছে কলকাতা, খোঁজ নিল আনন্দবাজার অনলাইন।
অভিনয় ও পরিচালনার পাশাপাশি ‘স্ট্যান্ড আপ কমেডিয়ান’ হিসাবেও সৌরভ পালোধী পরিচিত। তিনি বলেছেন, “কমেডির জন্য দু’-একটা খারাপ শব্দ ব্যবহার হতেই পারে। তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু বহু ক্ষেত্রে এখন দেখা যায়, খারাপ কথা বা গালাগালি দেওয়াকেই কমেডি বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে। এখানে আমার আপত্তি রয়েছে।” সময় রায়নাকে নিয়েও সৌরভ মন্তব্য করেন, “সময় রায়নার ‘কনটেন্ট’ থেকে অপশব্দগুলি বাদ দিলে তার মধ্যে হাস্যরসের কিছুই প্রায় অবশিষ্ট থাকে না। সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে অনুভব সিংহ বাসসি, অভিষেক উপমন্যু, মুনাওয়ার ফারুকিকে দেখেছি অন্য রকম। ওঁদের ‘কনটেন্ট’-এও দু’-তিনটি অপশব্দ থাকছে। কিন্তু সেটা কমেডির খাতিরেই ব্যবহৃত হচ্ছে। তবে সময় রায়না পরিবার-পরিজন তুলে এনে বলেন। গালিগালাজই যেন প্রধান হয়ে উঠেছে।”
২০২৪-এ একটি রোস্ট শো-তে যোগ দিয়েছিলেন সৌরভ। অনুষ্ঠানে ছিলেন অভিনেতা অঙ্কুশ হাজরাও। পারস্পরিক সম্মতিতে চলেছিল ব্যঙ্গ-কটাক্ষ। সেই প্রসঙ্গে সৌরভ বলেন, “কিছু দিন আগেই আমরা একটা রোস্ট শো করেছিলাম। আমাকে রোস্ট করা হয়েছে। আবার অঙ্কুশকে আমি রোস্ট করেছি। কিন্তু সেটা করে আমরা দারুণ আনন্দ পেয়েছিলাম। কিন্তু কোথাও গিয়ে একটা সীমা তো রয়েছে। আর যাঁকে রোস্ট করছি, তিনি আমার সামনে বসে রয়েছেন। সম্মতি নিয়েই আমরা পরস্পরকে রোস্ট করেছিলাম। নোংরামি করার জন্য কমেডি করব, এটা বোধহয় বন্ধ হওয়া উচিত।”
সামনে বসে সেই অনুষ্ঠানে নিজের ব্যঙ্গ শুনেছিলেন অঙ্কুশ। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বলেছেন, “আমাদের অনুষ্ঠান সকলের সম্মতি নিয়ে হয়েছিল। কী ভাবে আমাকে কটাক্ষ করা হবে, প্রথমেই চিত্রনাট্য শোনানো হয়েছিল আমাকে। আমার সম্মতিতেই সবটা হয়েছিল। কোনও ভাবেই তা শালীনতার সীমা ছাড়ায়নি। আমার অসফল ছবি নিয়ে মজা করা হয়েছিল। আমার কোনও ভুল নিয়ে মশকরা করা হলে তার মধ্যে অন্যায়ের কিছু দেখি না। কারণ আমার অনুমতি নিয়েই করা হয়েছিল।”
রণবীরের প্রসঙ্গে অঙ্কুশ বলেন, “রণবীর যা বলেছেন, তা সত্যিই কুরুচিকর। খুবই অংসবেদনশীল। সকলের রাগ হওয়া স্বাভাবিক। খুবই বিরক্তিকর মন্তব্য। ওর মধ্যে কোনও রসিকতা নেই।” কিন্তু ঘটনার পর থেকে রণবীরকে ভাবে ওকে আক্রমণ করা হচ্ছে, সেটাও বাড়াবাড়ি বলে মনে করেন অঙ্কুশ। তাঁর দাবি, যেটুকু শাস্তি রণবীরের প্রাপ্য, সেটুকুই যেন তিনি পান। বাঙালি অভিনেতা মনে করেন রণবীর বা সময় কেউ অপরাধী নন। নিজেরাই নিজেদের ভুলও বুঝেছেন। অঙ্কুশ বলেন, “এর চেয়ে অনেক গুরুতর ঘটনা ঘটে চলেছে চারপাশে। সে দিকে নজর দেওয়া উচিত।” একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোনও পেশাদারের কর্মজীবন নষ্ট করে দেওয়ারও বিপক্ষে অঙ্কুশ। শুধু তা-ই নয়, অঙ্কুশ আঙুল তুলেছেন সমাজের বদলে যাওয়া প্রবণতার দিকেও। তাঁর দাবি, “এমন বহু লিঙ্গবৈষম্যমূলক অপশব্দ আমরা প্রতি দিন ব্যবহার করি, বলতে বলতে আজ সেটা খুব স্বাভাবিক বলে মনে হয়। আমি মনে করি, সেখান থেকেই সমস্যার শুরু। তাই ওঁদের অপরাধী বানিয়ে দেবেন না দয়া করে।”
সমাজমাধ্যমে প্রায়ই বিভিন্ন মানুষকে বা তাঁদের কাজকে ব্যঙ্গ করে থাকেন কিরণ দত্ত ওরফে ‘বং গাই’। তাঁকে ফোনে ধরার চেষ্টা করলে ফোন বেজে গিয়েছে। কিন্তু নিজের সমাজমাধ্যমে একটি ছবি ভাগ করে নিয়েছেন তিনি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে তৈরি ছবিতে একসঙ্গে দেখা যাচ্ছে, রণবীর ইলাহাবাদিয়া ও কিরণকে। নেটপ্রভাবী লেখেন, “বাংলার সমস্ত সংবাদমাধ্যমকে আমি একেবারেই বলতে চাই, এই লোকটাকে আমি চিনি না। এটা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা তৈরি ছবি এবং তিনি কেন আমাকে ইনস্টাগ্রামে ফলো করেন আমি জানি না। এ ছাড়া এ বিষয়ে আমার আর কোনও মতামত নেই। ধন্যবাদ।”
এই প্রসঙ্গে আর এক নেটপ্রভাবী ঝিলম গুপ্ত বলেছেন, “সময় রায়নার ‘ইন্ডিয়া’জ় গট ল্যাটেন্ট’ যাঁরা দেখেছেন তাঁরা জানেন, এটা প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। অন্য দিকে রণবীর সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের কাজ করেন। তিনি প্রায়ই ধর্মগুরু বা ইতিবাচক জীবনযাপন ইত্যাদি নিয়ে পডকাস্ট করেন। মানুষ কিন্তু ওঁকে সেই কাজের মাধ্যমেই চেনে। সময়ের অনুষ্ঠান শুরুই হয় গালিগালাজ দিয়ে। সেখানে গিয়ে হয়তো অন্যদের মতো হওয়ার তাড়নায়ই অমন মন্তব্য করে ফেলেছেন রণবীর।” এ ক্ষেত্রে ঝিলমের দাবি, জোর করে রসিক হওয়া যায় না। সময়ের অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু নিয়েও ঝিলম দাবি করেছেন, সেখানে ২০ শতাংশ হাস্যরস থাকে, বাকি ৮০ শতাংশ অপশব্দ। যদিও সময়কে রসিক বলেই মনে করেন ঝিলম। কিন্তু রণবীরকে কেউই কৌতুকশিল্পী হিসাবে দেখতে অভ্যস্ত নন। সৌরভ পালোধীর সুরে সুর মিলিয়ে ঝিলমও বলেন, “আমার কমেডিতে আপত্তি নেই। কিন্তু একটা তো সীমা থাকা দরকার। যদিও পশ্চিমি সংস্কৃতিতে কিন্তু এই ধরনের মন্তব্য প্রায়ই করা হয়। এমনকি এর থেকে খারাপ মন্তব্যও করা হয়। সেটা সমর্থনযোগ্য কি না, তা ভিন্ন তর্কের বিষয়। কিন্তু এই অনুষ্ঠানে রণবীরের এই মন্তব্য খুবই অবাঞ্ছিত ছিল।”
বিতর্কিত মন্তব্যের জন্য রণবীর ও সময়ের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগও দায়ের হয়েছে। কটাক্ষ ধেয়ে আসাও বন্ধ হয়নি। এ প্রসঙ্গে সৌরভ পালোধী বলেছেন, “সময় রায়না বা রণবীরের বিরুদ্ধে বাঙালি হঠাৎ যেমন জেগে উঠেছে, সেটারও প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করি না। এর আগে অনেকেই হয়তো জানতেন না এই অনুষ্ঠানগুলি সম্পর্কে। কিন্তু তাঁরাও প্রতিবাদ করছেন সমাজমাধ্যমে।” সৌরভের দাবি, যা-ই ঘটে থাকুক রণবীর বা সময়ের কিছু প্রতিভাও রয়েছে। সে দিকটি ভুলে যাওয়ার কোনও অর্থ নেই। তিনি বলেন, “হঠাৎ এমন পরিস্থিতি তৈরি হল, ওঁদের আর শিল্পীর মর্যাদাই দেওয়া যাচ্ছে না! এগুলি ঠিক নয়। রণবীরের মন্তব্য ভাল লাগেনি ঠিকই। কিন্তু তিনি সরাসরি ক্ষমা চেয়ে নিয়েছেন। তাই সমাজমাধ্যমের নীতিপুলিশির এখন দরকার নেই।”